Published : 19 Nov 2020, 02:51 AM
কোভিড-১৯ মহামারীর আগে এই দেশের ওয়াজকারীদের সিংহভাগ মাইকে জোর গলায় দাবি করেছিল, "করোনা আল্লাহর সৈনিক। আল্লাহ করোনা পাঠিয়েছে বিধর্মীদের শায়েস্তা করতে। মুসলমানের করোনা হবে না। যদি কোনো মুসলমানের করোনা হয়, তবে আল্লাহর কোরআন মিথ্যা হয়ে যাবে, লিখে রাখেন সবাই।"
যার তথ্য প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক, টুইটার বা ইউটিউবে সার্চ করলেই পাওয়া যাবে। এসব বক্তব্যের কারণে কেউ বলতে পারবে কোনও ওয়াজকারী তথাকথিত আলেমের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মিছিল হয়েছে? কোথাও তাদের মিথ্যাচারের কারণে ঘরবাড়ি পোড়ানো হয়েছে বা গণধোলাই দেওয়া হয়েছে? হয়নি। তবে একই ধরনের কথা মোল্লার উদ্ধৃতি দিয়ে কোনো ভিন্ন ধর্মের নাগরিক তার ফেইসবুকে পোস্ট করলে বা কমেন্টে লিখলেই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে, বাংলাদেশের মুমিন মুসলমানরা 'মনে কষ্ট নিয়েছে', ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত করে মিছিল করেছে, মামলা গ্রহণ করতে আইন শৃংখলা বাহিনী বাধ্য হয়েছে, আর অতি দ্রুততার সাথে রাতারাতি গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরী, যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন থানায় রয়েছে নাশকতাসহ বিভিন্ন অপরাধে কয়েক ডজন মামলা। অর্থাৎ যিনি একজন অভিযুক্ত অপরাধী, বাবুনগরীর বিরুদ্ধে, নাশকতা, হত্যার মামলার থাকার পরেও সেই বাবুনগরীকে নিয়ে ফেইসবুক পোস্টে সমালোচনা করেছিলেন একজন কলেজ অধ্যক্ষ, যিনি সনাতন ধর্মাবলম্বী; তার নামে ধর্ম অবমাননার দায়ে চাঁদপুরে রীতিমত তুলকালাম! মিছিল হয়েছে, হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়েছে, তার বাড়িঘর ঘেরাও দিয়ে রাস্তায় নেমছে বাবুনগরীর সমর্থক কর্মীরা। তারপরে ওই হিন্দু ধর্মের অনুসারী ভদ্রলোক বাধ্য হয়ে বাবুনগরীর বাহিনীর কাছে লিখিত নাকে খত দিয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ থেকে আপাতত কোনও রকমে জীবন বাঁচিয়েছেন।
পাশের দেশ ভারতের অতি সম্প্রতি একটি ঘটনা, বলিউড সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চনের সঞ্চালনার একটি রিয়েলিটি শোয়ের অনুষ্ঠানে সনাতন ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ রামায়ণ থেকে একটি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল অংশগ্রহণ করা অতিথির জন্য। সেখানে প্রশ্নের অপশনে সমস্যা ছিল না, সঠিক উত্তরেও সমস্যা ছিল না, সমস্যা ছিল অমিতাভ বচ্চন সঠিক উত্তরটির প্রসঙ্গে কিছু কথা যোগ করেন। আর এতেই ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মারাত্মক ব্যথিত হয়ে, ধর্ম অবমাননার দায়ে অমিতাভ বচ্চনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেন।
ভার্চুয়াল জগতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্লগে লেখালিখি করছে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে- বিশেষ করে সেই সব ব্লগার, যারা অবগত আছেন ধর্ম অবমাননার ফাঁদ সম্পর্কে, এমনকি তাদের অভিজ্ঞতাও বেশ ভালো। দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে একটা ব্লগ লিখলেন কোনও ব্লগার, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী "যুদ্ধাপরাধী", "রাজাকার" শব্দগুলো উল্লেখ করতে হয়, সেই লেখায় উল্লেখ করতে হতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী "যুদ্ধাপরাধী", "রাজাকার" সংগঠন জামায়াতে ইসলাম এবং ইসলামী ছাত্র শিবির (সাবেক ছাত্রসংঘ) এর নাম, উল্লেখ করতে হতো জামায়াতে ইসলামীর নেতা দণ্ডপ্রাপ্ত রাজাকারদের নাম, উদাহরণ- দেলু বা দেইল্যা রাজাকার, মইত্যা রাজাকার, কসাই কাদের মোল্লা, বা রাজাকার শিরোমনি গোয়াজমের