Published : 27 Apr 2025, 07:26 PM
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের পর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি কে? অনেকে বলবেন, নিশ্চয়ই ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি. ভ্যান্স। যারা এমনটি বলবেন, তাদের জন্য একটি পুরনো গল্প বলি।
প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের সময় তার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড নিক্সন। একবার এক সাংবাদিক প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি জানি, আপনি সর্বেসর্বা, কিন্তু আপনার ভাইস প্রেসিডেন্টের কোনো পরামর্শ বা আইডিয়া কি আপনি কখনো গ্রহণ করেছেন?” আইজেনহাওয়ার কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “আমার তেমন কিছু মনে পড়ছে না। তবে তুমি যদি আমাকে এক সপ্তাহ সময় দাও, তাহলে ভেবে দেখব।”
এই ঘটনাটি হয়তো সত্য। আবার নিছক গল্পও হতে পারে। এটা বলার কারণ হলো, শুধু নিক্সন নন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব ভাইস প্রেসিডেন্টেরই একই দশা। বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি. ভ্যান্সও এর ব্যতিক্রম নন। যুক্তরাষ্ট্রে এটাই রীতি— প্রেসিডেন্ট তার ভাইস প্রেসিডেন্টকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না।
তাহলে কি সেক্রেটারি অফ স্টেট মার্কো রুবিও দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি? না, ট্রাম্প তাকে ‘লিটল রুবিও’ বলে ডাকতেন এবং তাকে তেমন পাত্তা দেন না। আসলে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন এবং তার দ্বিতীয় মেয়াদে যিনি সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, তিনি হলেন ইলন মাস্ক। তিনি শুধু ক্ষমতাধরই নন, ভীতিকরও। গত কয়েক মাসে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মচারীদের জীবন অসহনীয় করে তুলেছেন।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই ইলন মাস্ককে ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’ বা সংক্ষেপে ‘ডজ’ (বাংলায় ‘সরকারি দক্ষতা অর্জন বিভাগ’)-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই বিভাগের কাজ হলো যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের খরচ ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা। বর্তমানে ফেডারেল সরকার বছরে ৬.৭৫ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে। মাস্ক মনে করেন, এই খরচ ২ ট্রিলিয়ন ডলার কমানো সম্ভব। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘ডজ’-কে ২০২৬ সালের জুলাই পর্যন্ত সময় দিয়েছেন।
ইলন মাস্ক ও ট্রাম্প যৌথভাবে ঘোষণা করেছেন, তারা সরকারি অপচয় ও খরচ কমাতে বদ্ধপরিকর। এরই মধ্যে আয়কর বিভাগ, বিচার বিভাগ, ভেটারান্স অ্যাফেয়ার্সসহ বিভিন্ন বিভাগ থেকে হাজার হাজার কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া ৭৭,০০০ ফেডারেল কর্মচারীকে ‘বাই আউট’ বা ক্ষতিপূরণ দিয়ে ছাঁটাই করা হয়েছে।
ট্রাম্প ও মাস্কের একটি বড় টার্গেট হলো ইউএসএআইডি, যার মারফত যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সাহায্য প্রদান করে। ট্রাম্প ইতিমধ্যে এই সংস্থা বন্ধ করার সংকল্প ঘোষণা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের প্রিয় সংস্থাগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্থ; যেমন শিক্ষা বিভাগের গবেষণা অফিস, যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দিয়ে গবেষণা প্রকল্পে সহায়তা করত, তা-ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি চলমান প্রকল্পগুলোতেও নানাভাবে কাটছাঁট করা হয়েছে। ‘কনজিউমার ফিনান্সিয়াল প্রোটেকশন ব্যুরো’, যা সাধারণ মানুষকে লোভী কোম্পানির আগ্রাসন থেকে রক্ষা করত, তাদের কার্যক্রমও কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
মাস্ক শুধু কর্মচারী ছাঁটাইয়ে ক্ষ্যান্ত হননি। তার নেতৃত্বাধীন ‘ডজ’ ঘোষণা করেছে, তারা নতুন কর্মচারী নিয়োগ করবে, যারা হবেন ‘ছোট সরকার গঠনে অসাধারণ বিপ্লবী এবং প্রতি সপ্তাহে ৮০ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারবেন’। সাধারণত, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম আইনে কর্মচারীদের সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করার নিয়ম। ৮০ ঘণ্টা কাজ করানো শ্রম আইনের পরিপন্থী। কিন্তু ট্রাম্প-মাস্কের যুগে কে কাকে আইন শেখাবে?
