Published : 06 Jun 2025, 09:08 PM
মার্কিন গণতন্ত্র তার শক্তিশালী ‘নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের’ ব্যবস্থার জন্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। এই ব্যবস্থা নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতাকে লাগাম টেনে ধরে এবং আইনসভা ও বিচার বিভাগের মাধ্যমে স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করে। তবে, সম্প্রতি ডনাল্ড ট্রাম্প ও ইলন মাস্কের মধ্যে প্রকাশ্যে আসা দ্বন্দ্ব মার্কিন গণতন্ত্রের এক গভীর সীমাবদ্ধতাকে উন্মোচন করেছে। এই ঘটনাপ্রবাহ কেবল দুই প্রভাবশালীর ব্যক্তিত্বের সংঘাত নয়, বরং ধনতান্ত্রিক স্বার্থ কীভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং জনগণের জন্য কল্যাণমূলক উদ্যোগকে পদদলিত করে তার একটি স্পষ্ট চিত্র। বিশেষ করে, বাজেট ও কর সংক্রান্ত একটি নতুন বিল ঘিরে শুরু হওয়া এই বিরোধ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে—যখন ধনী ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্র পরিচালনার অংশ হয়ে ওঠে, তখন রাজনীতি আর জনস্বার্থে পরিচালিত হয় না বরং ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত লাভ-ক্ষতির হিসাব মেনে চলে।
দ্বন্দ্বের সূত্রপাত: মাস্কের বিনিয়োগ, ট্রাম্পের প্রতিদান
ঘটনার সূত্রপাত হয় ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারে ইলন মাস্কের বিপুল অর্থ ব্যয় করার মধ্য দিয়ে। এই বিনিয়োগের ফলস্বরূপ, ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে মাস্ককে তার সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও ক্ষমতা প্রদান করেন। মাস্ক এই ক্ষমতা ব্যবহার করে ‘সরকারের ব্যয় কমানোর’ নামে বিপুল সংখ্যক মানুষের চাকরিচ্যুতি ঘটান, মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি করেন, বিজ্ঞানীদের তহবিল কেড়ে নেন এবং গবেষণায় ব্যাঘাত ঘটান। এর ফলে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে মাস্কের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে তার বৈদ্যুতিক গাড়ি টেসলার ওপর। টেসলার বিক্রি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে সরে আসেন মাস্ক। আপাতদৃষ্টিতে এই অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি হতে পারত। কিন্তু ট্রাম্প যখন বাজেট ও কর বিষয়ক একটি বিল পাস করতে উদ্যোগী হন, যা বিপুল করছাড়ের কারণে সরকারের ঘাটতি আরও বাড়াবে বলে অভিযোগ ওঠে, তখনই মাস্ক পুনরায় সরব হন। তিনি এই বিলের বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি জানান।
বাজেট বিল ঘিরে বিতর্ক: ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি
রিপাবলিকান দলের প্রস্তাবিত বাজেট বিলটি নিয়ে ট্রাম্প ও মাস্ক দুই ভিন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছেন। ট্রাম্প এই বিলকে আখ্যা দিয়েছেন ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ হিসেবে, যদিও তিনি স্বীকার করেছেন যে এতে এমন কিছু দিক আছে যা তাকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করেনি। অন্যদিকে, মাস্ক একে সরাসরি ‘ডেবট স্লেভারি বিল’ এবং ‘ডিসগাস্টিং অ্যাবোমিনেশন’ বলে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন।
মাস্কের অভিযোগ, এই বাজেট বিল ইলেকট্রিক ভেহিকল বা ইভি-এর করছাড় বাতিল করছে, যা তার কোম্পানি টেসলার জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হবে। এছাড়াও তিনি বলেন, এই বিল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ ২.৪ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে। মাস্ক এই বিরোধের প্রসার ঘটিয়ে এক্স (সাবেক টুইটার) প্ল্যাটফর্মে প্রচারণা শুরু করেন এবং স্পষ্ট ভাষায় হুমকি দেন যে, যারা এই বিলের পক্ষে ভোট দেবেন, তাদের পরবর্তী নির্বাচনে পরাজিত করা হবে।
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও সম্পর্কের চরম অবনতি
ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া খুবই কটাক্ষপূর্ণ। তিনি বলেন, মাস্ক ‘ট্রাম্প ডিরেঞ্জমেন্ট সিন্ড্রোম’-এ ভুগছেন এবং ক্ষুব্ধ হয়েছেন কারণ তার কোম্পানি সরকারি ভর্তুকি হারাতে পারে। ট্রাম্প অবশ্য মাস্কের এই বিরোধিতাকে জনগণের ভালোর আড়ালে তার ব্যক্তিগত স্বার্থের সংঘাত হিসেবে চিত্রিত করেন। ট্রাম্পের মতে, মাস্ক এই বিলের বিরোধিতা করছেন কারণ এটি বৈদ্যুতিক গাড়ির করছাড় প্রত্যাহার করবে, যা মাস্কের ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর। ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে আরও লেখেন, “আমাদের বাজেটে অর্থ সাশ্রয়ের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ইলন মাস্কের সরকারি ভর্তুকি ও চুক্তিগুলো বাতিল করা, যা শত শত কোটি ডলার বাঁচাতে পারে।”
এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের এই সম্পর্ক এখন চরম উত্তেজনার দিকে গড়িয়েছে। মাস্ক বলেন, ট্রাম্প তার প্রতি অকৃতজ্ঞ আচরণ করছেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, নির্বাচনে ট্রাম্পকে বিপুল অর্থ সহায়তা না দিলে তিনি হয়তো জিততেই পারতেন না। এমনকি মাস্ক ট্রাম্পকে বিতর্কিত জেফরি এপস্টিন-এর সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগও প্রচার করেছেন—যা এই দ্বন্দ্বকে আরও ব্যক্তিগত করে তোলে। অন্যদিকে, ইলন মাস্ক ট্রাম্পকে ‘অকৃতজ্ঞ’ হিসেবে অভিহিত করেন। মাস্কের যুক্তি, তার বিপুল আর্থিক সমর্থন ছাড়া ট্রাম্পের পক্ষে নির্বাচনে জয়লাভ করা সম্ভব ছিল না। এই দ্বন্দ্ব এতটাই ব্যক্তিগত পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে মাস্ক একপর্যায়ে শিশু যৌন নিপীড়নকারী হিসেবে অভিযুক্ত এপস্টিনের ফাইলে ট্রাম্পের নাম থাকার অভিযোগ তোলেন এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা উচিত বলে এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লেখেন।
ক্ষমতার কেন্দ্রে ধনিক গোষ্ঠীর প্রভাব: একটি স্পষ্ট দৃষ্টান্ত
এই ঘটনাপ্রবাহ মার্কিন গণতন্ত্রে ধনী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রভাবের এক স্পষ্ট দৃষ্টান্ত। ধনী ব্যবসায়ীরা কীভাবে নিজেদের স্বার্থে আইন তৈরি করে এবং রাষ্ট্রীয় ভর্তুকীর অর্থ ব্যয় করে, তা এই ঘটনায় পরিষ্কার। ইলন মাস্ক একদিকে নিজের ব্যবসার জন্য সরকারের কাছ থেকে বিপুল ভর্তুকী ও করছাড় নিচ্ছেন, অন্যদিকে সরকারের ব্যয় কমানোর জন্য ‘জিহাদ’ করছেন। এই ‘ব্যয় কমানোর’ নামে তিনি বিপুল সংখ্যক মানুষের চাকরিচ্যুতি ঘটান, মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি করেন, বিজ্ঞানীদের তহবিল কেড়ে নেন এবং গবেষণায় ব্যাঘাত ঘটান। এর ফলে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে মাস্কের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে তার বৈদ্যুতিক গাড়ি টেসলার ওপর। টেসলার বিক্রি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
