Published : 06 Sep 2020, 08:38 PM
ক'দিন আগে ফেইসবুকে এক জুনিয়র সহকর্মীর একটা স্ট্যাটাসের কথা মনে পড়ল। আমার চেম্বারে একটা বড়সড় টিভি আছে। রোগী দেখার ফাঁকেফাঁকে আড়চোখে স্ক্রলে চোখ রাখার সুবিধার জন্য টিভিটা বিশেষ কায়দা করে বসানো। সেদিন চেম্বার করার ফাঁকে হঠাৎ চোখে পড়লো মন্ত্রী মহোদয় সংবাদ সম্মেলন করছেন, বিষয়বস্তু টিকা। সহকারীকে বললাম সাউন্ডটা বাড়িয়ে দিতে। চেম্বার আপাতত স্থগিত। টিকার ব্যাপারটা একটু ভালো করে বুঝতে হবে। কখন কোন টক শো কিংবা ফেইসবুক লাইভে প্রশ্ন করে বসবে আর ঠিকঠাক মতো উত্তর দিতে না পেরে বিব্রত হওয়ার ঝুঁকিটা নেওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি 'নিজের বাঁচার' প্রশ্নটাও আছে। একবার কোভিড হয়েছে, ভালোয় ভালোয় পার পেয়েছি। দ্বিতীয়বার কোভিডে কুপোকাত হওয়ার ইচ্ছা আমার একেবারেই নেই। অতএব আমার ভ্যাকসিন চাই-ই চাই, আর তাও খুব তাড়াতাড়ি। তাই এত আগ্রহ নিয়ে চেম্বার স্থগিত করে বক্তব্য শুনতে বসা। আর তা শুনতে শুনতেই মনে পড়ল অনুজ সহকর্মীটির ফেইসবুক স্ট্যাটাসটির কথা।
আমার এই সহকর্মীটি সম্প্রতি একটি টয়োটা গাড়ি কিনেছেন। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে তার গর্বিত ভঙ্গির ছবি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে আর সাথে গাড়ি কেনার আনন্দে উচ্ছ্বসিত উচ্চারণ। খুবই ভালো লেগেছিল। গাড়ি কেনার আগে সে অনেকের সাথেই পরামর্শ করেছিল। সবাই তাকে জাপানি গাড়ির কথাই বলেছে। পই-পই করে অন্য দেশের গাড়ি কিনতে মানা করেছি আমিও। বলেছি গাড়ি মানেই জাপানি আর টিভি মানেই সনি। ব্যাপারগুলো আসলে এরকম-ই। নিজের জন্য আমরা সবসময় ভালোটাই খুঁজি।
গাড়ি কেনা তো অনেক বড় ব্যাপার। রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়াই হোক কিংবা অন্য কিছু, নিজের বেলায় ভালোটার ব্যাপারে আমরা কেউ কখনো আপস করি না। আর তা সে যা-ই হোক না কেন, নিজের জন্য কিছু কেনার সময় কাউকে কি কখনো চীনা জিনিস খুঁজতে দেখেছেন? আমি নিশ্চিত জানি উত্তরটা, না। ব্যতিক্রম একটাই, চীনা খাবার। কিন্তু টিভি দেখতে দেখতে কেন যেন মনে হচ্ছিল, কারও কারও বোধহয় চীনা খাবারের পাশাপাশি চীনা ভ্যাকসিনের প্রতি আগ্রহটা একটু বেশিই।
ভ্যাকসিন আবিষ্কারে চীনাদের তেমন বড় কোনো সাফল্যের কথা আমার জানা নাই। এবার এই করোনাকালে দেখলাম ভ্যাকসিন দৌড়ে জোরেসোরে সামিল হয়েছে চীনও। শেষমেশ কী হবে, কোথায় দাঁড়াবে জানি না। তবে আর দশজনের মতো আমিও চাই, এই দৌড়ে তারা ঠিকঠাক মতো টিকে থাকুক। তবে আমার একটা ভয়ও আছে। চীনা ভ্যাকসিনটা ইনঅ্যাকটিভেটেড ভ্যাকসিন। অর্থাৎ সার্স-কোভ-২ ভাইরাসকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় নিষ্ক্রিয় করে মানুষের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হবে, আর তা থেকে মানুষের শরীরে তৈরি হবে সার্স-কোভ-২-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি। প্রক্রিয়াকরণের কোনো একটি পর্যায়ে যদি ভাইরাসটি যথাযথভাবে নিষ্ক্রিয় না হয় তাহলে এর মাধ্যমে লাখো মানুষের শরীরে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে পারে অর্থাৎ ভ্যাকসিন দেওয়ার কারণেই ছড়িয়ে পড়তে পারে মানবসৃষ্ট আরেক নতুন মহামারী। তার চেয়েও বড় কথা পৃথিবীতে কখনও তো এত কোটি-কোটি ডোজ ভ্যাকসিন একসাথে তৈরি হয়নি। কাজেই প্রক্রিয়াকরণে যদি তেমন কোনো বিপত্তি ঘটেই যায়, খুব বেশি দোষ দেওয়ারও তো সুযোগ থাকছে না। শুধু যার যাবে, তার যাবে পুরোটাই!
