Published : 28 Jun 2025, 07:52 PM
“বাবা তখন মাস্টার্সের ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। ভাষা আন্দোলন চলছে। আন্দোলন দমাতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের একটি মিটিং হয়। সিদ্ধান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করার। সবাই সিদ্ধান্ত নেয় দশজন দশজন করে মিছিল নিয়ে কৌশলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। প্রথম দশজনের মিছিল বের হলে পুলিশ তাদের ভ্যানে তুলে নেয়। এই দশজনের মধ্যে বাবার সঙ্গে ছিলেন ইকবাল আনসারী খান, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রমুখ। এরপরই পুলিশের ওপর ঢিল ছোড়ে ছাত্ররা। ফলে তখনই ফায়ার ওপেন হয়।
বাবাসহ প্রথম দশজনের দলটিকে ওরা প্রথমে লালবাগ থানায় এবং পরে পাঠিয়ে দেয় কারাগারে। খবরটা পায় না কেউ। ওইদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন কয়েকজন। ভাষাশহীদ বরকতের পরনে ছিল সাদা শার্ট আর খাকি প্যান্ট। বাবার পরনেও ছিল একই রঙের শার্ট-প্যান্ট। বর্ণনা শুনে প্রথমে সবাই ভেবে নেয় বাবাই মারা গেছেন।
খবর চলে যায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে। খবরটা শুনেই দাদী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। মার কাছেও খবর আসে, ‘ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে স্বামী মারা গেছেন’। শোকে তিনিও পাথরপ্রায়।
আমার নানা তখন খোঁজ নিতে আসেন ঢাকায়। মারা গেলে ডেডবডি তো থাকবে। কিন্তু তিনি কোনো খোঁজ পান না। এর মধ্যেই কেটে যায় ৪০ দিন। বাবার বন্ধু ও ছাত্রনেতারা জেলের ভেতর চিরকুট দিয়ে কারা কারা অ্যারেস্ট হয়েছেন ওই তালিকা সংগ্রহ করেন। তখনই জানা যায় বাবা মারা যাননি। পরে উকিল ধরে নানাই বাবাকে ছাড়িয়ে আনেন।
ছোটবেলা থেকেই মা এই ঘটনাটি প্রায়ই আমাদের শোনাতেন। ফলে মনের ভেতর বাবার ওই ইতিহাস গেথে আছে। বাবা ভাষাসৈনিক ছিলেন, বাংলা ভাষার জন্য ৪০ দিন জেলও খেটেছেন—ভেবেই গর্বিত ও সাহসী হই। ফলে সকল আন্দোলন-সংগ্রাম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা বাবার মতোই সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছি।”
ভাষাসংগ্রামী আবু জায়েদ শিকদারের সংগ্রামের কাহিনি তুলে ধরে আলাপচারিতা শুরু করেন তারই সন্তান মুক্তিযোদ্ধা নাজমা শাহীন। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন সম্প্রতি অবসরে গিয়েছেন। তার ডাক নাম বেবী। আবু জায়েদ শিকদার ও মেহেরুন্নেছার দ্বিতীয় সন্তান তিনি। বাড়ি কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলার করিকান্দি গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন আজিমপুর স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
স্কুলে থাকতেই ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হন নাজমা। এর অর্ন্তনিহিত কারণটি তিনি তুলে ধরেন যেভাবে, “বাবার এক মামাত ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে পড়তেন। নাম মনিরুল ইসলাম। আমরা ‘মনি চাচা’ বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি।
মনি চাচা দারুণ সুন্দর করে কথা বলতেন। ফলে আমাদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। বাড়িতে এলেই তার পায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়তাম। মনি চাচা তখন মাষ্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, নেতাজি সুভাষ বোসের গল্প শোনতেন। আবার একেকদিন একেকটা বইও দিয়ে যেতেন। আমরা তা গোগ্রাসে পড়তাম।
তখন আমাদের কাছে নায়ক ছিলেন নেতাজি সুভাষ বোস আর মাষ্টারদা সূর্যসেন। প্রীতিলতার মতো হওয়ার স্বপ্নও দেখতাম। প্রীতিলতার সময়টায় কেন জন্মালাম না—এ নিয়েও খুব আফসোস ছিল আমাদের। মূলত এভাবেই দেশাত্ববোধটা তৈরি হয়ে যায়।
আজিমপুর স্কুলে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব তখন দেওয়া হয় বড় বোন লুৎফা হাসিন রোজী আপাকে। তার সঙ্গে যুক্ত থেকেই ছাত্ররাজনীতি শুরু করি। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনেই যাই প্রথম মিছিলে। ওই থেকেই শুরু দেশের জন্য পথে নামা।”
৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা পেয়ে যান নাজমা শাহীনরা। ফলে চলে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি।
কীভাবে?
