Published : 28 Jun 2025, 09:03 PM
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাইমারি নির্বাচনে চমকপ্রদ জয় পেয়েছেন ৩৩ বছর বয়সী জোহরান মামদানি। তিনি একজন মুসলমান। নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলে পরিচয় দেন। ফিলিস্তিনি সংগ্রামের স্পষ্টভাষী সমর্থকও। তার এই জয়ের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায় কারণ তিনি হারিয়েছেন নিউ ইয়র্ক রাজ্যের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমোকে—যার পিতা মারিও কুওমোও একসময় একই পদে ছিলেন। মামদানির বিজয়ের খবরে যেন সারা আমেরিকার রাজনৈতিক অঙ্গনে ভূকম্পন শুরু হয়েছে। এখন সবাই জিজ্ঞেস করছে—এবার কী ঘটতে চলেছে?
প্রাইমারিতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সিনেটর, কংগ্রেসম্যান বা শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে খুব কমজনই মামদানিকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন। বরং বেশিরভাগই সরাসরি কিংবা ঘুরপথে তার বিরোধিতা করেছেন। আজও দলীয় নেতারা তাকে নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন—তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রার্থীকে হারিয়ে মামদানি জয়ী হয়েছেন, এই অপরাধে যেন এখনও তারা তাকে ‘শাস্তি’ দিচ্ছেন।
এই অবস্থার এক মজার প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাবেক উপদেষ্টা এবং খ্যাতনামা রাজনৈতিক পরামর্শক ও কৌশলবিদ ডেভিড অ্যাক্সেলরড। সাধারণত কৌশলবিদরা বিশ্লেষণ বা বক্তৃতায় কথা বলেন, কিন্তু মামদানির বিজয়ের পর তিনি যা লিখেছেন তা যেন মধুর কবিতায় পরিণত হয়েছে:
‘সিনেটর, কংগ্রেসম্যানরা আসুন
দয়া করে, আহ্বানে কান দিন
দরজায় বাধা দেবেন না
হল অবরোধ করবেন না
কারণ যে আহত হবে
সে হয়তো থেমে যাবে
কিন্তু বাইরে যুদ্ধ তীব্রতর হচ্ছে
গিগগিরই তোমার জানালা কাঁপবে
এবং তোমার দেয়ালে ঝাঁকুনি দেবে
কারণ এখন পরিবর্তন আসছে।’
জোহরান মামদানি সদ্য ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে জয়ী হয়েছেন। যেহেতু অ্যান্ড্রু কুওমো ইতোমধ্যেই পরাজয় স্বীকার করেছেন, তাই ধরে নেওয়া যায় মামদানিই হবেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চূড়ান্ত প্রার্থী। নিউ ইয়র্ক শহরের ভোটের বাস্তবতায় সাধারণত প্রাইমারিতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর জয় মানেই মেয়র পদে তার বিজয়ের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি—কারণ শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারই ডেমোক্র্যাট সমর্থক।
তবে মামদানির ক্ষেত্রে সমীকরণটা এতটা সহজ নয়। কারণ তিনি একজন মুসলমান এবং তার পরিচয় একজন সমাজতন্ত্রী হিসেবে। এই দুটি পরিচয়ই মার্কিন রাজনীতির মূলস্রোতের জন্য চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে প্রাক্তন মেয়র ও ধনকুবের মাইকেল ব্লুমবার্গসহ নিউ ইয়র্কের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মহল, যারা কোনোভাবেই সমাজতন্ত্রী কাউকে মেয়রের আসনে দেখতে চান না।
এছাড়া নিউ ইয়র্ক শহরে বসবাসকারী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইহুদি ভোটার এবং প্রভাবশালী রাজনীতিকদের অবস্থান মামদানির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন—যিনি নিউ ইয়র্কের ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়—এবং সিনেটের ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার, যিনি নিজেও ইহুদি, কেউই চাইবেন না যে ৩৩ বছর বয়সী এক মুসলমান তরুণ নিউ ইয়র্ক শহরের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরের নেতৃত্ব গ্রহণ করুক।
