Published : 10 Oct 2012, 08:52 PM
সিরিয়ায় গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট এবং গৃহযুদ্ধ আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে আঞ্চলিক সামরিক সংঘাতে পরিণত হতে যাচ্ছে কিনা সেটাই এখন অনেকের মনে প্রশ্ন। গত সপ্তাহে তুরস্কে সিরিয়ার মর্টার হামলার পর তুরস্কের বিমান বাহিনীর অভিযান এবং তুরস্কের পার্লামেন্ট কর্তৃক সামরিক বাহিনীকে এ ধরণের পাল্টা অভিযান বিষয়ে অনুমোদন দেবার পর এই প্রশ্ন এখন কোনো অবাস্তব বিষয় নয়; নেহাতই কল্পনা বা দূরপ্রসারী আশংকা বলেও একে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। যদিও প্রথম দফা হামলার জন্য সিরিয়া দুঃখ প্রকাশ করেছিলো তারপরেও দফায় দফায় হামলা হয়েছে। তুরস্কের পক্ষ থেকে তার পাল্টা জবাবও আমরা লক্ষ করছি।
সিরিয়ার সংকট এক অর্থে অনেক আগেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করেছে এবং একটি আঞ্চলিক সংকটের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ মাসের গোড়াতে দেয়া আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থার হিসেব অনুযায়ী কমপক্ষে সোয়া তিন লাখ লোক দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। ইউএনএইচসিআরের তালিকায় শরণার্থী হিসেবে নাম লিখিয়েছেন বা লেখানোর জন্য অপেক্ষমান ৩ লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিরীয় আশ্রয় নিয়েছেন তুরস্কে। তুরস্কের বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে যে তাঁদের হিসেব অনুযায়ী ৩ লাখ লোক তাঁদের দেশেই এসেছেন। যদিও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হিসেব অনুযায়ী তুরস্কে নিবন্ধিত শরণার্থীর সংখ্যা এক লাখের মতো এবং এই সংখ্যা বাড়ছে। তা ছাড়া লেবানন, জর্ডান এবং ইরাকের কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায়ও গেছেন হাজার হাজার মানুষ। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা বলছে যে গত তিন মাসে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়েছে এবং তাঁদের আশংকা যে সব মিলে শরণার্থীর সংখ্যা ৭ লাখের বেশি হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। দেশের ভেতরে সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে ২০১১ সালের এপ্রিল মাস থেকে কমপক্ষে ১৫ লাখ নাগরিক দেশের ভেতরে বাস্তচ্যুত হয়েছেন বলে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার দাবি। এদের অনেকেই যে শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থীতে পরিণত হবেন এমন আশংকা অনেকেরই।
শুধু শরণার্থীর কারনেই নয়, সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনা ঘটেছে বলা যায় এ কারণেও যে সিরিয়ার ক্ষমতাসীন বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহীরা লড়াই করছেন তাঁরা প্রত্যক্ষভাবেই তুরস্কের সমর্থন পেয়ে আসছে। ফ্রি সিরিয়ান আর্মি বলে বিদ্রোহীদের যে সেনাবাহিনী রয়েছে তার ঘাঁটি কার্যত তুরস্কে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি দাবি করে যে তাঁরা দেশের অভ্যন্তরে মুক্ত এলাকায় তাঁদের ঘাঁটি স্থানান্তর করেছে। কিন্ত তাঁদের অস্ত্র এবং রসদ সরবারহের পথ যে তুরস্ক এ কথা সবারই জানা আছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ভূমিকার সঙ্গে তুরস্কের বর্তমান ভূমিকা তুলনীয়। আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার যদিও এ নিয়ে কোনো রকম উচ্চবাচ্য করেন না, সকলেই এ বিষয়ে অবহিত যে তুরস্কের সাহায্য ছাড়া ফ্রি সিরিয়ান আর্মির পক্ষে লড়াই অব্যাহত রাখা দুরূহ হয়ে পড়বে।