তার ভাষায়, “ছাত্রলীগ থেকে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়, কলাভবনের ভেতরে। সকালে ছাত্রীদের আর সন্ধ্যায় হতো ছেলেদের ট্রেনিং। পিয়ারো ভাই ও দুদু ভাই ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং করাতেন। প্রথমে ২০-২৫ জন মেয়ে অংশ নিলেও ক্রমে এ সংখ্যাটা বাড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সঙ্গে আমিসহ রোজী আপা, ইকু আপা, ফোরকান আপা, মমতাজ আপা, সাকী আপা, রাশেদা আপা, মতিয়া, নাছিরা আপা, রাবেয়া আপা, শেফালি আপা আর তার বোন প্রমুখ ছিলেন। ২৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মার্চপাস্ট হয় সেখানেও অংশ নিই আমরা। ২৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলে ওই ট্রেনিং।”
নাজমার বাবা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। থাকতেন ফুলার রোডের ১৭ নম্বর চারতলা বিল্ডিংয়ের একতলায়। যা ছিল তৎকালীন ইকবাল হলের সামনেই। ফলে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছ থেকে।
নাজমা শাহীন বললেন যেভাবে, “রাত তখন ১০টা হবে। বাড়ির সামনেই মা-খালারা একসঙ্গে গল্প করছে। বান্ধবী ফ্লোরার সঙ্গে আমিও তখন দোলনা আর স্লিপারে খেলছি। দেখলাম ইকবাল হলের ক্যান্টিনটায় কিছু ছাত্র জড়ো হয়েছে। ওরা আবার দৌড়াদৌড়ি করে চলেও গেল। এর মধ্যে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আহমদ শরীফ দৌড়ে এসে বাবাকে ডাকতে থাকেন। তখন ফুলার রোড পাড়ার সেক্রেটারি ছিলেন বাবা। কী যেন কথা হলো তাদের।
এরপর ইংরেজি বিভাগের মুনিম সাহেবের ছেলেকে তারা পাঠালেন ইকবাল হলে। কোনো ছাত্র যদি সেখানে থেকে থাকে তারা যেন তখনই হল ছেড়ে চলে যায়।
বাবা বেশ চিন্তিত। একটা কাগজে কিছু লিখে তিনি দারোয়ানকে দিয়ে প্রতিটি বাড়িতে পাঠান। লেখা ছিল, ‘গোলাগুলি শুরু হলে কেউ যেন জানালায় উঁকি না দেয়। ঘরের বাতিও যেন না জ্বলে।’
বাসায় বাসায় ওই খবরটা না দিয়েই দারোয়ান চাচা চলে যান তার পরিবারের কাছে। ফলে আর্মি নামার খবরটা অনেকেই জানতে পারেননি।
পরে শুনেছি আহমদ শরীফের ভায়রা ছিলেন ঢাকার তৎকালীন ডিসি (এসডিও)। তিনি থাকতেন ইস্কাটনে। রাতে সেখান থেকেই দেখেন ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক বের হচ্ছে এবং সেগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছে। এ কারণেই ফোন করে আহমদ শরীফকে তিনি সর্তক থাকতে বলেন।
এরপর কী ঘটল?
