Published : 01 Jul 2025, 02:03 AM
সংস্কারের আলাপে নতুন যে বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম হয়ে উঠছে সেটি হলো নির্বাচনি পদ্ধতি। এখন যে পদ্ধতিতে বাংলাদেশে ভোট হয় বা ভোটাররা এখন যেভাবে জাতীয় নির্বাচনে তাদের প্রত্যেকের আসনে একটি নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দেন এবং ভোট গণনা শেষে যিনি সবার চেয়ে বেশি ভোট পান, তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয় এবং কেউ বিজয়ী প্রার্থীর চেয়ে মাত্র এক ভোট কম পেলেও তিনি পরাজিত বলে গণ্য হন—এই পদ্ধতিকে বলা হয় ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি)। অর্থাৎ যিনি বেশি ভোট পাবেন (তিনি যদি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে এক ভোটও বেশি পান) তিনিই জয়ী এবং বাকিরা সবাই পরাজিত।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এই পদ্ধতিতেই ভোট হয় এবং এটিই এখন পর্যন্ত তুলনামূলক জনপ্রিয় পদ্ধতি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—অর্থাৎ এই সময়ের রাজনীতিতে বিএনপির বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো এই প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে সংখ্যানুপাতিক বা প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন সংক্ষেপে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তুলছে। প্রশ্ন হলো, এতদিন যে পদ্ধতিতে যে দেশে নির্বাচন হলো, তার বাইরে গিয়ে এখন নতুন পদ্ধতিতে ভোট হতে হবে কেন? এর মধ্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলো কি বিশেষ সুবিধা নিতে চায় নাকি নির্বাচনি পদ্ধতি পরিবর্তনের এই আলাপের মধ্য দিয়ে কোনো পক্ষ একটি অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায়? তাতেই বা তাদের লাভ কী? সেই লাভ-ক্ষতির অঙ্কের আগে আমরা একটু বিদ্যমান ভোটিং সিস্টেমের দুর্বলতায় চোখ বুলাতে চাই।
কম ভোটের জনপ্রতিনিধি
২০২০ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম মেয়র হয়েছিলেন মোট ভোটারের মাত্র ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ ভোট পেয়ে। আর দক্ষিণে মোট ভোটারের ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে মেয়র হয়েছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস।
নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, উত্তর সিটিতে ভোট পড়েছিল ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং দক্ষিণে ২৯ শতাংশ। তার মানে উত্তরে প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং দক্ষিণে ভোট দেননি প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি। আবার যে সামান্য সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছেন, তাদেরও সবাই আতিক ও তাপসকে ভোট দেননি।
যেহেতু বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেতে হবে তার কোনো সীমারেখা নেই, সেহেতু ১০ শতাংশ ভোটারের ম্যান্ডেট নিয়েও যে কেউ জনপ্রতিনিধি হতে পারেন। একইসঙ্গে এই নির্বাচনকে সাংবিধানিক বা আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করারও সুযোগ নেই। সুতরাং ঢাকা উত্তর সিটিতে আতিকুল ইসলামকে মাত্র ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন মানে বাকি ৮৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং দক্ষিণ সিটিতে ফজলে নূর তাপস মাত্র ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন মানে বাকি ৮২ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন—এমনটি বলার সুযোগ নেই। কারণ ভোট দেওয়া যেমন নাগরিক অধিকার, তেমনি কেউ যদি ভোট না দেন বা দিতে না চান, সেটিও তার অধিকার।
১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৪১ দশমিক ২ শতাংশ, ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৪২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৪১ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ২০০৮ সালে ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ আসন পেয়েছিল ২৩০টি, অথচ ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে বিএনপির আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০টি। ভোটের সংখ্যানুপাতিক বিচারে আসন বণ্টন হলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রায় ৯০টি আসন পাওয়ার কথা ছিল আর আওয়ামী লীগের আসন অনেক কম হতো।
বর্তমান পদ্ধতির আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো, সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়া। যখন সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীই বিজয়ী হন এবং বাকিরা সবাই গৌন, তখন বিজয়ী হওয়ার জন্য সব ধরনের কায়দা-কানুন, অনিয়ম ও অরাজকতা চলে। যখন ব্যক্তির জয়ই এখানে মুখ্য, তখন সমাজের পিছিয়ে পড়া বা প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় না।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন কী?