নাম (বানান হুবহু ঠিক এভাবেই লিখতেন ব্লগাররা)। সেই লেখা যখন পাবলিশ হতো, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পাঠকেরা ব্লগের মন্তব্যের ঘরে বাহবা দিতো, ইতিহাস জানার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতো কিংবা কেউ প্রয়োজনীয় আরও তথ্য সংযুক্তি থাকলে তথ্য সংযুক্ত করতো। অপরদিকে সেই ব্লগে জামায়াত শিবিরের সমর্থকেরাও হাজির হতো। তবে তাদের স্টাইল ছিল ভিন্ন রকমের, সম্পূর্ণ তাদের মতো করে। তাদেরকে যা শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হতো, তাদের মুখস্থ বা কপিপেস্ট করা বাক্যে যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, জামায়াতের পক্ষ নিয়ে সমর্থন করে একটা মনগড়া ভুল তথ্যের মন্তব্যের মাধ্যমে তারা তাদের উপস্থিতি জানান দিত।
প্রতি উত্তরে লেখক ব্লগার বা পাঠক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ যদি মন্তব্যটি ভুল, মিথ্যা, অসত্য, রাজাকারের পা-চাটা উল্লেখ করতো, জামায়াত শিবিরের সমর্থক মন্তব্যকারী পরের জবাবে হাজির হতো, কুরআন, মহানবী (সা.) ও আল্লাহর নাম নিয়ে, যা ওই লেখার মন্তব্যের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক এবং অপ্রয়োজনীয়। তাদের এসব মন্তব্যের উত্তর দিতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ যদি রাজাকার ইস্যুতে আল্লাহ, নবী, কুরআন কেন আসবে ইত্যাদি প্রশ্ন তুলে মন্তব্য করতেন, বিপত্তির শুরু হতো সেখান থেকেই। সেটাকে পুঁজি করে জামাত-শিবিরের কর্মী সমর্থকরা জবাবে লিখতো, মহানবীর নামের পিছনে (সা.) কই? আল্লাহ কি শুধুই আল্লাহ? এই দো-জাহানের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, সন্মান না দিয়ে লেখাটা কি ঠিক হলো? ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ তুলে পোস্টদাতাকে নবীবিরোধী, আল্লাহবিরোধী, কুরআনবিরোধী, নাস্তিক, কাফের আখ্যা দিয়ে দিতো তারা।
জবাব লিখেই শান্ত হলে ভালো ছিল, কিন্তু সেটা তারা কখনও করেনি, সেই কমেন্টের স্ক্রিনশট নিয়ে বা কপি করে সাথে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের উক্ত ব্লগার লেখকের নামে ফেইক আইডি খুলে আল্লাহ, নবী, কুরআন-বিরোধী অত্যন্ত জঘন্য ভাষায়, নোংরা লেখা নিজেরাই লিখে সেই স্ক্রিনশট নিয়ে পোস্ট করতো তাদের গোত্রীয় গ্রুপ বা ব্লগে। ব্যস তারপরই শুরু হতো প্রতিক্রিয়া দেখানো। ইসলাম ধর্মবিরোধী, রাসুল (সা.) বিরোধী, নাস্তিকের কল্লা কাটতে হবে, এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে ইত্যাদি। ঠিক এভাবেই একটা ওয়েবসাইট খুলে বানোয়াট লেখা প্রকাশ করে সেটার মাধ্যমে উস্কানি দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ব্লগার 'থাবা বাবা' ওরফে রাজীবকে।
গত এক যুগ ধরে যারা ভার্চুয়াল জগতের সাথে সম্পৃক্ত, তারা আরো ভালো বলতে পারবে, এটাই ছিল ভার্চুয়ালে ধর্ম অবমানাকারী বানিয়ে কল্লা কাটার বৈধতা দেওয়ার জামায়াত শিবিরের নিঞ্জা টেকনিক, ফাঁদ, লজিক, কৌশল যেই নামেই বলা হোক না কেন। তবে ধর্ম অবমাননার দোহাই দিয়ে হত্যা করার ফতোয়া বা হত্যাকাণ্ড ঘটানোর ইতিহাস জামাত-শিবিরের আরও পুরনো।
ড. আহমদ শরীফকে মুরতাদ ঘোষণা করে পোস্টার লাগানো, ড. হুমায়ুন আজাদকে বইমেলায় কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা করা হয়। রাজাকার দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী তার বক্তব্যে মিথ্যা দম্ভ করে বলেছিলেন, "জার্মানিতে গিয়ে হুমায়ুন আজাদকে 'খতম' করে দেওয়া হয়েছে।"