“বাবা আমাদের বললেন, ‘গুলি শুরু হলে বাতি জ্বালাবে না, জানালা দিয়ে উঁকিও দেবে না কেউ’। কেননা আমাদের দুটি বেডরুমের জানালাই ছিল ইকবাল হলের দিকে। মধ্যরাতে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। গুলির শব্দে লাফিয়ে উঠি।
সবাই ক্রলিং করে মাঝখানের ড্রইং রুমটাতে চলে আসি। সময় দেখার জন্য বাবা একটা ঘড়ি এনে রাখেন। গোলাগুলি তখন বেড়ে যায়। আবার একটু কমেও আসে। এভাবেই চলছিল। পুরো ঘরেই নিস্তব্ধতা। বাবা যে ঘড়িটা এনে রেখেছে তার টিকটিক আওয়াজটাও আমাদের বুকের মধ্যে এসে লাগছিল।
গোলাগুলি তখনও চলছে। ট্রেসার গান দিয়ে ওরা ফায়ার করে। আকাশে বিভিন্ন রঙের আলো দেখা যায়। চারপাশে মানুষের আর্তচিৎকার শুনি আমরা।
এক সময় ফজরের আজান হয়। বাবা বললেন, এখন হয়তো ওরা চলে যাবে। কিন্তু না, দেখা গেল আজানের পর গোলাগুলির মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। দু-একটা বাসায় বাতি জ্বালিয়েছিল কেউ কেউ। তা দেখে আর্মিরা বিল্ডিংয়ের দিকে গুলি ছোড়ে।”
রাত পোহালে কী দেখলেন?
নাজমা বলেন, “ভোরে দেখতে পাই ইকবাল হলের বিভিন্ন রুমে আগুন জ্বলছে। পাকিস্তানি আর্মিরাও হাঁটাচলা করছে। বুঝে গেলাম একটা ভয়াবহ সময় পার করছি আমরা।
দেখলাম আইন বিভাগের কামরুদ্দিন হোসাইনকে পাকিস্তানি আর্মি বাড়ি থেকে ইকবাল হলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ওনাকে নিয়ে কী করে দেখছি। হঠাৎ হল থেকে চিৎকার করে ওঠে চিশতী শাহ হেলালুর রহমান। পাকিস্তানি আর্মি তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী, আজাদ পত্রিকায় পার্টটাইম কাজও করতেন। ভোরে পত্রিকা অফিস থেকে হলে এলেই আর্মির হাতে ধরা পড়েন।
আমাদের বাড়ির দিকে মুখ করে চিৎকার করে তিনি বলেন, ‘রোজী-বেবি আমাকে বাঁচাও’। কিন্তু কিছুই করার ছিল না তখন। পরে চিশতী ভাইয়ের আর কোনো খবর পাইনি। শুনেছি অনেকগুলো ডেডবডি নীলক্ষেত পেট্র্রল পাম্পের কাছে আর্মিরা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। চিশতী ভাইয়ের কথা মনে হলে এখনও খুব কষ্ট পাই।
সকালে অন্যান্য ফ্ল্যাটের সবাই একত্রিত হই। দোতলায় থাকতেন উর্দু বিভাগের অধ্যাপক ড. নাগবি। মার্চের শুরুতেই কোথাও চলে যান তিনি। বাসায় শুধু একজন কাজের ছেলে ছিল। তার সঙ্গে কথা বলে তখন সব পরিবারগুলো ওই বাসাতে থাকে। ধারণা ছিল পাকিস্তানি আর্মি এলে হয়তো ননবেঙ্গলি বাড়িগুলোতে ঢুকবে না।
এদিকে আর্মিরা জিপ নিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের ডা. মোর্তজাকে তুলে নিয়ে যায়। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় ব্রিটিশ কাউন্সিলেও আগুন ধরিয়ে দেয়। গোলাগুলি চলছিল থেমে থেমে। ওই রাতটা কাটে নানা শঙ্কায়। পরদিন সকালে কারফিউ ব্রেক হয়। বাবা বললেন, ‘এখানে আর থাকা যাবে না’।”
কোথায় গেলেন?
