Published : 12 Jun 2025, 04:18 PM
প্রযুক্তির অগ্রগতি নিঃসন্দেহে আমাদের জীবনে এনেছে অভাবনীয় সুবিধা—তথ্য এখন হাতের মুঠোয়, যোগাযোগের দূরত্ব মুছে গেছে এবং শিক্ষার সুযোগ আরও বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু এই স্বাচ্ছন্দ্যের আবরণে আড়াল হয়ে যাচ্ছে কিছু গভীরতর উদ্বেগ, বিশেষ করে আমাদের কিশোর-কিশোরীদের জীবন ঘিরে। এক সময় ছিল, বিকেল নামলেই পাড়া-মহল্লা মুখর হয়ে উঠত শিশুদের দৌড়ঝাঁপ, হাসি-ঠাট্টা আর খেলার আওয়াজে—কখনও ঘুড়ি ওড়ানো, কখনও দাড়িয়াবান্ধা কিংবা হাডুডু; মাঠজুড়ে চলত প্রাণপণ ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা। সন্ধে ঘনালেই পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে টেলিভিশনে দেখত নাটক, হেসে উঠত একসাথে, কাঁদতও মাঝে মাঝে। ওই দৃশ্যপট আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
প্রথাগত জীবনের ওই জীবন্ত রঙিন ছবিগুলো এখন যেন ঝাপসা হয়ে গেছে স্মৃতির ধুলোপড়া অ্যালবামে। তার জায়গা দখল করে নিয়েছে নিঃশব্দ, একান্ত, একক এক ভার্চুয়াল জগৎ—যেখানে তরুণ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে পর্দার আলো-ছায়ায়। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, গেমিং কনসোল কিংবা ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউব—এসবের প্রতি নির্ভরতা আমাদের বর্তমান জীবনের বাস্তবতা হয়ে উঠেছে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এই ডিজিটাল নির্ভরতা কি আমাদের শিশু-কিশোরদের আরও বুদ্ধিমান, আধুনিক, যুক্তিনিষ্ঠ করে তুলছে, নাকি তারা হারিয়ে ফেলছে তাদের কৈশোরের স্বাভাবিক ছন্দ, সরল আনন্দ, আর মানসিক স্বস্তির অবলম্বনগুলো? এটাই আজ সময়ের দর্পণে প্রতিফলিত সবচেয়ে জরুরি এক প্রশ্ন—যার উত্তর খোঁজা দরকার, এখনই।
প্রযুক্তি আসক্তি: বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্নতা
সম্প্রতি ইউনিসেফ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে দিনে গড়ে ৬ ঘণ্টা বা তার বেশি স্ক্রিন টাইম এখন সাধারণ ঘটনা। বাংলাদেশও এই প্রবণতা থেকে আলাদা নয়। ঢাকার কয়েকটি স্কুলে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশ দিনে গড়ে ৫ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিনে কাটায়। এই সময়ের বড় অংশ তারা ব্যয় করছে টিকটক, ফেইসবুক, ইউটিউব বা ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে। দিন দিন তাদের জীবন যেন একটি ভার্চুয়াল আসক্তির মধ্যে বন্দী হয়ে পড়ছে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই স্ক্রিন, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত স্ক্রিন। এই অভ্যাস শুধু সময় নষ্ট করছে না বরং তাদের মানসিক এবং সামাজিক বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলছে। তারা বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, যা তাদের সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব গঠনে বাধা সৃষ্টি করছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম: আত্ম-মূল্যায়নের ভার্চুয়াল ফাঁদ
একসময় কিশোরেরা নিজেদের পরিচয় তৈরি করত বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা, শখের চর্চা কিংবা পারিবারিক সম্পর্কের মাধ্যমে। এখন এই পরিচয় তৈরি হয় ফলোয়ার সংখ্যা, লাইক, রিলস বা স্টোরির রিঅ্যাকশনের ওপর ভিত্তি করে। ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী মেহজাবিন (ছদ্মনাম) ইনস্টাগ্রামে প্রতিদিন কমপক্ষে চারটি পোস্ট দেয়। একবার একটি ছবিতে 'কম লাইক' পাওয়ার পর সে কয়েক দিন ক্লাসে যায়নি। কারণ? ‘আমার মনে হয়েছে আমি সুন্দর না, কারুরই ভালো লাগছে না আমার ছবি,” সে জানায় এক কাউন্সেলিং সেশনে। এ ধরনের আত্ম-মূল্যায়ন ভয়ংকর রকমের আত্ম-সন্দেহ ও মানসিক চাপে ঠেলে দেয় কিশোর-কিশোরীদের। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘পারফেক্ট লাইফ’ দেখানোর এই সংস্কৃতি অনেককে তাদের নিজের জীবনের প্রতি বিরক্ত, হতাশ বা হীনমন্য করে তোলে। নিজেদের সব সময় অন্যের সঙ্গে তুলনা করার প্রবণতা তাদের মধ্যে গভীর হতাশা এবং মানসিক অবসাদের জন্ম দিচ্ছে।