উপরোক্ত অসুবিধাগুলো বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু আছে। এই পদ্ধতিতে ব্যক্তি নয়, বরং দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। সারা দেশের গণনায় একটি দল যে সংখ্যক ভোট পায়, আনুপাতিক হারে সংসদে সে সেই পরিমাণ আসন পায়। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোটই মূল্যায়ন করা হয় এবং যে দল কম ভোট পায়, সংসদে তাদেরও প্রতিনিধিত্ব থাকে।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে প্রতিটি দলই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি প্রার্থী তালিকা নির্বাচন কমিশনে দেয় এবং তালিকাটি গোপন রাখা হয়। প্রতিটি দল যে পরিমাণ ভোট পায় সেই আলোকে ওই তালিকা থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিনিধি পায়। যেমন, বিদ্যমান ৩০০ আসনের সংসদ নির্বাচনে যদি কোনো দল ১ শতাংশ ভোট পায়, তাহলে আনুপাতিক হারে তারা সংসদে ৩টি আসন পাবে। এরপর প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার গঠনের জন্য মোট প্রাপ্ত ভোটের ৫১ শতাংশ যে দল পাবে তারা সরকার গঠন করবে। কোনো দল এককভাবে ৫১ শতাংশ না পেলে একাধিক দল মিলে জোট গঠন করেও সরকার গঠন করতে পারে। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে ভোটাররা ভোট দেন দলকে, কোনো ব্যক্তিকে নয়। কারণ আনুপাতিক হারে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে গেলে সংসদে ছোট বড় মাঝারি সব দলেরই সদস্য থাকবে। এতে অনেক শক্তিমান প্রার্থী বাদ পড়বেন।
বিদ্যমান এফপিটিপি পদ্ধতিতে ভোট হওয়ায় দলগুলো প্রতিটি আসনে এমন সব প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয় যাদের নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা বেশি; সেটি যেভাবেই হোক। এ কারণে বেছে বেছে শক্তিশালী প্রার্থীদেরই মনোনয়ন দেওয়া হয়। দলে এবং কমিউনিটিতে কার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু, জনগণের সঙ্গে কার যোগাযোগ বেশি, কার শিক্ষাদীক্ষা ও সংস্কৃতি কেমন—এসব বিবেচনায় আসে না। বরং যিনি মেরে-কেটে কিংবা যে করেই হোক নির্বাচনি বৈতরণী পার হয়ে আসতে পারবেন বলে দলের হাইকমান্ড মনে করে—তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়।
যেহেতু এই পদ্ধতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে এক ভোট বেশি পেলেও তিনি জয়ী—সুতরাং এই একটি ভোট বেশি পাওয়ার জন্য তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন এবং নানারকম অপশক্তি প্রয়োগ করেন।
সংখ্যানুপাতিক দাবিতে ঐক্য, কিন্তু উদ্দেশ্য কী?
বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের আলোচনাটি খুব নতুন নয়। বরং অতীতেও অনেক দল এই পদ্ধতির পক্ষে বলেছে। কিন্তু আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আলাপ যত জোরালো হচ্ছে, পিআর পদ্ধতির পক্ষে বিএনপি ছাড়া অন্যান্য বড় দলগুলোর আওয়াজ তত বাড়ছে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং এনসিপি সম্প্রতি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটি সমাবেশে এই পদ্ধতির পক্ষে তাদের অভিন্ন আওয়াজ তুলেছে।
গত ২৯ জুন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে দলটির প্রধান ও চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘দেশের মানুষ এখন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনি ব্যবস্থা চায়। যে দল যত ভোট পাবে, সংসদে তাদের তত আসন থাকতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’ তিনি বলেন, ‘এটি জেনজি প্রজন্মসহ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের যৌক্তিক দাবি। প্রয়োজনে গণভোটের মাধ্যমে এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে হবে।’
অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) নির্বাচনব্যবস্থার পক্ষে জোরালো মতামত ব্যক্ত করেছি। বিশ্বাস করি, এই ব্যবস্থায় জনগণের মতামত সঠিকভাবে প্রতিফলিত হবে। ফ্যাসিবাদী শাসন পুনরায় ফিরে আসার পথও রুদ্ধ হবে।’
মহাসমাবেশে সংহতি জানিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, `পিআর পদ্ধতি ছাড়া কোনো নির্বাচন দেশের মানুষ গ্রহণ করবে না। আপনারা (ইসি) সোজা থাকবেন। এরই মধ্যে পক্ষপাতিত্বের কিছু আলামত দেখতে পেয়েছি। আপনাদের কাছ থেকে কোনো পক্ষপাতিত্ব চাই না। কোনো একটি দলের সঙ্গে আলোচনায় নিরপেক্ষতা ভঙ্গ হয়েছে। একটি দলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন না।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম সমাবেশে অংশ নিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের সংসদে আমরা যদি আসলেই জনগণের প্রতিনিধিত্ব চাই তাহলে আগামীতে এই পিআর নিয়ে আমাদের আরও জোরদার কাজ করতে হবে।’