নাজমা বলতে থাকেন, “এসএম হল ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাঝ বরাবর একটা রাস্তা ছিল তখন। যেটা দিয়ে ইকবাল হলেও যাওয়া যেত। রাস্তাটি চলে গেছে পলাশীর দিকে। আমরা ফুলার রোডের বাসা থেকে বের হয়ে ওইদিক দিয়ে যাওয়ার সময় আতকে উঠি। দেখি অনেকগুলো ডেডবডি স্তূপ করে মাঠের ভেতর ফেলে রাখা হয়েছে। কতগুলো ডেডবডির নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। বেয়নেট চার্জ করে মারা হয়েছিল তাদের। এ দৃশ্য দেখে বুকের ভেতরটা কেঁদে ওঠে। একটা রিকশা পেয়ে আমরা দ্রুত শেখ সাহেব বাজারের দিকে চলে যাই। পরে আশ্রয় নিই জিনজিরায়।’
পরে সেখান থেকে মুন্সিগঞ্জ হয়ে নাজমারা চলে যান গ্রামের বাড়ি, কুমিল্লার করিকান্দি গ্রামে।
মে মাস তখন। পাকিস্তান আর্মি গ্রামে গ্রামে যাচ্ছে। বড় লঞ্চে নদীতে টহল দিত তারা। মাঝেমধ্যে হানা দিত নদী পাড়ের কোনো গ্রামে। মানুষকে নির্বিচারে হত্যাসহ গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিত। ওদের সহযোগিতা করত শান্তিকমিটির লোকেরা। ফলে গ্রাম তখন অনিরাপদ হয়ে ওঠে। নাজমার বাবা পরিবারকে গ্রাম থেকে ফিরিয়ে আনেন ঢাকায়।
এরপরই পাকিস্তানি সেনারা হানা দেয় তাদের বাড়িতে। নাজমার ভাষায়, “এক দুপুরে একটা আর্মি জিপ আসে। ওরা বাবাকে খুঁজছে। দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে বাবাকে ডাকতে যাই। বাবা ভালো ছবিও আকঁতেন। তার আইডল ছিলেন আইনস্টাইন। আইনস্টাইন পাইপ খাচ্ছে বাবার আঁকা এমন একটি ছবি টাঙ্গানো ছিল ড্রইং রুমে। আইনস্টাইনের চেহারা অনেকটা মিলে যায় আল্লামা ইকবালের সঙ্গে। পাকিস্তানি আর্মিরা ওই ছবি দেখে মনে করল এটা ইকবালেরই ছবি। বাবা ইকবালের ভক্ত এটা ভেবে ওরা বাবার সঙ্গে কিছু কথা বলেই চলে যায়।
আরবি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি কাজ করতেন পাকিস্তানি আর্মিদের পক্ষে। ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। শিক্ষকদের একটা গ্রুপও তখন কাজ করত পাকিস্তানের পক্ষে। ফলে তারা কোনো তথ্য দিলেই শিক্ষকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদউদ্দিন সাহেবকে এক রাতে ধরে নিয়ে যায় আর্মিরা। ফলে নানা শংকার মধ্যে কাটত সময়গুলো।”
বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ এর ট্রেনিং শেষে ওইসময় দুটি গ্রুপ আসে ঢাকায়। একটার নেতৃত্বে ছিলেন কামরুল আলম খান খসরু। তাদের বেইসক্যাম্প ছিল ডেমরাতে। আরেক গ্রুপের নেতৃত্ব দেন মোস্তফা মহসিন মন্টু। তার ক্যাম্প ছিল জিনজিরাতে।
নাজমা বলেন তাদের ট্রেনিংয়ে যাওয়ার ইতিহাসটি, ঠিক এভাবে, “অগাস্ট মাস তখন। রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ হলে আমরা দুই বোনই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা জানাই। স্কুলপড়ুয়া দুটি মেয়ে আমরা। তিনি প্রথমে নিতে রাজি হন না। বলেন, ‘খসরু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে জানাব।’