বিদ্রোহীদেরকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সিরিয়ার সরকার কেবল যে কথাবার্তাই বলছেন তা নয়; তাঁরা তুরস্কের সীমান্তবর্তী কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলে তাঁদের উপস্থিতি এবং নিয়ন্ত্রন হ্রাস করেছেন। তাঁদের লক্ষ হল এইসব এলাকায় কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পিকেকে'র সদস্যদের সহজে সংগঠিত হতে দেয়া এবং তুরস্কে হামলা চালানোর সুযোগ করে দেয়া। তুরস্কের অভিযোগ হলো ইরানও একই কৌশল নিয়েছে। প্রমাণ হিসেবে গত কয়েক মাসে তুরস্কের ভেতরে কয়েকটি শহরে বোমাবাজির ঘটনার কথা তুরস্ক তুলে ধরেছে।
তুরস্ক এবং এই অঞ্চলের দেশগুলো, এমন কি যারা বাশার আল আসাদের সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ সংঘাতে সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়তে খুব বেশি আগ্রহী নয় এ কারণে যে তার প্রভাব দেশের ভেতরে পড়বে এবং নিজ দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। প্রতিবেশি লেবাননের কথাই ধরা যাক। সিরিয়ার সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক জটিল বললে কমই বলা হবে। সিরিয়া ১৯৭৬ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত লেবাননে সামরিকভাবেই উপস্থিত ছিল। লেবাননের প্রভাবশালী সংগঠন হেজবুল্লাহ সিরিয়ার সরকারের সমর্থক এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা; কিন্ত তাঁরা কেবল যে নৈতিক সমর্থন দিচ্ছেন এমন মনে করারও কারণ নেই। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য হল হেজবুল্লাহ লোকবল দিয়েও সিরিয়ার সরকারকে সাহায্য করছে। কিন্ত এ নিয়ে তাঁরা খুব প্রত্যক্ষভাবে কোনো ধরণের বক্তব্য দেয় না, তার কারণ ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে দেশের অভ্যন্তরে কিছু কিছু সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। লেবাননের দেড় দশকের গৃহযুদ্ধের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা এখনও মানুষের মনে জ্বলন্ত। তাঁরা এখন আর এ ধরণের পরিস্থিতির সূত্রে সেই বিভীষিকার দিনে ফিরতে চান না।
সিরিয়ার সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যেকার একটা পার্থক্য হল তাঁরা ইসলামের দুটো ভিন্ন ধারার প্রতিনিধি। সরকার শিয়া সম্প্রদায়ের একটি ধারার – আলাওয়াইত – অনুসারী; অন্য দিকে বিদ্রোহীরা প্রধানত সুন্নী সম্প্রদায়ভুক্ত। সিরিয়ার প্রতি ইরানের সমর্থনের পেছনে যে এটা একটা কারণ তা অস্বীকারের উপায় নেই। অন্যদিকে বিদ্রোহীরা যে তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতারের আর্থিক সাহায্য পাচ্ছে তার কারণও এক অর্থে এই সূত্রে বাঁধা। ফলে যে সব দেশে শিয়া-সুন্নি দুই সম্প্রদায়ের অনুসারীরা আছেন তাঁদের জন্য এই নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের আগে অভ্যন্তরীণ বিষয় বিবেচনা করতে হচ্ছে। লেবাননের জন্য যেমন এটি একটি সমস্যা তেমনি ইরাকের জন্যেও। ইরাকের জন্য সমস্যাটি আরো বেশি তার কারণ হল একদিকে ইরানের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যে কারণে তাঁরা সিরিয়ার আসাদ সরকারের প্রতি রয়েছে তাঁদের সমর্থন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য। জর্ডান সিরিয়া পরিস্থিতি থেকে গত দেড় বছর এক ধরণের দূরত্ব বজায় রেখেছে। কিন্ত সেপ্টেম্বর থেকে ধীরে ধীরে সরব হয়ে উঠতে শুরু করেছে। জর্ডান এই সংকটের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে চিন্তিত। কেননা শরণার্থীদের কারণে তাঁদের সীমিত সম্পদের ওপর চাপ পড়তে শুরু করেছে। সেপ্টেম্বরে জর্ডানের পুলিশের সঙ্গে একদল শরণার্থীর সংঘর্ষের পর সরকার দেশের আইন পরিস্থিতির ওপর তার প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। জর্ডানে বিশাল সংখ্যক ফিলিস্তিনি শরণার্থীর উপস্থিতির কারণে আরো বেশি শরণার্থী জর্ডানের জন্য সব সময়ই চিন্তার বিষয়।