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি চীনা ভ্যাকসিন থেকে একদমই আলাদা। শরীরে প্রবেশ করানোর পর এটি শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে সার্স-কোভ-২ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করবে। এটি বা অন্য কোনো ভ্যাকসিনে যে ঝামেলা হবেই না, সেটিও বেদবাক্য নয়। তবে অক্সফোর্ড তো অক্সফোর্ডই। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাপকাঠি এই বিশ্ববিদ্যালয়টি, যে কারণে উৎকর্ষের শিখরে যখন পৌঁছেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন তাকে বলা হতো 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড'। আর দুষ্ট লোক যখন বলে চীনা জিনিস মানেই পশ্চিমাদের জন্য এক কোয়ালিটি আর আমাদের জন্য আরেক, তখন তো সেকথা উল্টে দেওয়ার মতো খুব বেশি জোরাল যুক্তিও খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি চীনা ভ্যাকসিন যে কাজ করবে এমনটি বিশ্বাস করেনই বা কজন?
সংবাদ সম্মেলনটি দেখে আমি অবাক হয়েছি অন্য কারণে। অবাক হয়েছি এই কারণে যে এই করোনাকালেও পুরো জাতির স্বাস্থ্যের দায়-দায়িত্ব যার উপর ন্যাস্ত, তিনি বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানিটির নামটাও ঠিকমতো বলতে পারলেন না। অবাক হয়েছি, তবে দোষ দেই না! কারণ ক'দিন আগেই তো তার মুখে ভ্যাকসিন ছাড়াই আপনা-আপনি করোনাভাইরাস বিদায়ের বয়ান শুনেছি। তবে দোষ দিতে ইচ্ছে করছে যখন সংবাদ সম্মেলনটিতে ভ্যাকসিন ট্রায়ালের প্রসঙ্গটা উঠল। ট্রায়ালের কথা বলে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের সাথে চীনা ভ্যাকসিনের তুলনা করার জন্যও আমি তাকে দোষ দেই না। আজকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে যদি কেউ বলেন যে, কোভিড-১৯ আপনাআপনি বিদায় নিবে, লাগবে না কোনো ভ্যাকসিন, তবে তিনি এমন কথা বলতেই পারেন, তাতে আমি দোষের কিছু দেখি না।
যেহেতু মন্ত্রী মহোদয় চিকিৎসা বিশারদ নন, তাই এই বাস্তবতাটা না জানার জন্য তাকে দোষ দেয়ার হয়তো কিছু নেই। কিন্তু আমাদের ওষুধ আইনে তো গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা আছে যে উন্নত বিশ্বের কোনো একটি দেশ, অর্থাৎ ইউএসএ, কানাডা, ইউকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর জাপানের মধ্যে যে কোনো একটি দেশে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত হলে সে ওষুধটি বাংলাদেশে সরাসরি রেজিস্ট্রেশন পাবে এবং কোনো ট্রায়াল ছাড়াই। মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তিটির যদি এইটুকুও জানা না থাকে, তখন তা আমার কাছে দোষের মনে হয় বৈকি!
এই করোনাকালেই তো দেশে কোভিডের নতুন নতুন কত ওষুধ আসলো। ফ্যাভিপিরাভির, রেমডেসিভির – এসব তো বাংলাদেশে রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে কোনো ট্রায়াল ছাড়াই। ট্রায়াল লাগেনি কারণ এই ওষুধগুলো উন্নত দেশে অনুমোদিত।
ভ্যাকসিন ট্রায়ালের প্রসঙ্গটি যখন এলো তখন আমার মনে প্রশ্ন একটাই, এটি কি কারও অজ্ঞতা নাকি বাংলাদেশে ভ্যাকসিন-দৌড়ে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনকে ল্যাং মারার জেনেশুনে কোনো প্রয়াস। তবে এটা ঠিক, আমার অত কিছু বোঝার দরকার নেই। আমি জানি আমার চাই আমার জন্য ভালোটাই। ভালোর উপরও যদি আরো ভালো কিছু থাকে, তবে আমার তাই-ই চাই। আমি বাড়ি ফিরি জাপানি গাড়িতে আর ঘুমাই ওয়াল্টন এসির বাতাস খেতে খেতে। আমার তাই প্রয়োজন অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন। আর দেশেই যদি তৈরি হয় ভালো কোনো ভ্যাকসিন, তবে সেটা নিতেও আমি এক পায়ে খাড়া। তবে আমার কাছে চীনা ভ্যাকসিনের কোনো জায়গা নেই। না, আমি রাজনীতি করছি না – আমি শুধু নিজের জন্য ভালোটাই খুঁজছি আর ভালোটাই বুঝছি। আর এ জন্য বরাবরের মতোই আমি আস্থা রাখছি পুরো জাতির যিনি আশার বাতিঘর, একমাত্র সেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর।