Published : 31 May 2025, 07:17 PM
‘যুক্তরাষ্ট্রকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে ইসরায়েল’– কথাটা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রেরই বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ জেফ্রি স্যাকস। ধর্মীয় পরিচয়ে জেফ্রি নিজে একজন ইহুদি। তার মতে আফগানিস্তান-ইরাক থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সিরিয়া পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো সরকার পরিবর্তনে পরিকল্পনাকারী ইসরায়েল আর আমেরিকা সেগুলোর বাস্তবায়নকারী। বর্তমানে গাজায় চলমান গণহত্যা ও ইরানে হামলার পাঁয়তারাও সেই পরিকল্পনারই অংশ। ২০২৪-এ পিয়ার্স মরগ্যানের ‘আনসেন্সরড’ অনুষ্ঠানে এই মানবতাবাদী অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, গত তিরিশ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র নেতানিয়াহুর আদেশ পালন করে চলেছে।
বিশ্বের নৃশংসতম দীর্ঘকালীব্যাপী প্রকাশ্যে সংঘটিত গণহত্যা চলছে গাজায়। তবু এটিকে যুদ্ধ, আত্মরক্ষা ইত্যাদি বলে গণহত্যাকে ঢাকার চেষ্টা করছে পুরো পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠি ও গণমাধ্যম। কিন্তু কেন? কারণ ইসরায়েল হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতার সবচেয়ে সম্মুখবর্তী প্রদর্শনীয় অংশ— এখনকার পশ্চিমা সভ্যতার পথপ্রদর্শক। সেজন্য পশ্চিমা শাসক ও সংবাদমাধ্যমগুলো মিউ মিউ স্বরে গাজার হামলায় আপত্তি করে, কোনো জোর প্রতিবাদ করে না। আর যুক্তরাষ্ট্রতো ইসরায়েলের নির্দেশ পালনকারী মাত্র।
ফল হচ্ছে, বর্তমান এই অবস্থার বিশ্লেষণে মূলধারার পশ্চিম খুবই একপেশে, পক্ষপাতমূলক ও মানবিকবোধহীন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়েরকৃত মামলায় ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলা গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হলেও পশ্চিমা শক্তির ভক্ত বহু রাজনীতিক ও পণ্ডিতই তা স্বীকার করতে নারাজ। তারা সমস্বরে ইসরায়েলের আত্মরক্ষা, হামাস কর্তৃক শিশুদের শিরোচ্ছেদ, হাসপাতালের নিচে সন্ত্রাসের গোপন টানেল ইত্যাদি প্রচার করে চলেছে। অথচ নৃশংসতম উপায়ে শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ গাজার সকল মানুষকে হত্যা ও উচ্ছেদ যে গণহত্যা– এটি তাদের মাথায় ঢুকছে না। হামাস কর্তৃক ইসরায়েলের ১০ জন মানুষ হত্যা করলেই সেটি তাদের ভাষায় নৃশংস গণহত্যা। সেই তারাই আবার ইসরায়েল কর্তৃক হত্যা, নির্যাতন ও উচ্ছেদের মাধ্যেমে সমস্ত গাজা জনশূন্য করে ফেললেও সেটিকে ‘আত্মরক্ষা’ বলছে, গণহত্যা নয়। পশ্চিমা সভ্যতার গৌরববহনকারীরা কি তবে বোধবুদ্ধিহীন, নাকি ষড়যন্ত্রকারী কিংবা অন্ধ?
প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্ব আজ এক ভয়াবহ নৈতিক সংকটে নিপতিত। ফিলিস্তিনের গাজা নিয়ে তাদের মনোভাবে তার প্রতিফলন ঘটছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নটি ইসরায়েলের পক্ষে ইউরোপের ষড়যন্ত্রের শুরু থেকেই ভূরাজনৈতিক প্রশ্নের বাইরেও একটি মানবাধিকারের ও নৈতিকতার প্রশ্ন। এই আরব ভূখণ্ডের স্বাধীনতা যে বর্তমান বিশ্বের একটি অন্যতম নৈতিক প্রশ্ন এ কথা খুব জোরের সঙ্গে বলেছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সম্মানিত নেতাদের একজন ও বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের নায়ক নেলসন মান্ডেলা। তারই কথায়, “ফিলিস্তিন আমাদের কালের সবচেয়ে বড় নৈতিক ইস্যু।” দক্ষিণ আফ্রিকাকে বর্ণবাদ ও উপনিবেশ থেকে মুক্ত করার পর তিনি আরও বলেছিলেন, “ফিলিস্তিনের জনগণ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ নিজেদেরকে মুক্ত মনে করতে পারব না।”
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী (১৯৯৪-৯৯) রনি কাসরিলস এ কথাগুলো বলেছিলেন আলজাজিরায় সেই ২০১৪ সালে ‘গাজা অ্যান্ড দ্য ক্রাইম অব ক্রাইমস’ শীর্ষক লেখায়। ফিলিস্তিনের বুকচিরে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা মহাত্মা গান্ধীর কাছেও একটি নৈতিক সংকট মনে হয়েছে। তার অহিংস আদর্শের চেতনায় রক্তমাখা হিংসাত্মক উপায়ে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পশ্চিমা প্রয়াস অনৈতিক বলে প্রতিভাত হয়েছে। ১৯৩৮ সালে ‘হরিজন’ পত্রিকায় তাই তিনি লিখেছিলেন যে, পরদেশ লুণ্ঠন করে ইহুদিদের বসতি স্থাপনের কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। ইতিহাসে বহুকাল নির্যাতিত ইহুদিদের প্রতি তার সমবেদনা সত্ত্বেও তিনি মনে করেছেন, “ইংল্যান্ড যেভাবে ইংরেজদের, ফ্রান্স যেভাবে ফরাসীদের, ফিলিাস্তিন ঠিক সেভাবেই আরবদের।”
বর্তমানে আরও স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনের আয়নায় ফুটে উঠেছে বস্তুতান্ত্রিক উন্নতিতে আকাশচুম্বী পশ্চিমা সভ্যতার নৈতিক দেউলিয়াপনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই দেউলিয়াপনা লক্ষ করেছিলেন তার সময়েই এবং ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে এ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “প্রত্যহ দেখতে পেলুম— সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারতিরূপে স্বীকার করছে, রিপুর প্রর্বতনায় তারা তাকে কী অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে।” আরও লিখেছিলেন, “পাশ্চাত্য জাতির সভ্যতা-অভিমানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা অসাধ্য হয়েছে। সে তার শক্তিরূপ আমাদের দেখিয়েছে, মুক্তিরূপ দেখাতে পারেনি।” তার আরও সুচিন্তিত তীব্র মন্তব্য, “এমন সময় দেখা গেল, সমস্ত য়ুরোপে বর্বরতা কিরকম নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। এই মানবপীড়নের মহামারী পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত র্পযন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে।”