পরে তিনিই আমাদের নেয়ার পরিকল্পনা করেন। বাবা-মাকে বললে তো যেতে দেবেন না। এক সকালে স্কুল থেকে বৃত্তির টাকা আনার কথা বলে বের হই আমরা।
পলাশীতে অপেক্ষায় ছিলেন রফিকুল ভাই। তার সঙ্গে চলে যাই ডেমরায়, রূপসী গ্রামে। ওখানেই ছিল খসরু ভাইয়ের ক্যাম্পটি। কিন্তু গিয়ে দেখি গোটা গ্রামটা জ্বালিয়ে দিয়েছে আর্মিরা। স্থানীয়রা জানাল, শীতলক্ষ্যা নদীতে পাকিস্তানি আর্মির গানবোট টহল দিত। খসরু ভাইয়ের গ্রুপ গোলাগুলি করে ওদের দুটি গানবোট ডুবিয়ে দেয়। পরে ওরা শক্তি বৃদ্ধি করে রূপসী গ্রামে হানা দিয়ে পুরো গ্রামটাই জ্বালিয়ে দেয়।
লোকমুখে খবর নিয়ে আমরা যাই তারাবো, তারা মিয়ার বাড়িতে। সন্ধ্যার দিকে খবর পেয়ে সেখানে আসেন মুক্তিযোদ্ধারা। আমাদের নিয়ে যায় সাধিপুর গ্রামে। খসরু ভাইয়ের ক্যাম্পটা তখন ওখানেই ছিল। গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গ্রামের একটি অংশ ছেড়ে দিয়েছিল।”
সাধিপুর গ্রামেই নাজমা শাহীনদের কয়েকদিন অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন মুক্তিযোদ্ধা খসরু।
কেমন ছিল সেই ট্রেনিং?
নাজমা বললেন যেভাবে, “স্টেনগান খোলা, লাগানো, পরিষ্কার করা, এসএমজি, এলএমজি-চালানো শেখান তিনি। খড়ের গাদা তৈরি করে সেখানে ফায়ার করতে দিতেন। ওখানে গুলি করলে সাউন্ড হতো না। স্কুলপড়ুয়া দুজন মেয়ে এসেছি রণাঙ্গনে। মনোবল ও সাহস বাড়ানোর প্রশিক্ষণও দেন খসরু ভাই।”
কীভাবে?
“ওখানে একটা কবরস্থান ছিল। একেকজনকে একেকদিন রাতে নিয়ে সেখানে ছেড়ে দিয়ে তিনি বলতেন, ‘এখানেই তোমাকে ডিউটি দিতে হবে। তুমি সেন্ট্রি আজ।’ সেখানেই দাড়িয়েই পাহারা দিয়েছি। রোজী আপা একবার ভয়ে গাছের ওপর উঠে বসেছিল। খসরু ভাই তখন তাকে না পেয়ে চিন্তায় পড়ে যান। এভাবেই আমাদের সাহস ও মনোবল দুটোই বাড়তে থাকে। কিছুদিন পর ক্যাম্পে আসেন ইকো আপা। সেপ্টেম্বরের দিকে বিএলএফ-এর সেকেন্ড ব্যাচের ট্রেনিংয়ের জন্য রিক্রুট হলে তাদের সঙ্গেই চলে যাই ভারতে।”
আগরতলা শ্রীধর ভিলা নামের একটা বাড়িতে প্রথমে রাখা হয় নাজমাদের। এর মধ্যে ছাত্রলীগের আরও মেয়েরা আসতে থাকে। তখন মেয়েদের থাকার জন্য গোলপার্কে একটা বাসা নেয়া হয়। নাজমাসহ মমতাজ, আমেনা সুলতানা বকুল, ফোরকান, ঝিনু, ফরিদা খানম সাকী, লায়লা, রোজী, ইকো প্রমুখ থাকতেন সেখানে।
পরে লেম্বুচোরা ক্যাম্পে তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। খুব সকালে গোলপার্কে আসত একটা মাইক্রোবাস। তাদের নিয়ে যাওয়া হতো ট্রেনিং ক্যাম্পে। এভাবে পনের দিন ট্রেনিং হয় তাদের।
এরপর কী করলেন তারা?
