Published : 13 Feb 2024, 06:39 PM
এমনিতেই দেশবাসী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাকাল। অর্থনৈতিক সংকট প্রতিনিয়ত চোখ রাঙাচ্ছে। ওদিকে মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। সেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী থেকে দলত্যাগকারী এবং জাতিগত বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে কখনো সীমান্ত ঘেঁষে মর্টার শেল, কখনো নাফ নদী দিয়ে লাশ ভেসে আসছে। আর চোরা পথে আসছে মিয়ানমার থেকে ভয়ার্ত-আশ্রয়হীন মানুষেরা। এই উত্তেজনা-উৎকণ্ঠার মধ্যেই প্রকৃতিতে এসেছে বসন্ত।
যদিও গ্রামবাংলাজুড়ে এখনো শীতের প্রকোপ চলছে। এলোমেলো দখিনা বাতাসের দাপটও তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না। কোকিলের কুহুধ্বনি? সেও কেবল কল্পনার হাওয়াই মিঠাই। গাছের পাতায় পুরু ধুলা। দূষণের প্রভাবে পাতিকাক, চড়ুই পাখিরাও শহর ছেড়ে পালাবার আয়োজন করছে।
তারপরও অবশ্য কবি আর বাঙালি মধ্যবিত্তের মনে বসন্তের আগমনী গান। আবহাওয়া-বিজ্ঞানে বসন্ত ঋতুটির অস্তিত্বই নেই। আমাদের এখানে চারটে ঋতু। বর্ষা, বর্ষা-পরবর্তী শরৎ, শীত এবং গ্রীষ্ম । আমাদের দেশে শরৎকালের স্বীকৃতি থাকলেও বসন্ত নিরুদ্দেশ! নিরুদ্দেশ, কেন না, বসন্ত যৌবনের চেয়েও ক্ষণস্থায়ী। শীতের দাপট শেষে ধুলাবালিমাখা দখিনা বাতাস বয়ে যাওয়ার সময়টিকেই আমরা বসন্ত বলছি। হিমালয় থেকে আসা উত্তুরে বাতাসে জলীয় বাষ্প কম, শরীর থেকেও সে জল শুষে নিতে পারে। ফলে শীতকালে ঠোঁট ফাটে, ত্বক রুক্ষ হয়ে যায়। আর, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসা দখিনা বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকে, ফলে আরাম বোধ হয়। এই দখিনা বাতাসকেই সংস্কৃতে ‘মলয় সমীরণ’ বলে।
উৎসবপ্রিয় বাঙালির অবশ্য বসন্ত নিয়ে হামলে-পড়া আদিখ্যেতার শেষ নেই। এ সময় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের আছে দোল উৎসব। দোল ছাড়াও এই ষষ্ঠ ঋতুতে সরস্বতী পূজা, ভ্যালেন্টাইন’স ডে, বইমেলা, একুশে ফেব্রুয়ারি, শিবরাত্রি, বিয়ে— এমন অনেক কিছুই ক্যালেন্ডারে জায়গা করে নেয়। ফাল্গুন-চৈত্রের সব চেয়ে বড় শহুরে উৎসবটি অবশ্য ক্যালেন্ডারে লেখা থাকে না। পুরো শহরে ফুটপাথ থেকে বড় বড় দোকানে এবং শপিং মলে তখন ‘স্প্রিং সেল’-এর দামামা। সোয়েটার, জ্যাকেট, ব্লেজারকে এক বছরের জন্য নির্বাসন দিয়ে হাল্কা পোশাকে ফিরে আসা। পোশাকই বসন্তের অন্যতম দিকচিহ্ন। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবর্গের নাগরিকদের জন্য ফ্যাশন ডিজাইনারদের ‘স্প্রিং কালেকশন’-এর হাতছানি। তারাই যে এই বসন্ত-ভ্যালেন্টাইন’স-এর প্রধান খদ্দের। আর আমাদের জীবনে তো এখন বাজার সংস্কৃতির কাছেই সমর্পিত!