প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পও স্বভাবসিদ্ধ কটাক্ষে মামদানিকে নিশানা করতে ভোলেননি। তার মন্তব্য—‘লোকটা শতভাগ কমিউনিস্ট। আর দেখতে? একেবারে কুৎসিত।’ কিন্তু কে কী বলল, তা নিউ ইয়র্কের জাগ্রত নাগরিকদের খুব একটা স্পর্শ করে না। এই শহরের তরুণরা, যারা এখনও স্বপ্ন দেখে এবং বিবেকের কথা শোনে, তারা লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে—জোহরান মামদানিকে মেয়র বানানোর জন্য। কারণ মামদানি লড়ছেন তাদের জন্যই।
নিউ ইয়র্ক শহরের নাগরিকদের জন্য তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—উচ্চ ভাড়ার যন্ত্রণা কমাবেন, শহরের গণপরিবহন হবে সবার জন্য বিনামূল্যে এবং জনগণের জন্য যে শহর গড়ে তুলবেন সেখানে পরিচালিত সুলভ মূল্যের মুদি দোকান। এই এজেন্ডাকে অনেকে আকাশছোঁয়া বা অলীক বলে ঠাট্টা করেছেন। তবে সেই সব বিদ্রুপ উপেক্ষা করে মামদানি ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে অ্যান্ড্রু কুওমোর মতো হেভিওয়েট প্রার্থীকেও পরাজিত করেছেন।
এখন তার সমর্থকদের বিশ্বাস, আগামী ৪ নভেম্বর চূড়ান্ত ভোটেও মামদানি বিজয়ী হবেন। কারণ শুধু নীতির প্রশ্নে নয়—এই লড়াই এখন একটি প্রজন্মের বিশ্বাস, আশা আর সাহসের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
নভেম্বরে চূড়ান্ত নির্বাচনে মামদানির প্রতিপক্ষ হবেন রিপাবলিকান প্রার্থী কুর্টিস স্লিওয়া এবং নিউ ইয়র্ক সিটির বর্তমান মেয়র এরিক এডামস, যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে জনমত ক্রমেই নেতিবাচক হচ্ছে। অন্যদিকে, অ্যান্ড্রু কুওমো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াইয়ে নামার চিন্তাভাবনা করছেন। কুওমো যদি প্রার্থী হন, ধনকুবের ব্লুমবার্গ, প্রভাবশালী ক্লিনটন দম্পতি, সিনেটর চাক শুমার এবং শক্তিশালী ইহুদি লবি একসঙ্গে কুওমোর মতো কোনো এক প্রার্থীকে সমর্থন জানায় এবং অর্থবলে নির্বাচনি যুদ্ধ চালায়, তবে মামদানির জন্য পরিস্থিতি বেশ কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
বলা যায়, একজোট হওয়া রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণি ও লবিগুলোর সক্রিয় বিরোধিতার মুখে পড়বেন মামদানি। তাদের এই চাপ ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই তাকে জিততে হবে। কাজটা সহজ নয়—তবে অসম্ভবও নয়। কারণ মামদানি ইতোমধ্যেই প্রাইমারিতে কুওমোর মতো প্রবল প্রতিপক্ষকে হারিয়ে প্রমাণ করেছেন—প্রচলিত কাঠামোকে টলিয়ে দেওয়ার শক্তি তার আছে। তার সমর্থকরা বিশ্বাস করেন, নভেম্বরেও তিনি এই অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হবেন।
জোহরান মামদানি একাধারে ভারত ও উগান্ডা–দুই অভিবাসী শিকড়ের সন্তান। সাত বছর বয়সে তিনি উগান্ডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। তার বাবা মাহমুদ মামদানি—উগান্ডার খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, বর্তমানে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক। মা মীরা নায়ার—ভারতীয় বংশোদ্ভূত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা, যিনি অস্কারের জন্য মনোনীতও হয়েছেন। এমন এক পরিবারে বেড়ে ওঠা মামদানির ব্যক্তিত্বেও যুক্ত হয়েছে বুদ্ধিমত্তা, সংবেদনশীলতা ও স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার সাহস।