নাজমা বলেন, “একদিন খসরু ভাই ভেতর থেকে আগরতলায় আসেন। কলকাতায় যাচ্ছেন তিনি। তখন সিদ্ধান্ত হলো রোজী আপাও তার সঙ্গে যাবে। মনি চাচার সঙ্গে দেখা করে আবার ফিরে আসবে।
কিন্তু আমি যেতে রাজি হলাম না। মুক্তিযুদ্ধ করতে আসছি দেশের ভেতর যাব। বিএলএফ এর সেকেন্ড ব্যাচের ট্রেনিং তখন শেষ। তারা ভেতরে ঢুকবে। আমিও তাদের সঙ্গী হই।
ঢাকার গ্রুপে মেয়ে ছিলাম আমি একা। গীতশ্রী চৌধুরীও আমার সঙ্গে ট্রেনিং করে। শিবনারায়ন দাসের গ্রুপের সঙ্গে সে চলে যায় কুমিল্লায়। এছাড়া লেম্বুচোরা ক্যাম্পে ট্রেনিং নেয়া আর কোনো নারী ওইসময় দেশের ভেতরে ঢোকেনি। শেষের দিকে সাকী আপা আর লায়লা আপা নোয়াখালির দিক দিয়ে ভেতরে আসেন।”
মর্টার শেলিংয়ের মধ্য দিয়েই বর্ডার পার হয়ে ভেতরে ঢোকে নাজমাদের তিনটি গ্রুপ। গাইড থাকত। পথ দেখিয়ে তারা নিয়ে যেত বিশাল কাফেলাকে। দীঘিরপাড় নামক জায়গায় এসেই দুটি গ্রুপ চলে যায় কুমিল্লার দিকে। নাজমাদের ঢাকার গ্রুপটি আর্মস ও অ্যামুনেশনগুলো নৌকার পাটাতনে লুকিয়ে রওনা হয়। একসময় তারা এসে পৌঁছায় ডেমরার বালিয়াপাড়ায়।
এরপর তাদের যুদ্ধ কীভাবে এগোল?
নাজমার ভাষায়, “বালিয়াপাড়া বাজারের পাশেই ছিল আমাদের ক্যাম্প। অস্ত্র ছিল কালো রঙের স্টেনগান। গ্রেনেডও থাকত। একটা মেয়েকে কীভাবে নিরাপদে রাখতে হবে এটাও তখন মুক্তিযোদ্ধারা জানত।
তখন যুদ্ধটা আর গেরিলা যুদ্ধের মধ্যে থাকল না। সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ওই এলাকায় মুজিব বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, ঢাকা কলেজের আজিজেরও একটা গ্রুপ ছিল। সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি আর্মিকে প্রতিহত করার পরিকল্পনা হয়।
ডেমরার রাস্তার ওপরের দিকে ছিল পাকিস্তানি আর্মি। পাশে গ্রাম ও ধানক্ষেতে অবস্থান নিয়েছিল মুক্তিবাহিনীরা। কথা ছিল কেউ ফায়ার ওপেন করবে না। কিন্তু ফ্রিডম ফাইটারদের গ্রুপ থেকে এক ছেলে আর্মি দেখে ঠিক থাকতে পারে না। আবেগে ফায়ার ওপেন করে দেয় সে। তখনই পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর বাঙ্কার ও অবস্থানটা টের পেয়ে যায়। ফলে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ।
ইন্ডিয়ান আর্মিও তখন সামনে এগোচ্ছিল। ডিসেম্বরের ৬ তারিখ তারা নরসিংদী পর্যন্ত চলে আসে। ডেমরার যুদ্ধের খবর পেয়ে তারা এয়ার অ্যাটাক করে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। ফলে ওরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এভাবেই ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় ডেমরা এলাকা। ওই রণাঙ্গনে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আমিও থাকতে পেরেছি এটা ভেবেই তৃপ্ত হই।’’