ইলন মাস্কের ছাঁটাই কার্যক্রম নতুন কিছু নয়। ২০২২ সালে তিনি ৪৪ বিলিয়ন ডলারে সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম ‘টুইটার’ কিনে নেন। কেনার পর তার প্রথম ঘোষণা ছিল, তিনি এর ৮০ শতাংশ কর্মচারীকে ছাঁটাই করবেন। রাতারাতি টুইটারের ৫০ শতাংশ কর্মচারী চাকরি হারান। এতে সমগ্র প্রযুক্তি শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। যদিও গুগল, অ্যাপল, অ্যামাজন, মেটার মতো কোম্পানিগুলো টুইটারের মেধাবী কর্মচারীদের নিয়ে নেয়, তবুও স্থিতিশীলতা ফিরতে সময় লেগেছিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, টুইটারের শেয়ারের বাজারদরের দ্বিগুণ দাম দিয়ে মাস্ক এটি কিনেছিলেন। কারণ, তিনি টুইটারে তার এবং বন্ধু ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চলা প্রচারণা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। পরে তিনি টুইটারের নাম বদলে ‘এক্স’ করেন।
ট্রাম্পের ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’-তে কাজ করতে গিয়ে মাস্ককে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে। তার প্রিয় গাড়ি কোম্পানি টেসলার লাভ গত কয় মাসে বেশ কমেছে। লভ্যাশের ৭১ শতাংশ হারিয়ে ফেলেছে। গত বছরের তুলনায় বিক্রি কমেছে ১৩ শতাংশ। টেসলার শেয়ারের দামও দিন দিন কমে যাচ্ছিল। এরপর মাস্কের চৈতন্য ফিরল। গত সপ্তাহে তাকে শুধু বলতে হলো, ‘আমি এখন থেকে টেসলাকে অনেক বেশি সময় দেব’, সঙ্গে সঙ্গে টেসলার স্টকের দাম ৫ শতাংশ বেড়ে গেল।
দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মগ্রহণ করা ইলন মাস্ক কখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না, কারণ তিনি জন্মসূত্রে আমেরিকান নন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। বিশ বছর আগে, যখন বিদ্যুৎচালিত গাড়িকে পেট্রোলচালিত গাড়ির বিকল্প হিসেবে কেউ ভাবতেই পারত না, তখন মাস্ক ‘টেসলা’ নামে সম্পূর্ণ বিদ্যুৎচালিত গাড়ি বাজারে আনেন। এটি বিশ্বে বৈদ্যুতিক গাড়ির বিপ্লবের সূচনা করে।
টেসলা গাড়ির নামকরণ করা হয়েছে এসি মোটরের উদ্ভাবক বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার নামে। বলা বাহুল্য, টেসলা গাড়িতে এসি মোটর ব্যবহৃত হয়। ডিসি মোটরের উদ্ভাবক টমাস এডিসনের দাপটে নিকোলা টেসলার নাম প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। এডিসন ও টেসলার এসি-ডিসি প্রতিযোগিতা নিয়ে ‘দ্য কারেন্ট ওয়ার’ নামে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। এখন টেসলা বিশ্বব্যাপী একটি পরিচিত নাম। বাংলাদেশের রাস্তায় আমি একটা রিকশা দেখলাম যার পেছনে লেখা ‘টেসলা’।
মাস্কের টেসলা গাড়ি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও আরামদায়ক। আমার ছেলে ফাহিম সালেহ ২০১৮ সালে আমাকে একটি টেসলা গাড়ি কিনে দিয়েছিল। গত সাত বছরে এই গাড়িটি কখনো সার্ভিস স্টেশনে নিতে হয়নি। এতে পেট্রোল, ইঞ্জিন অয়েল, লুব্রিকেন্ট বা রেডিয়েটরের পানির প্রয়োজন হয় না। সাত বছর পরও ইঞ্জিনটি ঝকঝকে নতুন। টেসলা সত্যিই গাড়ি শিল্পে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে।
ইলন মাস্কের আরেকটি বড় অবদান হলো ‘স্পেসএক্স’। এটি মহাকাশ অভিযানে বিপ্লব এনেছে। আগে একটি রকেট কেবল একবার ব্যবহার করা যেত। স্পেসএক্স পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট উদ্ভাবন করে মহাকাশকে আরও সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করেছে। এখন মানুষ ছোট ছোট দলে মহাকাশে ভ্রমণ করছে, ভবিষ্যতে দলে দলে যাবে। মাস্কের ‘স্টারলিঙ্ক’ প্রকল্প পৃথিবীর দুর্গম অঞ্চলেও ইন্টারনেট সংযোগ সহজলভ্য করছে। বাংলাদেশেও স্টারলিঙ্ক সংযোগ আসছে। সুদূর সুবর্ণ দ্বীপ, উড়ির চর কোনো দুর্গম জায়গা আর ইন্টারনেটের বাইরে থাকবে না।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্কের ব্যক্তিগত জীবনও কম চমকপ্রদ নয়। শোনা যায়, ২০২১ সালে তিনি তার বড় বড় ম্যানশন বিক্রি করে টেক্সাসের বোকা চিকায় মাত্র পঞ্চাশ হাজার ডলারে একটি ছোট্ট বাড়ি তৈরি করেন। তিনি বলেছেন, একজন মানুষের এত বড় বাড়ির কী প্রয়োজন? এই চারশ স্কয়ার ফুটের স্টুডিও-টাইপ বাড়িতে রান্নাঘর, বসার ঘর, শোবার ঘর সব একসঙ্গে। বাইরে একটি গ্যারাজে তার টেসলা গাড়ি রাখা হয়। একবার তার মা আসলেন ছেলের বাড়ি বেড়াতে, মা গো ধরলেন দুইদিন ছেলের কাছে থাকবেন। অগত্যা গ্যারাজ থেকে টেসলা বের করে মায়ের জন্য শোবার জায়গা করেন মাস্ক।
তার আজগুবি আচরণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। একবার টেলিভিশনে টেসলা নিয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় তিনি ক্রমাগত গাঁজা সেবন করছিলেন। সম্প্রচারের সময় টেলিভিশনের পর্দা ধোঁয়ায় ঢেকে যায়, মাস্কের মুখ তখন সামান্যই দেখা যাচ্ছিল। পরদিন টেসলার শেয়ারের দামে ধস নামে। তবুও এই ‘অদ্ভুত’ মানুষটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
ইলন মাস্ক বিতর্কিত হলেও বুদ্ধি ও প্রযুক্তিতে অদ্বিতীয়। তার অদ্ভুত চরিত্র এবং অসাধারণ অর্জন একই সঙ্গে ভয় পাইয়ে দেয় এবং মুগ্ধও করে।