তিনি ফিলিস্তিনি জনগণের অকপট সমর্থক। ‘ইন্তিফাদা’ আন্দোলনকে তিনি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন, গাজায় চলমান যুদ্ধকে বারবার ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যা দেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বয়কটের আহ্বানও জানান। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরেই নিউইয়র্কে ইহুদি লবির রোষানলে রয়েছেন; শহরের বিভিন্ন জায়গায় তাকে ঘিরে নেতিবাচক প্রচারণা চলছে। মামদানি এসব আক্রমণকে ‘ইসলামোফোবিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
কুওমোর সঙ্গে টেলিভিশন বিতর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি ইসরায়েল সফরে যাবেন কি না। মামদানির জবাব ছিল কূটনৈতিক অথচ সৎ: ‘ইচ্ছা থাকলেও যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ ইসরায়েল এমন কারও ভিসা দেয় না, যারা তাদের বয়কটের পক্ষে কথা বলে।’
উল্লেখযোগ্য, নিউইয়র্কে এক প্রকার অলিখিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে—গভর্নর বা মেয়র প্রার্থীরা নির্বাচনের আগে অন্তত একবার ইসরায়েল সফর করে তাদের প্রতি আনুগত্যের বার্তা দিয়ে আসেন। মামদানির ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সব ইহুদি ভোটার তার বিরোধী। বরং নির্বাচনে মামদানির পক্ষে কাজ করেছে বিপুলসংখ্যক প্রগতিশীল ইহুদি তরুণ, এবং কুওমোর বিরুদ্ধে তাকে সমর্থন দিয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ ইহুদি ভোটার।
নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের এই লড়াইকে জোহরান মামদানি কেবল নিজের নয়, করে তুলেছেন সবার আন্দোলন। শহরের প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে পৌঁছাতে তিনি প্রয়োজনে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু কিংবা বাংলা—যে ভাষাই দরকার, সেই ভাষাতেই কথা বলেছেন, প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশি অভিবাসী ভোটাররা যেন নিজেদের একজন প্রার্থী পেয়ে গেছেন—এই আবেগে অনেকে দিনরাত এক করে কাজ করেছেন। জ্যাকসন হাইটসের রাস্তা, ব্রঙ্কসের স্টার্লিং সুপারশপ কিংবা ব্রুকলিনের চার্লস ম্যাকডোনাল্ডের চায়ের দোকান—যেখানেই কান যায়, কেবল একটাই আলোচনা– ‘মামদানিকে কীভাবে জেতানো যায়?’
ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে জয়লাভের পর মামদানি তার বিজয় ভাষণে কৃতজ্ঞচিত্তে বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলাদেশি আন্টিদের, যারা আমার হয়ে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাজ করে গেছেন।’ নিউ ইয়র্কের নির্বাচনের ইতিহাসে বাংলাদেশিদের এমন সম্পৃক্ততা আগে কখনও দেখা যায়নি।
নভেম্বরে যদি মামদানি মেয়র নির্বাচিত হন, তাহলে সেটি শুধু মুসলমান সমাজের নয়, বাংলাদেশের অভিবাসী জনগণের জন্যও হবে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কারণ, তিনি এমন একজন তরুণ, যিনি কেবল রাজনৈতিক আদর্শেই নয়, মানবিক সংবেদনশীলতা এবং ব্যক্তিত্বেও উজ্জ্বল। তিনি মানুষের সঙ্গে মিশতে জানেন, তাদের কষ্ট বুঝেন, সমাধানের পথ খোঁজেন।
যারা মামদানির রাজনীতি বা সমর্থকদের অনুভব করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, আগামী নির্বাচনে তাদের জন্য বিপদ বাড়বে—এমন সতর্কবার্তা যেন ডেভিড অ্যাক্সেলরড আগেই দিয়ে গেছেন তার সেই কবিতায়:
‘বাইরে যুদ্ধ তীব্রতর হচ্ছে
শীঘ্রই তোমার জানালা কাঁপবে
এবং তোমার দেয়ালে ঝাঁকুনি দেবে
কারণ এখন পরিবর্তন আসছে।’
এই পরিবর্তনের ঢেউ কেবল নিউ ইয়র্ক শহরেই থেমে থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে গোটা আমেরিকায়। মামদানি জিতুন বা হারুন—এই তরঙ্গ আর থামার নয়।