মুক্তিযুদ্ধ মানেই একটা শ্রদ্ধার জায়গা, ভালোবাসার জায়গা। কিন্তু সেটাও আমরা ঠিক রাখতে পারিনি বলে মনে করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার ভাষায়, “স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতরই সমস্যা তৈরি হয়। ব্যক্তিস্বার্থে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অতিরঞ্জনও হয়েছে অনেক। মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সুবিধা মিস ইউজ হতেও দেখেছি। অন্তত মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে আমাদের সৎ থাকা উচিত ছিল।”
একাত্তরে দেশ স্বাধীন হয়নি, ওটা ভারতীয় উপনিবেশ হয়েছিল—সম্প্রতি এমন কথাও বলে থাকেন কেউ কেউ। এ নিয়ে দুঃখ করে মুক্তিযোদ্ধা নাজমা শাহীন অকপটে বলেন, “কেউ কেউ যে এভাবে চিন্তা করেছে সেটাই অবাক লাগে। তাহলে স্বাধীনতার এত বছর পর আমরা মুক্তিযুদ্ধটাকে কি অস্বীকারই করছি? নাকি যারা মুক্তিযুদ্ধ চায়নি তারা খুব সফলভাবে তরুণ প্রজন্মের একটি গ্রুপের মধ্যে সেটি এভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
একটা গ্রুপ বলছে, একাত্তরে দেশ স্বাধীন হয় নাই, ওটা ভারতীয় উপনিবেশ হয়েছিল। তারা ২০২৪-এ সেটা স্বাধীন করেছে। এই ব্যাখ্যাটা তো কোনোভাবে মানা যায় না। বরং পাকিস্তানেই আমরা উপনিবেশ হিসেবে ছিলাম। আমাদের সমস্ত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত তখন পাকিস্তান সরকার নিত। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত কি ইন্ডিয়া নিয়েছে কোনোটা। ভারতের ইনফ্লুয়েন্স যদি থেকেও থাকে সেটা হয়তো ব্যক্তিপর্যায়ে ছিল। রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে কোনো ইনফ্লুয়েন্স তো ছিল না কখনো।”
এই যোদ্ধা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্বের ইতিহাস। আমরা তো গর্ব করেই বলি যে, এমন একটা দেশ দেখাও যে দেশ রক্ত দিয়ে, যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। আমরা যুদ্ধ করেছি, রক্ত দিয়েছি, রক্তের বিনিময়ে একটা দেশ পেয়েছি। এখন এ প্রজন্মের কেউ কেউ যা ভাবছে এটা মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন ব্যর্থতা, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যে সরকারগুলো দেশ চালিয়েছে, যারা রাজনীতি করেছে তাদেরও ব্যর্থতা। আর ওই সুযোগেই স্বাধীনতা যারা চাননি তারাই তরুণ প্রজন্মের মাঝে এমন চিন্তার বীজ বপন করেছেন। আর ওই বীজের চারা এখন গাছে রূপ নেয়ার সুয়োগ পেয়েছে। বিষয়টাকে আমি এভাবেই দেখি।”
ইতিহাস বদলানো যায় না। বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গাটিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। এ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ক্ষেত্রে কখনো আপস করবে না—এমনটাই বিশ্বাস মুক্তিযোদ্ধা নাজমা শাহীনের।