অন্যদিকে, ট্রাম্পও একসময় মাস্কের সমর্থন গ্রহণ করে তাকে সরকারি দায়িত্বে বসান, যার মাধ্যমে মাস্ক ব্যয় কমানোর নামে হাজার হাজার মানুষের চাকরি ছাঁটাই করেন এবং নীতিগত সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেন। এখন ওই সম্পর্ক ভেঙে গেলে, ট্রাম্প সেই একই মাস্কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এখানে রাষ্ট্র বা জনতার স্বার্থ কোথাও নেই, সবই ব্যক্তিগত লেনদেনের হিসাব। উভয়ই জনগণের ভালোর কথা বললেও, এটা স্পষ্ট যে এখানে জনগণের স্বার্থের কোনো বিষয় নেই, সবই ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের দ্বন্দ্ব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর গণতন্ত্র বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ বা শক্তির ভারসাম্য রক্ষার যে ব্যবস্থা রয়েছে—তা একপাক্ষিক শাসনের সুযোগ কমিয়ে দেয়। কিন্তু এই ব্যবস্থাও ঠেকাতে পারে না যখন কেউ বিপুল অর্থ ব্যয় করে নির্বাচিত হন এবং ক্ষমতায় গিয়ে ওই বিনিময়ে ব্যবসায়িক সুবিধা দেন।
মার্কিন গণতন্ত্রের মডেল সারা দুনিয়ায় প্রশংসিত
এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে ‘নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের’ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে ধনী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে যাওয়া ঠেকানো যায় না। এটি দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন গণতন্ত্রের এক বড় সীমাবদ্ধতা। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নীতিমালা যে বিভিন্ন বড় কোম্পানির স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়, তা বহু বছর ধরেই সুবিদিত। ইলন মাস্ক এবং ট্রাম্পের মধ্যকার বর্তমান দ্বন্দ্ব আসলে ওই গোপন অর্থনৈতিক লেনদেনের জটিলতা প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে। আগে এসব করপোরেট প্রভাব রাজনৈতিক পর্দার আড়ালে থাকত, আজ তা চলে এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খোলা বাক্য বিনিময়ের রূপে। যদিও এতে কিছু সত্য উন্মোচিত হচ্ছে, তবু এটি গণতন্ত্রের জন্য কোনো ইতিবাচক বার্তা বয়ে আনছে না।
জনগণের স্বার্থে গণতন্ত্র রক্ষা
ট্রাম্প-মাস্ক দ্বন্দ্ব একটি বড় শিক্ষা দেয়—গণতন্ত্র তখনই শক্তিশালী হয়, যখন রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, ধনী ও প্রভাবশালীদের ব্যক্তিগত চাহিদাকে নয়। ব্যবসায়ী নেতারা যখন রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠেন এবং রাষ্ট্রীয় নীতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন, তখন গণতন্ত্র তার অর্থ হারায়, জনগণ হয়ে পড়ে দর্শক।
আমরা যদি সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ গণতন্ত্র চাই, তবে শুধু ভোট দিয়েই দায়িত্ব শেষ করা যাবে না। দরকার রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা, করপোরেট লবির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং নীতিনির্ধারকদের জবাবদিহির একটি কার্যকর ব্যবস্থা। নাহলে ভবিষ্যতের ট্রাম্প-মাস্ক দ্বন্দ্বগুলো কেবল আরও বড় হবে—আর জনগণের ভাগ্য নির্ধারিত হবে ব্যালট নয়, বরং বোর্ডরুম আর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের আলোচনায়।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ট্রাম্প ও মাস্কের মধ্যে যে কোনো সময় ফোনালাপ হতে পারে। পলিটিকো পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, হোয়াইট হাউজ থেকে ট্রাম্পের সহযোগীরা দুজনের মধ্যে এই ফোনালাপের ব্যবস্থা করেছেন।
ট্রাম্প-মাস্ক প্রকাশ্য বিবাদের পর শুক্রবার ফোনালাপের সম্ভাবনা