ধর্ম অবমাননার অভিযোগের অবাধ ব্যবহার, উৎপাদন ও বিপণন, যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এটা পুরোটাই একটি জামায়াত ইসলামী ও শিবিরের মেধা (!) প্রসূত উৎপাদিত পণ্য, যা একবার প্রস্তুত করে ঠিকমত গ্রুপভিত্তিক বিপণন (শেয়ার, লাইক, কমেন্ট) সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারলে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়, তার জীবনকে নরক বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় খুব সহজেই। এসব কাজ করার জন্য তাদের বেশ কিছু গোপন গ্রুপ রয়েছে। যেখানে তাদেরকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়, কোন ব্লগার বা লেখককে টার্গেট করতে হবে, তার সাথে কীভাবে সুকৌশলে মিশে যেতে হবে, কীভাবে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে হবে, মেসেজে বা মন্তব্যে কীভাব উস্কানি দিয়ে এমন কোনও বক্তব্য বের করে আনতে হবে, যা পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়।
রাজনৈতিক দল হিসেবে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন বলে প্রমাণিত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর সাংগঠনিকভাবে একটা ধাক্কা খেলেও কূটকৌশলের জোরে তারা সামলে ওঠে। সাংগঠনিক শক্তিতে তারা দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর চাইতে কোনও অংশে দুর্বল নয়। গোছানো পরিচালনা পদ্ধতি এবং কর্মীদের আনুগত্য সংগঠনটির বড় শক্তি। দলের অর্থনৈতিক ভিত্তি হলো বড় বড় অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। সংগঠন পরিচালনা করা, বিভিন্ন খাতে খরচ জোগানো, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠী থেকে তহবিল সংগ্রহ- সবই চলমান রয়েছে তাদের, দলের নিবন্ধন না থাকলে কী হবে! তাই নেতৃত্বশুন্য হলেও গুছিয়ে উঠতে সময় লাগেনি। তবে প্রকাশ্য রাজনীতি যেহেতু করতে পারছে না, তাই কারো না কারো ঘাড়ে সওয়ার হতে হবে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রশাসনে ঢুকে পড়া দলীয় লোকজন ধীরে ধীরে নীতি নির্ধারক পর্যায়ে চলে গেছে। ফলে প্রশাসনে তাদের প্রভাব যথেষ্ট মজবুত অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে। কিন্তু অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য মাঠের রাজনীতিতে লোকবল প্রয়োজন। এমন কিছু লোক দরকার তাদের, যাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ রয়েছে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে আগ্রহী, সাংগঠনিক গঠনতন্ত্র এমনকি লেবাসেও মিল রয়েছে। আর এ জন্য সর্বক্ষেত্রেই উপযুক্ত হলো হেফাজতে ইসলাম। যদিও হেফাজতের প্রয়াত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি কোনো আগ্রহ না থাকায় তার জীবদ্দশায় হেফাজতকে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। কিন্তু শফী হুজুরের ডেপুটি, তৎকালীন মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী ছিলেন সব সময় রাজনীতির প্রতি আগ্রহী। তারই উস্কানিতে ৫ মে শাপলা চত্বরে জড়ো হয় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। যাতে আল্লামা শফীর কোনো মত ছিল না, এটা কিছুদিন আগেই ফোনালাপে স্বীকার করেন শফীপুত্র আনাস মাদানী।
তিনি জানিয়ে দেন, বাবুনগরীর কারণেই হেফাজত বদনামের ভাগীদার হয়েছে। ফোনালাপটি ফাঁসের পরই মূলত হেফাজতের ভাঙন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক'দিন পরই হাটহাজারী মাদ্রাসার দখল নেয় বাবুনগরী গোষ্ঠী। আর এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল জামাত-শিবির। হাটহাজারী মাদ্রাসা ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িতদের বড় অংশটাই ছিল চট্টগ্রামের ফটিকছড়িসহ বিভিন্ন এলাকার জামাত-শিবিরের কর্মী। নিজের প্রিয় কর্মস্থলে এই তাণ্ডব দেখে সহ্য করতে পারেননি আহমদ শফী, এর পরের ঘটনা সবারই জানা। শাহ শফীর মৃত্যুর পেছনে দায়ী বাবুনগরী গং এবং জামায়াত শিবিরের সন্ত্রাসী বাহিনী। ১৯৮৫ সাল থেকেই হেফাজতের নিয়ন্ত্রণ এবং আল্লামা শফীকে হত্যা করার জন্য কয়েক দফা চেষ্টা করে আসছিল জামায়াত শিবির, সেটা ২০২০ সালে এসে সফলকাম হয়।