সাইবার বুলিং ও অনলাইন নির্যাতনের বাস্তবতা
আরেকটি উদ্বেগজনক সমস্যা হলো সাইবার বুলিং বা অনলাইন হয়রানি। বাংলাদেশ ইন্টারনেট সেফটি ফাউন্ডেশনের এক জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১২-১৭ বছর বয়সী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে অন্তত ৩৩% কোনো না কোনোভাবে অনলাইন হয়রানির শিকার হয়েছে। এদের বেশিরভাগই মেয়ে, যারা ইনবক্সে অশালীন বার্তা, মন্তব্য বা হুমকির মুখোমুখি হয়। এই হয়রানি অনেক সময় মানসিক অবসাদ, একাকীত্ব এবং আত্মহত্যার প্রবণতা পর্যন্ত বাড়িয়ে তোলে। পরিবার বা বিদ্যালয় থেকে দূরে এই অনলাইন নির্যাতনের প্রতিকার খুঁজে পাওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। সাইবার বুলিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা প্রায়শই নিজেদের গুটিয়ে নেয়, তাদের পড়াশোনা ব্যাহত হয় এবং সামাজিক মেলামেশায় অনীহা দেখা দেয়।
মানসিক স্বাস্থ্য: এক নিঃশব্দ সংকট
বছরখানেক আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বজুড়ে ১০-১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বিষণ্নতা, উদ্বেগ, আত্মহত্যার প্রবণতা—সবকিছুই বাড়ছে কিশোরদের মধ্যে, যার একটি বড় কারণ সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব। বাংলাদেশে এখনও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক ট্যাবু বিদ্যমান। ফলে বহু কিশোর-কিশোরী তাদের সমস্যার কথা বলতেই পারে না। কাউন্সেলিং বা চিকিৎসা তো দূরের কথা, অভিভাবকরা অনেক সময় বিষয়টির গুরুত্বই বুঝতে পারেন না। মানসিক স্বাস্থ্যের এই নীরব সংকট আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেধা ও সম্ভাবনার ওপর এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিচ্ছে।
ভার্চুয়াল ক্লাস ও কোভিডের প্রভাব
করোনা মহামারীর সময় অনলাইন শিক্ষার প্রচলন বাধ্যতামূলকভাবে শুরু হয়। যদিও তখন এটি একটি দরকারি উদ্যোগ ছিল, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এখন স্পষ্ট। অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনার চেয়ে ভিডিও গেম, ইউটিউব বা চ্যাটে বেশি সময় ব্যয় করতে শুরু করে। গবেষণা বলছে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে মনোযোগের ঘাটতি, শারীরিক স্থূলতা, এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। দীর্ঘসময় ঘরে বসে থাকা, সহপাঠীদের থেকে দূরে থাকা এবং ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের ওপর নির্ভরতা তাদের প্রাথমিক সামাজিক দক্ষতাগুলোকেও ক্ষয় করে দিচ্ছে। এতে তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা কমে আসছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য অনুকূল নয়।
প্রযুক্তির ইতিবাচক দিককে অস্বীকার করা যাবে না
তবে প্রযুক্তিকে সম্পূর্ণ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয়। অনেক শিক্ষার্থী ইউটিউব বা অ্যাপসের মাধ্যমে নতুন ভাষা শিখছে, প্রোগ্রামিং বা ডিজাইনিংয়ের মতো দক্ষতা অর্জন করছে, অনলাইনে বই পড়ছে। অর্থাৎ, সঠিক দিকনির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে প্রযুক্তি হতে পারে অসাধারণ একটি উন্নয়নের হাতিয়ার। বিশেষ করে গ্রামীণ বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন শিক্ষা নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তাদের জ্ঞান অর্জনের দিগন্ত খুলে দিচ্ছে এবং তাদের বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী করে তুলছে। কিন্তু এই সুযোগকে ঝুঁকিমুক্ত করতে হলে প্রয়োজন অভিভাবক ও শিক্ষকের সুদৃঢ় অংশগ্রহণ এবং সঠিক দিকনির্দেশনা।