তার মানে এই সময়ের রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী তিনটি দল এই পদ্ধতির ব্যাপারে একটি ঐকমত্যে পৌঁছেছে। কিন্তু বিএনপির অবস্থান একেবারেই বিপরীত। বরং দলটি মনে করছে, হঠাৎ করে নির্বাচনি পদ্ধতি পরিবর্তনের আওয়াজ তুলে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত এমনকি অনিশ্চিত করে তোলার ষড়যন্ত্র চলছে।
বিএনপির সিনিয়র নেতা আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘এশিয়ার কোন দেশে পিআর পদ্ধতি আছে? আমরা শুনেছি নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় নাকি পিআর পদ্ধতি আছে। সেটাও সম্পূর্ণ পিআর পদ্ধতি নয়। যদি পিআর পদ্ধতি হয় সেখানে তারা দলকে ভোট দেবে কিন্তু তারা জানবে না যে তাদের প্রার্থী কে, কে এমপি হবে। তাহলে তারা কীভাবে সঠিকভাবে ভোট দেবে? ভোট পাবার পর দল সিলেকশন করবে কাকে এমপি বানাবে। তাহলে সেখানে জনগণের প্রতিনিধিত্ব কীভাবে হলো?’
বিএনপির সিনিয়র নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আনুপাতিক নির্বাচন এ দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেখানে প্রযোজ্য, সেখানেও অনেক জটিল অবস্থা। এমন নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আসনের ভোটাররা জানবেন না, কে তাদের এমপি হবেন। এমপিদের কাছে তারা যে যাবেন, নির্ধারিত কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাবেন না।’
এই পদ্ধতির আরেকটি বড় সমালোচনা হলো, আনুপাতিক নির্বাচনে জয়ী সংসদ সদস্যের নির্দিষ্ট এলাকার মানুষকে সেবা করার দায় তৈরি হয় না, অনেক ক্ষেত্রেই তার সে জ্ঞান, লেজিটেমেসি ও এখতিয়ার থাকে না। কারণ তিনি নির্দিষ্ট কোনো স্থানীয় মানুষের প্রতিনিধি নন। এর ফলে দলের অঞ্চলভিত্তিক তথা তৃণমূলে কার্যক্রম দুর্বল হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় এলাকাভিত্তিক প্রার্থী আছে বলেই দলগুলোর এলাকাভিত্তিক বরাদ্দ এবং ব্যক্তি মনোনয়নের দায় আছে। অপরিপক্ক আনুপাতিক নির্বাচনে এ দায় উঠে গেলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উন্নয়ন ও সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হবে।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা
এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে ছোট দলগুলোর সুবিধা বেশি। কেননা তারা যদি এক শতাংশ ভোটও পায়, তারপরও সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। আবার বড় দলগুলোর তাদের প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী সংসদে আসন পাবে। এই পদ্ধতির সুবিধা হলো সমাজের প্রান্তিক মানুষদেরও সংসদে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। সংসদ একদলীয় ক্লাবে পরিণত হয় না। কোনো দল দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে না। ফলে এই পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত বড় দলগুলোর ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
পক্ষান্তরে এও ঠিক যে, আনুপাতিক নির্বাচনে একক দলের আসন সংখ্যা নিরঙ্কুশ হয় না বলে সরকারব্যবস্থা স্থিতিশীল হয় না। অধিকাংশ দেশেই পিআর ব্যবস্থায় কোয়ালিশনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়, যা যখন তখন সরকার পতনের আশঙ্কায় তুলনামূলক দুর্বল সরকার গঠিত হয়। তারা বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
যেসব দেশে স্থানীয় সরকারগুলো শক্তিশালী, সেসব দেশে এই পদ্ধতি একটি ভালো বিকল্প। কেননা কেন্দ্রীয় সরকারে যা কিছুই ঘটুক না কেন, নাগরিকের দৈনন্দিন সেবা পেতে অসুবিধা হয় না।
বাংলাদেশে নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীকের পাশাপাশি অনেক সময় প্রার্থীর নিজস্ব ইমেজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে এখানে এখনই পিআর পদ্ধতি চালু করা হলে সেটি সাধারণ মানুষের বুঝতেই অনেক সময় লাগবে। সাধারণ মানুষ এটা গ্রহণ করবে কি না—তা নিয়েও সংশয় আছে। সুতরাং মানুষের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা তৈরি না করে, মানুষকে আস্থায় না নিয়ে একটি পদ্ধতি চালু করে দেওয়া কল্যাণকর হবে না। তাছাড়া পিআর পদ্ধতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে কী হবে, সেটিও বড় আলোচনা।
এ মুহূর্তে পিআর পদ্ধতি অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা। সম্প্রতি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ভোটের পদ্ধতি না পাল্টিয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে কার্যকর করা উচিত। তিনি বলেন, সংস্কারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আইনের প্রয়োগ। যোগ্য নির্বাচন কমিশন থাকলে রাজনৈতিক সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব বলেও মত দিয়েছেন তিনি।
বিএনপি না মানলে কী হবে?