গত বছরের ২১ অগাস্ট ফটিকছড়িতে জুনাইদ বাবুনগরীর মাদ্রাসায় গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কক্সবাজার-২ আসনের জামায়াত দলীয় সাবেক এমপি ও জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জুনাইদ বাবুনগরীর মামা হেফাজতের তৎকালীন নায়েবে আমীর আল্লামা মহিবুল্লাহ বাবুনগরীকে হেফাজতের আমীর বানানোর প্রস্তাব রাখেন জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আযাদ। এ বছরের শুরুতে বিতর্কিত বৌদ্ধ ভিক্ষু রকি বড়ুয়ার বাড়িতে সাঈদীপুত্র মাসুদ সাঈদী ও সরকারবিরোধী উগ্র বক্তা হিসেবে পরিচিত তারেক মনোয়ারের সাথে বাবুনগরীর গোপন বৈঠক হয়েছে।
এ নিয়ে গত ২ ফেব্রুয়ারি গোপন প্রতিবেদন দেয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এতে উল্লেখ করা হয়, সাতকানিয়ায় সাঈদীপুত্র মাসুদ সাঈদী ও তারেক মনোয়ার এবং ফটিকছড়িতে জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আযাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছেন ও জামায়াতের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা গ্রহণ করেছেন জুনাইদ বাবুনগরী। ফলে জুনাইদ বাবুনগরী সরকারবিরোধী উস্কানি, মদদ দিতে সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা চালাবেন বলে প্রতিয়মান হয়। আল্লামা শাহ আহমদ শফী অসুস্থ থাকায় জুনাইদ বাবুনগরী নানা ধরনের কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে গত ১৬ মে সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত হাটহাজারী ওলামা পরিষদের নেতৃবৃন্দ বাবুনগরীর সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে চট্টগ্রাম বিএনপি নেতা মীর নাছিরের চাচাতো ভাই মীর ইদ্রিস, মাওলানা জাফর, মাওলানা সাইফুল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আহমদ শফীর মৃত্যুর মাধ্যমে তাদের সকল ষড়যন্ত্র সফল হয়। জামাত-শিবির নিয়ন্ত্রিত জুনাইদ বাবুনগরী পক্ষ এখন হেফাজতের দখল নিতে সমর্থ হয়েছে পুরোপুরি। আমিরও নির্বাচিত হয়েছেন ইতিপূর্বে ৩ ভোট পাওয়া বাবুনগরী। জামাতের জন্য মুশকিল আছান হয়ে গেছে সব কিছু। মাঠে নামানোর জন্য তৈরি বিপুল সংখ্যক কর্মীবাহিনী। যাদেরকে ধর্মের নামে যেকোনও কিছু করানো সম্ভব। যাদেরকে সামনের কাতারে রেখে, তাদের কাঁধে বন্দুক রেখে যে কোনো কিছু করতে সক্ষম জামায়াতে ইসলামী। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো কওমী গোষ্ঠীর হাজার হাজার মাদ্রাসা এরই মাধ্যমে জামায়াতের দখলে চলে এসেছে। জামায়াত শিবিরের বহু নেতাকর্মী নাশকতা মামলায় পলাতক, অনেকে জেলে। সেই অভাব পূরণ করছে কওমি গোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী। এদেরকে উস্কে দিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামিয়ে দেওয়া জামাত-শিবিরের জন্য কোনও ব্যাপারই না।
উগ্রপন্থী আরেকটি গোষ্ঠী হলো চরমোনাই পক্ষ। বর্তমান গদিনশীন পীর চরমোনাই হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সৈয়দ রেজাউল করিম। ইসলামী শাসনতন্ত্র সংগঠনের নাম হলেও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ইসলামী আন্দোলন হিসেবে। দক্ষিণাঞ্চলের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে বেশ বড় একটা সমর্থকগোষ্ঠী আছে দলটির। একইসাথে খেলাফত মজলিসের (বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের একটি দল) মহাসচিব এবং হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন ২০১৩ সালে সহিংসতার দায়ে গ্রেপ্তার মামুনুল হক। প্রায়ই একে তাকে 'নাস্তিক', 'কাফের' 'ধর্ম অবমাননাকারী' আখ্যা দিয়ে ইউটিউব গরম করে ডলার উপার্জন এবং একটা বড় সংখ্যক উগ্র ভক্তশ্রোতা শ্রেণি তৈরী করেছেন ইতিমধ্যে। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ধোলাইরপাড়ে মাঠ গরম বক্তৃতা ফ্রন্টলাইনে নিয়ে আসে একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে এবং পাকিস্তানের পক্ষে অংশ নিয়ে স্বীকারোক্তি দেওয়া শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হকের পুত্র মামুনুল হককে।