উদ্ধৃত মন্তব্যসমূহের শেষটি যখন রবীন্দ্রনাথ করেন তখনকার তুলনায় এখনকার পশ্চিমা সভ্যতা কেবল সংকটের গহ্বরে নয়, মুল্যবোধহীনতার চড়ায় আটকে গেছে, হয়ে গেছে ইসরায়েলের ক্রীতদাস। মানবাত্মার অপমান আজ কেবল দিগন্ত থেকে দিগন্তে বাতাস কলুষিত করেনি, গাজায় চলমান গণহত্যায় নৈতিক বোধসম্পন্ন মানুষের দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। রবীন্দ্রনাথ এখন বেঁচে থাকলে ইসরায়েলের হাতে মানবাত্মার এই নিরন্তর অপমানে তার কলম থমকে যেত, বাকরুদ্ধ হতেন তিনি।
ইহুদি সন্তান যুক্তরাষ্ট্রের ভিক্ষু বোধি তাই কমন ড্রিমসে যে প্রবন্ধ লিখেছেন (১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪) তার শিরোনামই যথেষ্ট এটা বুঝতে যে কতটা বাকরুদ্ধ হয়েছেন তিনি এই মার্কিন-ইসরায়েলি যৌথ গণহত্যা কর্মে: ইসরায়েলস গাজা ক্যাম্পেইন ইজ দ্য গ্রেভেস্ট ম্যুরাল ক্রাইসিস অব আওয়ার টাইম– অর্থাৎ ইসরায়েলের গাজা হামলা আমাদের কালের সবচেয়ে বড় নৈতিক সংকট।
নিউ ইয়র্ক সাময়িকীর ইনটেলিজেন্সারে সারাহ জোনস লিখেছেন (গাজা ইজ দ্য ডিফাইনিং ম্যুরাল ইস্যু অব আওয়ার টাইম, “প্রতিদিন গাজার পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে, আর সামান্য ব্যতিক্রম বাদে মার্কিন রাজনৈতিক শক্তি অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ইসরায়েলের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের সম্পর্ক গণহত্যায় কেবল সহযোগিতাকে অতিক্রম করে গেছে তাই নয়। বাইডেনের নেতৃত্বে আমেরিকা হয়েছে সন্ত্রাসের সক্রিয় অংশীদার।
ইউরোপসহ আরও অনেকে এই গণহত্যার নীরব দর্শক ও সেই সুবাদে অংশীদারও। স্পষ্টতই এটি আর কেবল নৈতিক সংকটে নেই এর উত্তরণ কিংবা পতন হয়েছে আরও এক ধাপ: নৈতিক দেউলিয়াপনায়। মূল্যবোধহীন এই বস্তুতান্ত্রিক শক্তিমত্তায় পশ্চিমা শক্তিধররা এখন কী করবে তার দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের কেউ কেউ তাই ঝুঁকছে আরও ভয়ঙ্কর নাৎসিবাদের দিকে আর কেউ কেউ প্রাচ্যের নানা রকমের আধ্যাত্মিকতায় বা নির্বাণ লাভের সাধনায়।
পাশ্চাত্যের মানুষ এখন আর অনাহারে নয়, স্থুলতারোগে আক্রান্ত, দারিদ্র্যে নয়, ধনসম্পদের প্রাচুর্যে ক্লিষ্ট, অভাবে নয়, ধনবৈষম্যে অস্থির, যোগাযোগহীনতায় নয়, মিথ্যা প্রচারণার অন্ধকারে নিমজ্জিত, শান্তি কামনায় নয়, যুদ্ধের আফিমে উন্মাদ। ট্রাম্পের নির্বাচন, নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় টিকে থাকা, ফ্যাসিজম প্রীতির বৈশ্বিক বিস্তার ইসরায়েল-পরিচালিত পাশ্চাত্য সভ্যতার সেই অন্ধকারকেই ইঙ্গিত করে। তবে এই ঢেউ কমবেশি এশিয়াতেও পড়ে।
পাশ্চাত্য সভ্যতার আলোকিত জগৎটাও বিরাট। কিন্তু তার অগ্রগতি মূল্যবোধহীনতার চড়ায় আটকে পড়ে হাঁসফাঁস করছে। ফিলিস্তিনে মার্কিন-ইসরায়েলি গণহত্যা তার সবচেয়ে কুৎসিত দৃশ্যরূপ।
সম্প্রতি জেরুজালেম ডে উপলক্ষে ইহুদি তরুণদের গাজা হত্যাযজ্ঞে উল্লাস দেখে ইসরায়েলের বিরোধী দলীয় নেতা ইয়ার ল্যাপডি একে বলছেনে “ঘৃণা ও বিদ্বেষের উৎসব।” তিনি বলেছেন, এরূপ আচরণ ‘ইহুদি ধর্মের প্রতি অসম্মানজনক ও অপমানসূচক।’
স্পষ্টতই ফিলিস্তিনের মানুষের মুক্তিতেই কেবল পাশ্চাত্যের মানুষের মুক্তি নিহিত— তার নৈতিক সংকটের সমাধান।