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে পক্ষাবলম্বনের ক্ষেত্রে শিয়া-সুন্নি বিবেচনা যেমন একটা বিষয় তেমনি বিবেচনা হল আঞ্চলিক রাজনীতিতে কোন কোন দেশ প্রভাব বিস্তার করতে চায়। তুরস্ক এই অঞ্চলে, অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে, কোন ধরণের ভূমিকা রাখার ব্যাপারে অনুৎসাহী ছিলো দীর্ঘদিন। গত দশকে তুরস্কের পররাষ্ট্র নীতির ছিল এই এলাকার দেশগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করা। সিরিয়া ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্কে নাটকীয় উন্নতি ঘটে জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর। ইসরাইলের বিরোধিতা এবং ইরাক যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপোড়েন এই সম্পর্কোন্নয়নের অন্যতম কারণ। তা ছাড়া, বিছিন্নতাবাদী পিকেকে'র প্রতি ইরান ও সিরিয়া সহানুভূতিশীল থাকবে না এমন আশ্বাসের কারনেও তাঁরা এ বিষয়ে এগিয়ে আসে। ১৯৯৮ সালে তুরস্কের চাপের মুখে সিরিয়া পিকেকে নেতা আবদুল্লাহ ওচালান-কে দেশ থেকে বের করে দেয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির জন্য তুরস্কের চেষ্টারও ফসল ছিলো এই কূটনৈতিক পদক্ষেপ। কিন্ত সিরিয়ায় সংঘাত শুরু হবার পর থেকে সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে ভাটা পড়ে, এক পর্যায়ে তা সংঘাতের দিকে এগোতে শুরু করেছে। কেননা তুরস্ক নিজেকে এই অঞ্চলের রাজনীতির একটি নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হিসেবে দেখতে চায় এবং তাঁদের সেই আঞ্চলিক আকাঙ্খার ইঙ্গিত দিতে তাঁরা গত বছরগুলোতে মোটেই পিছপা হয়নি। বিপরীতক্রমে, ইরান নিজেকে এই অঞ্চলের একটা বড় শক্তিই কেবল মনে করে না, ইরানী শাসকদের ধারণা হল যে এই এলাকায় মার্কিনী প্রভাব মোকাবেলা করতে একমাত্র তারাই সক্ষম। তুরস্কের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছিলো তখন যখন তুরস্কের আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষা ছিল না। এখন সে পরিস্থিতি নেই। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থানের কারনেও ইরান তার প্রভাব বলয় বাড়ানোর তাগিদ অনুভব করছে। তা ছাড়া জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে মিসরের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসীর বক্তব্য ইরানের জন্য প্রীতিকর ছিলোনা। আরব বসন্ত বলে পরিচিত পরিবর্তন আঞ্চলিক রাজনীতিতে এসব নতুন সমীকরণের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন এই নতুন সমীকরণের মধ্যে তার জন্য যতটুকু সুবিধা নেয়া সম্ভব সে চেষ্টা করবে–সেটা মোটেই বিস্ময়ের বিষয় নয়। যে কারণে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সাহায্য দেয়ার ব্যাপারে তাঁদের কোনো রকম দ্বিধা নেই। কিন্ত তারচেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এখনও এগিয়ে আসেনি; তার কারণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাশিয়া ও চীনের সম্মতির অভাব আর অভ্যন্তরীণভাবে আসন্ন নির্বাচন । যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকায় তুরস্ক খুব খুশি নয়। তাঁরা চায় যুক্তরাষ্ট্রের আরো জোরদার ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক সিরিয়ার হামলার জবাবে তুরস্কের নেয়া ব্যবস্থাকে সমর্থন করেছে। এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলো দু পক্ষকে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য অনুরোধ করেছে।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সূচনা যেভাবেই হোক না কেন গত আঠারো মাসে এর সঙ্গে আঞ্চলিক ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। এখন এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের ঠান্ডা লড়াই সামরিক রূপ নিতে শুরু করেছে বলে আশংকা করা যেতে পারে। তুরস্ক ন্যাটো'র সদস্য দেশ বলে তার প্রয়োজনে ন্যাটো এগিয়ে এলে পরিস্থিতি আরো খারাপই হবে। কিন্ত যেভাবেই বিবেচনা করি না কেন সে লড়াইটা যে ইরান বা তুরস্কে হবে না সেটা আমরা অনুমান করতে পারি – হবে সিরিয়ায়, ফলে সিরিয়া সংকটের আশু সমাধানের সম্ভাবনা কম বলাই ভালো।
ইলিনয়, ৬ অক্টোবর ২০১২।
আলী রীয়াজ:যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।