হেফাজতে ইসলামের ভাঙন সত্ত্বেও রাজনৈতিক অভিলাষের কারণে ধীরে ধীরে বাবুনগরীর অংশটি শক্তি সঞ্চয় করছে। সমর্থক, কর্মীরাও তাদের সাথে যুক্ত হচ্ছে। অরাজনৈতিক সংগঠনের খোলস ভেঙে রাজনৈতিক ক্ষমতাই তাদের বর্তমান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এসবের পেছনে ইন্ধন জোগাচ্ছে জামাত-শিবির। সাথে আছে চরমোনাইর রেজাউল করিম গং, সাথে আছে হেফাজত-খেলাফতের মামুনুল গং এবং অন্যান্য।
এসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে বর্তমানে পেছন থেকে সমর্থন দেওয়া থেকে শুরু করে পরিকল্পনা- পুরোটাই জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে। দেশটাকে অস্থিতিশীল করে তোলা, ধর্মকে পুঁজি করে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, সরকারের চলমান উন্নয়নশীল কর্মকাণ্ডগুলোকে ব্যাহত করা, দেশে নিরাপদ বৈদেশিক বিনোয়াগ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোকে বিনষ্ট করাসহ নানামুখী চাপ প্রয়োগ করে সরকারকে পর্যুদস্ত করার এক 'বিগ গেইম' চলমান, এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
দেশে হুট করে ধর্মভীরু জনতার সংখ্যা বেড়ে গেছে, বিষয়টা তেমন নয়। বরং মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের ট্রিগার টেনে তৈরি করা হচ্ছে অস্থিতিশীলতা। লালমনিরহাটে ধর্ম অবমাননার গুজব তুলে পিটিয়ে হত্যা করে আগুনে শিক্ষক জুয়েলকে পোড়ানোর ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, এটাও 'পার্ট অব দ্য গেইম'। এখানেও মিলেছে জামায়াত সংশ্লিষ্টতা। জনস্বাস্থ্যের পরিচালকের হুট করে টাকনুর ওপর প্যান্ট এবং হিজাব পরার নোটিশ জারি করাও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। সরকারি চাকরি বিধিমালা, হাইকোর্টের পোশাক স্বাধীনতা বিষয়ক নির্দেশনা এবং সর্বোপরি সংবিধান লঙ্ঘনকারী এমন একটি নোটিশ জারি করার পর অনুমিতই ছিল এরপর কী ঘটতে পারে।
সরকার এ নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের পর উল্টো সমালোচনার শিকার হয়। সরকারকে ইসলামবিরোধী একটি ট্যাগ দেওয়া গেছে এতে করে। নোটিশ জারি করা সেই পরিচালকও ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজ শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক। সম্প্রতি সাকিব আল হাসানের ঘটনাটাও ধরি। সাকিব কলকাতায় পূজায় নিমন্ত্রিত হয়ে গেছে, সেটাকে কেন্দ্র করে টুকর বাজার ইউনিয়ন ছাত্রদলের আহ্বায়ক মহসিন তালুকদার বিশাল এক চাপাতি নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে হুমকি দিলো ধর্মের দোহাই দিয়ে, তাকে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের থেকে দেখে শেখার সবকও দিল মহসিন। ঢাকায় গিয়ে কোপানোর হুমকি দেওয়ার পর সাকিব জাতির উদ্দেশ্যে মাফ চাইতে বাধ্য হলেন। পূজায় কি ইতিপূর্বে বিএনপি আওয়ামী লীগের নেতা বা অন্য কোনো সাধারণ মুসলমান অংশ নেয়নি ইতিপূর্বে? কিন্তু কেন এই হুমকি ধর্মের দোহাই দিয়ে? একটা অদ্ভূত দৃশ্য দেখা গেল, সাধারণ মুসলিমরা জিহাদি জোশে উত্তেজিত হয়ে ব্যাপক সমর্থন দিল সেই জঙ্গি মহসিনকে। উদ্দেশ্য সফল, দেশে ইসলাম ধর্মের এক নবজাগরণ যেন দেখা গেল। আসলেই কি ইসলামের জাগরণ হলো নাকি ধর্মান্ধতার জয়জয়কার? দুইয়ে দুইয়ে কি চার মেলানো যাচ্ছে?