বর্তমান পদ্ধতিতে এককভাবে নির্বাচন করলে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও এনসিপি খুব বেশি আসন পাবে বলে মনে হয় না। এমনকি এই তিনটি দল এবং অন্যান্য ইসলামি দলগুলো একটি বৃহত্তর জোট করলেও সরকার গঠনের মতো আসন পাবে না। সেক্ষেত্রে পিআর পদ্ধতিতে ভোট হলে সবগুলো দলই কিছু না কিছু ভোট পাবে এবং ভোট প্রাপ্তির হিসাবে সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। মূলত এ কারণেই তারা নির্বাচনি পদ্ধতি পরিবর্তনের কথা বলছে। অন্যদিকে বিএনপি জানে যে, তাদের যে জনভিত্তি, তাতে অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে তারা সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসনের চেয়ে অনেক বেশি আসন পাবে। বরং পিআর পদ্ধতিতে ভোট হলে তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যেতে পারে।
প্রশ্ন হলো, অন্তর্বর্তী সরকার এবং জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি যদি একমত হয় এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিআর পদ্ধতিকে করতে চায়, তাহলে বিএনপি কি সেটি ঠেকাতে পারবে বা এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে বিএনপির অসুবিধা কী? ধরা যাক বিএনপি এই পদ্ধতি মানল না। তাহলে কি সরকার এই পদ্ধতি চালু করতে পারবে?
যারা এখন এই পদ্ধতির পক্ষে বলছে তাদের কেউই এককভাবে কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল না। জামায়াত রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বিএনপির জোটসঙ্গী হিসেবে। ইসলামী আন্দোলন কখনো সরকারে ছিল না। এনসিপির এখনও নিবন্ধনও হয়নি। সুতরাং, যে দলগুলো কোনোদিন সরকারে ছিল না, জনগণের কাছে যারা এককভাবে পরীক্ষিত নয়, তাদের দাবির মুখে দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা বদল করে দেওয়া যায় না। বরং এই মুহূর্তে যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ, ফলে বাকি দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বেশি ভোট আছে যে বিএনপির, তাদের মতামতের বাইরে গিয়ে যে কোনো পদ্ধতি চালু করা হলে সেটি রাজনীতিতে বড় ধরনের সংকটের জন্ম দেবে।
পিআর পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা দুটিই আছে। ধরা যাক এটি খুব ভালো পদ্ধতি। কিন্তু তারপরও দেশের অন্যতম প্রধান দল যদি না চায়, তাহলে সব ছোট দল বা তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ সব দল চাইলেও সরকারের পক্ষে সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা পরিবর্তন একটি বিরাট রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
পরিশেষে, নির্বাচনের পদ্ধতি নয়, বরং এই সময়ের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় আলোচনা হওয়া উচিত নির্বাচনের দিনক্ষণ। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে আশ্বাস ও আভাস রয়েছে, সেই ডেডলাইন ধরেই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে আলোচনা এগিয়ে নেওয়া। মনে রাখতে হবে, কোনো অজুহাত বা উসিলায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি ফেব্রুয়ারিতে রোজা শুরুর আগে করা না যায় তাহলে আগামী বছরের মধ্যে আর নির্বাচনটি হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর যদি দ্রুত একটি অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা না যায়, তাহলে দেশ দীর্ঘমেয়াদে এমন একটি সংকটে হয়তো পড়ে যাবে, যেখান থেকে উত্তরণ খুব সহজ হবে না।