তবুও বসন্তের জয়গান গাইতেই হয়! বসন্তের জয়ধ্বজা আসলে এক জায়গায়। হৃদয়ের গোপন স্বেচ্ছাচারী কামনাকে ছাড়পত্র দেয় সে। কালিদাসের ‘ঋতুসংহার’ কাব্যে বসন্ত বর্ণনার প্রথম শ্লোকের অর্থই: ‘প্রিয়ে! রতি-লালসকামীগণের হৃদয় বিদ্ধ করিবার নিমিত্ত, ওই দেখ, প্রবল যোদ্ধার মতো বসন্তকাল উপস্থিত। সুন্দরী, তোমার ন্যায় বসন্তের সবই সুন্দর। ওই দেখো, গাছে গাছে ফুল, জলে জলে পদ্ম এবং অঙ্গনা মাত্রেই আজ কামশরে জর্জরিত।’ সংস্কৃত কবিরা কামকে যে মর্যাদা দিয়েছিলেন, বাঙালি আজও পারল না।
তারপরও তিন সত্যি হলো, বসন্ত এসে গেছে। আর বসন্ত কখনও নেতির কথা বলে না, সে আশার ঋতু। শীতের জীর্ণতা, পাতা ঝরার শেষে কচি সবুজ পাতায় প্রাণের ছন্দ নিয়ে আসে সে। শীতের ঝরা পাতাতেই তো লুকিয়ে থাকে তার আগমনবার্তা। রবীন্দ্রনাথ শীত-বসন্তের এই ভাগটা ধরেছিলেন আরও জটিল ভাবে। বসন্তে নতুন ফুল ফোটে, আবার শুকনো পাতাও ঝরে যায়। ‘বসন্তে কি শুধু কেবল ফোটা ফুলের মেলা রে/দেখিস নে কি শুকনো-পাতা ঝরা-ফুলের খেলা রে।’ ফোটা ফুল ও শুকনো পাতা আমাদের জীবনের একই ডায়ালেকটিকের অঙ্গ। বসন্ত উধাও, কিন্তু কামনাবাসনা আর জীবনের ডায়ালেকটিক আজও রয়ে গেছে! তাইতো বসন্ত নিয়ে আমাদের আলাপ কিংবা বিলাপেরও শেষ নেই।
সত্যি, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’, বসন্ত তো এসে গেছে-ই। আর বসন্ত এলে আমরা বাঙালি মধ্যবিত্তরা একটু উড়ুউড়ু হব না— তাই কী সম্ভব? গরিব মানুষের জন্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ বঞ্চিত মানুষজনের জন্য অবশ্য এই বসন্ত নয়! কিন্তু তাদের নিয়ে আমরা ভাবব কেন? এজন্য মার্কসবাদীরা আছেন, আছেন বুদ্ধিজীবীরা। তা ছাড়া ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?’ তার চেয়ে ঢের ভাল আনন্দ-উৎসবে মেতে থাকা। অকারণ উল্লাসে মেতে থাকা। দিনশেষে নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার আগে জীবনটাকে যতটা রঙিন করা যায়, রঙিন ভাবা যায়!
প্রকৃতিতে লেগেছে ফাগুনের মাতাল হাওয়া। পলাশ, শিমুল গাছে লাগে আগুন রঙের খেলা। চলছে মধুর বসন্তে সাজ সাজ রব। আর এ সাজে মন রাঙিয়ে গুন গুন করে অনেকেই গেয়ে ওঠেন ‘মনেতে ফাগুন এলো..’। বনের নিভৃত কোণে বা মেঠোপথের ধারে কারও দেখার অপেক্ষা না করেই ফুটে উঠেছে আরও নাম না জানা কতো ফুল। এদিনেই অসংখ্য তরুণ-তরুণী বাসন্তী রঙে নিজেদের রাঙিয়ে রাজধানীর রাজপথ, পার্ক, বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরসহ পুরো নগরী সুশোভিত করে তোলে। তরুণীরা গালে আঁকে নানা রঙের বসন্ত বরণ উল্কি, মাথায় ফুলের তাজ। বসন্তের পূর্ণতার এই ছোঁয়া শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নয়, ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর আনাচে কানাচে থাকা সব বাঙালির আবেগি মনে। কোকিলের কুহুতান, দখিনা হাওয়া, ঝরা পাতার শুকনো নূপুরের নিক্বণ, প্রকৃতির মিলন, সবই ঘটে যায় এই বসন্তে।
বসন্ত মানে জড়তাকে ঝেড়ে ফেলা, বসন্ত মানে পূর্ণতা, বসন্ত মানে নতুন প্রাণের কলরব, বসন্ত মানে একে অপরের হাত ধরে হাঁটা। মিলনের ঋতু বসন্তই মনকে সাজায় বাসন্তী রঙে, মানুষকে করে আনমনা। বসন্তের এ সময়ে শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি। গাছে গাছে নতুন পাতা, স্নিগ্ধ সবুজ কচি পাতার ধীর গতিতে বাতাসের সঙ্গে বয়ে চলা জানান দেয় নতুন কিছুর।
পয়লা ফাল্গুন আমাদের শীতের রুক্ষতাকে বিদায় জানিয়ে নবীন বসন্তকে আহ্বান জানায়। বসন্ত যদি শুধু আমাদের ঋতু পরিবর্তনকে মনে করাত, তা হলে বসন্তের মহিমা ক্ষুণ্ণ হত না কিছুই। কিন্তু শুধু এইটুকু পরিচয়ের মাধ্যমে বসন্ত কালের পরিচয় প্রদান করা যায় না। বসন্তকাল আমাদের নতুন ভাবে বাঁচতে সাহায্য করে, নতুন উৎসাহ জোগায় আমাদের অন্তরে। সে জন্যই হৃদয় বলে ওঠে, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে/ ময়ূরের মতো নাচেরে।’
ফাগুন সন্ধ্যায় আকাশে পূর্ণচন্দ্র যখন আলোয় চতুর্দিক উদ্ভাসিত করে তোলে, তখন কার প্রাণ বলে উঠবে না-‘কে রক্ত লাগালে বনে বনে/ ঢেউ জাগালে সমীরণে/ আজ ভুবনের দুয়ার খোলা/ দোল দিয়েছে বনের দোলা/দে দোল দে দোল দে দোল!’