এত সূক্ষ্মভাবে ধর্মের গুটি দিয়ে পুরো রাজনৈতিক চাল চালছে চিহ্নিত এই গোষ্ঠী, খেলায় অংশ নিলেও বিপদ, না নিলেও। যেন শাঁখের করাত। ধর্মের এই সর্বগ্রাসী দানবের হাত থেকে বাঁচার উপায় কী? অনেকের সাথে কথা হয়। নানাজনে নানা মত দিচ্ছেন। কেউ বলছেন মোবাইলে ইন্টারনেট বা ফেইসবুক বন্ধ করে দিলে ধর্মীয় বিষবাষ্প ছড়ানোর সুযোগ কমে যাবে। কিন্তু এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে এটা কি সম্ভব? বা এভাবে কি বন্ধ করে দেওয়া সমাধান?
কেউ কেউ একটা ভালো পরামর্শ দিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প এবং উগ্রতা ছড়ানো হয় বিভিন্ন পত্র পত্রিকার ফেইসবুক পেজের কমেন্ট সেকশনে। এটা বন্ধ করে দেওয়া অথবা কঠিনভাবে মডারেশন করা। এর মাধ্যমে কোনো সংবাদ বা কারো মতামতকে কেন্দ্র করে মিথ্যাচার, উগ্রতা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা, ঘৃণাবাদ ছড়ানোর রাস্তা একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব। তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা নিজের ওয়ালের চাইতে বেশি ঘৃণাবাদ ও উগ্রতা ছড়ায় সংবাদ মাধ্যমের কমেন্ট সেকশনে গিয়ে। আর সেখানে হাজারো মন্তব্যের ভিড়ে কাউকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজার মত দুরূহ ব্যাপার। তাই সংবাদমাধ্যমগুলো চাইলেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঠেকাতে পারে।
আরও একটি কাজ করা যায় চাইলে। তথাকথিত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক উগ্রবাদী দলগুলো এবং ওয়াজের ধর্মব্যবসায়ীদের ঘৃণাবাদী বক্তব্য জনগণের সামনে তুলে ধরার গুরুদায়িত্বটা বন্ধ করে দিতে পারে টিভি চ্যানেল এবং সংবাদমাধ্যমগুলো। এ বিষয়ে নিজেদেরকে রাষ্ট্রের প্রতি কিছুটা দায়বদ্ধ ভাবলে এবং তদনুরূপ দায়িত্ব নিলে সহজেই দেশটাকে অস্থিতিশীল হওয়ার হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করা যায়। উগ্রবাদীদেরকে মিডিয়া কাভারেজ না দিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে গণমাধ্যমের? তাদের বিষাক্ত কথাগুলো- যা আমরা সবাই জানি ধর্মনিরপেক্ষ এবং সহনশীল মানুষের দেশ বাংলাদেশের জন্য সুখকর নয়, সেই বার্তা গণমাধ্যমে আকর্ষণীয় শিরোনাম আকারে না এলে কি সাংবাদিক সমাজ বেকার হয়ে পড়বে? এখন সময় এসেছে কথাগুলো ভেবে দেখার। তবে সময় খুব বেশি নেই হাতে। দেশটা অকার্যকর হয়ে গেলে এই সাধের গণমাধ্যমও থাকবে না। সবাই জানি, সময় গেলে সাধন হবে না।