এই জটিল সমস্যার সমাধানে বহু-মাত্রিক পদক্ষেপ প্রয়োজন।
১. পারিবারিক সচেতনতা ও সংলাপ: অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের সঙ্গে প্রযুক্তি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা। তাদের অনলাইনে কী করছে, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, এগুলো জানা জরুরি। নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং যুক্তি ও সহানুভূতির ভিত্তিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে হবে। পারিবারিক পরিবেশে সুস্থ ডিজিটাল অভ্যাস গড়ে তোলার গুরুত্ব অপরিসীম।
২. স্কুল পর্যায়ে ‘ডিজিটাল হেলথ এডুকেশন’: শিক্ষামন্ত্রণালয়ের উচিত স্কুল পর্যায়েই ডিজিটাল স্বাস্থ্যের ওপর একটি বাধ্যতামূলক পাঠ্যক্রম চালু করা, যেখানে শেখানো হবে কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়, অনলাইন নিরাপত্তা কী এবং স্ক্রিন টাইম কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রযুক্তির দায়িত্বশীল ব্যবহারের ধারণা তৈরি করা প্রয়োজন।
৩. অনলাইন নিরাপত্তা আইন বাস্তবায়ন: সাইবার বুলিং ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকলেও বাস্তবায়নে ঘাটতি আছে। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকেও বয়সভিত্তিক কনটেন্ট ফিল্টার, রিপোর্টিং ব্যবস্থা ও মনিটরিং পলিসি জোরদার করতে হবে। কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অনলাইন হয়রানি বন্ধ করা সম্ভব।
৪. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা: স্কুল ও কলেজে প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর নিয়োগ দিতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যকে স্বাস্থ্য শিক্ষার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। অভিভাবকদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
একটি জাতির ভবিষ্যৎ শুধু প্রযুক্তি কিংবা অর্থনৈতিক উন্নয়নে নয়—ওই জাতির প্রজন্মের মানসিক, শারীরিক ও নৈতিক বিকাশেই নিহিত। যদি আমরা আমাদের কিশোরদের প্রযুক্তির সুশীল ব্যবহার শেখাতে ব্যর্থ হই, তবে তারা হয়তো তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হবে, কিন্তু অন্তরে থাকবে শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা আর আত্ম-সন্দেহের গভীর খাদ।
আমরা কি এমন একটি সমাজ চাই, যেখানে তরুণরা বাস্তব বন্ধুত্বের উষ্ণতা ভুলে গিয়ে লাইক আর ফলোয়ারের মরীচিকায় ছুটে চলে? যেখানে কথোপকথন নয়, রাজত্ব করে নিঃশব্দ স্ক্রলিং; সম্পর্ক নয়, গুরুত্ব পায় রিলসের অ্যাকশন ফ্রেম?
সময়ের দাবি এখন ভারসাম্য—একটি প্রযুক্তিবান্ধব, কিন্তু হৃদয়বান সমাজের নির্মাণ। যেখানে শিশুদের হাতে শুধু স্মার্টফোন নয়, থাকবে জিজ্ঞাসা করার সাহস, স্বপ্ন দেখার অবকাশ, এবং বাস্তব জীবনের ছোঁয়া।
এই ভারসাম্য রক্ষায় আমরা যদি এখনই উদ্যোগ না নিই, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হারিয়ে যেতে পারে এক নিঃসঙ্গ, যান্ত্রিক দুনিয়ায়—যেখানে ‘মানুষ’ থাকবে, কিন্তু ‘মানবতা’ হয়তো থাকবে না।
তাই এখনই সময়—পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকার ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত চেষ্টায় গড়ে তোলা একটি এমন সমাজ, যেখানে প্রযুক্তি হবে সহায়ক, আর মানুষ থাকবে কেন্দ্রবিন্দুতে। তাহলেই সম্ভব এক নিরাপদ, সচেতন এবং সজীব আগামী প্রজন্মের জন্য পথ প্রশস্ত করা।