ফাগুন হাওয়ায় মন-প্রাণ শীতল হয়ে ওঠে—আগতপ্রায় গ্রীষ্মের চোখরাঙানিকে ভুলে গিয়ে শান্তিতে হৃদয় ভরাতে ইচ্ছা হয়— ইচ্ছে হয় বলি, ‘ফাগুন হাওয়ায় রঙে রঙে পাগলঝোরা লুকিয়ে ঝরে/ গোলাপ জবা পারুল পলাশ পারিজাতের বুকের পরে।’ আমরা জানি, জীবন সব সময় সুখের নয়। বিবাদ অশান্তি দুঃখ-দুর্দশা সেখানে আছেই। এই সব নিয়েই আমাদের চলতে হয়। কিন্তু দুঃখ-অশান্তির কালিমায় মনে আবৃত রাখলে কি আমাদের জীবন সুচারু রূপে চলবে? না। কারণ জীবন পরিবর্তনশীল। আর বসন্তবরণ বা ফাগুন উৎসবের মধ্যে রয়েছে সেই উৎসাহের বার্তা। যে উৎসব বার্তা দেয় সকল দুঃখ দৈন্য তুচ্ছ হোক, মুছে যাক সব ক্লেদ-কালিমা—জীবন পূর্ণ হোক আনন্দরসে। আমরা আরও প্রত্যাশা করি, আমাদের রাজনীতিতে বসন্ত-বাতাস বয়ে যাক, প্রতিষ্ঠিত হোক গণতান্ত্রিক-সংস্কৃতি, ঘুচে যাক বিদ্বেষ-হানাহানি।
বসন্তে আমরা উদ্বেল হই, উল্লসিত হই। আমাদের মন ভরে উঠে। মন তো ভরবেই, কারণ জীবনে আরও একটা বসন্ত যে আসতে চলেছে! জীবনের পথে চলতে চলতে যত ঝড়ঝঞ্ঝাই আসুক, তবু জীবন বড় সুন্দর— জীবন এক চলমান উৎসব। আমাদের প্রত্যেকেরই যে আকাঙ্ক্ষা-জীবনের প্রতিটি দিন বসন্তের মাধুর্যের মতই চিরকাল আমাদের কাছে ধরা দিক। জীবনের দিনগুলো তো একটা একটা করে ঝরে যাবেই। কিন্তু মন যেন সজীব থাকে। চিরবসন্ত যেন জাগ্রত থাকে মনের মাঝখানে। তাহলেই বড়ো হব, ‘বুড়ো’ হব না। নানারঙের ফুল, প্রজাপতি— এই পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা গানের মধুময় সুর, আকাশে রামধনুর সাত রঙ এক অপূর্ব মায়ায় ঘিরে থাকুক আমাদের। জীবনটা থাক এক মনোরম স্বপ্ন হয়ে। দুঃখ দুর্দশার মাঝেও যেন এই স্বপ্নগুলো জীবন থেকে হারিয়ে না যায়। তাহলেই এই পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে থাকব একটা সুন্দর বাসন্তী মন নিয়ে বাঁচব। সকলকে নিয়ে বাঁচব, সকলের জন্য বাঁচব।