Published : 27 Jun 2025, 11:53 PM
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে দলের নতুন নেতৃত্ব বেছে নিতে যে সম্মেলন ডেকেছিলেন তার বিরোধী নেতারা, সেই অবস্থান থেকে তারা সরে এসেছেন।
এর বদলে পার্টি চেয়ারম্যানকে সম্মেলনের নতুন তারিখ ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের নেতৃত্বাধীন অংশটি।
শনিবারের সম্মেলন স্থগিতের কথা জানিয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপাতত সম্মেলন করছি না, পরে কী করব সেটা আপনাদের জানিয়ে দেওয়া হবে।”
এদিকে সম্মেলনের পাল্টায় জি এম কাদের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে যে মহা সমাবেশ ডেকেছিলেন, সে কর্মসূচিও হচ্ছে না বলে আভাস মিলেছে। তবে পার্টির বিভক্ত নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা রয়েই গেছে।
সাবেক সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দলটি গতবছর আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর থেকেই বেকায়দায় আছে।
পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যের ‘পাপ’ থেকে দলকে মুক্ত করতে এরশাদের ভাই জিএম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর উদ্যোগ নিলে জাতীয় পার্টি আবার ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়ে।
২৮ জুন চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় সম্মেলন দিন ঠিক করেছিলেন জিএম কাদেরর নেতৃত্বাধীন দলটি। কিন্তু শেষমেষ সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়, ওই তারিখে প্রধান উপদেষ্টার কর্মসূচি থাকায় অনুমতি দেওয়া যাবে না।
এরপর জিএম কাদের সম্মেলন স্থগিত করে দেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে জেলা পর্যায়ে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।
বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টি থেকে বের হয়ে যেসব দল গঠিত হয়েছে, তাদের শীর্ষ নেতাদেরও এক মঞ্চে এনে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তারা। সেজন্য এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশের নেতাদের সঙ্গেও তারা যোগাযোগ করেন।
পার্টির কর্মীদের একটি অংশের মধ্যে একটি চালু ধারণা হল, বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনাতে হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জিএম কাদেরের ভূমিকা নিয়ে যেহেতু নানা প্রশ্ন রয়েছে, সেজন্য পার্টির ভেতরে যৌথ নেতৃত্ব সৃষ্টি করে পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে। সেজন্য পুরনো ও নিষ্ক্রিয় নেতাদেরকে যুক্ত করতে হবে।
মূলত ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ তকমা থেকে জাতীয় পার্টিকে বের করে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজনে জোর দিচ্ছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এবিএম রুহুল আমিন তালুকদাররা
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এক সপ্তাহ আগে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, জিএম কাদের একাই সবকিছু করতে চান। এর পরিবর্তন চান তারা।
“মেইন জিনিস হচ্ছে একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র। আমরা পার্টি থেকে সেটা সরাতে চাই। পার্টিতে যদি স্বৈরতন্ত্র থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের কথা বলে তো লাভ নাই।”
জিএম কাদেরকে বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টির নতুন নেতৃত্ব গঠনের একটি প্রক্রিয়া যে শুরু হয়েছে, সেটা তিনিও বুঝতে পারছিলেন।
গত ২০ জুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, “জাতীয় পার্টিকে বাদ দিতে পারছে না। কাজেই জিএম কাদের মাইনাস হয়ে জাতীয় পার্টি– সেটা হল সরকারের পলিসি টু কাম কামিং ইলেকশন। বিএনপি-জামায়াত ওরা আওয়ামী লীগকে থাকতে দেবে না। আর জাতীয় পার্টিকেও বাদ দিতে চাচ্ছিল, কিন্তু যেহেতু পারছে না, সেহেতু জিএম কাদের মাইনাস, সেটা তারা চায়। কাউন্সিল করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিলে লাঙ্গলও পাবে, এটা তারা বলে বেড়াচ্ছে।”
এর মধ্যে বিরোধীদের সম্মেলনের পাল্টায় নিজের শক্তির জানান দিতে ২৮ জুন দলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মহা সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে বসেন জি এম কাদের।
কিন্তু আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারের নেতৃত্বে জ্যেষ্ঠ নেতাদের ওই অংশটি বুধবার সম্মেলনের নতুন তারিখের ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে আসেন।
এক বিবৃতিতে তারা বলেন, “আমরা দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানাই, চেয়ারম্যান যেন অবিলম্বে একগুঁয়েমি ও স্বেচ্ছাচারিতার পথ থেকে সরে এসে দলের প্রতিষ্ঠাতা পল্লিবন্ধুর (এইচ এম এরশাদ) প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অবিলম্বে সম্মেলনের নতুন তারিখ ঘোষণা করেন।”
জাতীয় পার্টির এই অংশের একজন নেতা বলেছেন, পার্টি অফিসে সম্মেলন করার জন্যও তারা প্রশাসনের অনুমতি পাননি। মূলত সে কারণেই তারা অবস্থান বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। এখন তারা জি এম কাদেরকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছেন। দল ভাঙার দায় না নিয়ে তারা নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে চান।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চীন মৈত্রীর বরাদ্দ বাতিলের পর কাকরাইলে কাউন্সিল করার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে তো চেয়ারম্যান মহাসমাবেশ আহ্বান করেছে। সব মিলিয়ে আপাতত সম্মেলন করছি না।”
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে ফোন করা হলে তিনি শামীম হায়দার পাটোয়ারীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
পরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ এই প্রেসিডিয়াম সদস্যকে ফোন করলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, আমরা তো সম্মেলন স্থগিত করেছি। পরে আপনাদের সম্মেলনের তারিখ জানিয়ে দিব। আপাতত কোনো প্রোগ্রামও আমরা করছি না।”
জিএম কাদেরের অনুসারী এক নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাতীয় পার্টিতে কেউ প্ল্যাটফর্ম করে কিছু করতে পারে নাই। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জিএম কাদেরের সঙ্গেই আছে। এর বাইরে কেউ তেমন কিছু করতে পারেনি, এবারও বাইরে গেলে কিছু করতে পারবে না।
“তারপরও পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় জিএম কাদের সম্মেলনের সিদ্ধান্ত থেকে আপাতত সরে এসেছেন, আমরাও সেটায় সায় দিয়েছি। আপাতত সম্মেলন হচ্ছে না এটাই চূড়ান্ত।”
শুক্রবার বিকালে বিজয় নগরে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায় সেখানে সম্মেলন বা মহাসমাবেশ–কোনো ধরনের আয়োজনের প্রস্তুতি নেই।
সেখানে থাকা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক পার্টির আহ্বায়ক হাজী মো. কামাল হোসেন বলেন, “সম্মেলন ডেকেছিল আমাদের দলের কিছু লোকজন। তাদের সম্মেলন এখানে হওয়ার কথা, আমরা এখানে মহাসমাবেশ করব–এমন ঘোষণা এসেছিল। এখন যেহেতু তারা সম্মেলন স্থগিত করেছে, আমাদের সমাবেশও মনে হয় হবে না।"
তার পাশে বসা জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য আনোয়ার হোসেন খান শান্ত বলেন, “তারা যেহেতু (বিরোধীরা) সম্মেলন থেকে পিছু হটেছে, ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারে নাই। আমাদের মহাসমাবেশ নাও হতে পারে।
“তবে আমাদের সকল অঙ্গসগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত থাকবে। তারা (বিরোধীরা) বিভিন্নভাবে আমাদের ব্যবহার করেছে, এখন তারা আবার পদের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে, আমরা তৃণমূল এখন ঐকবদ্ধ, কোনো ষড়যন্ত্র করতে দেওয়া হবে না।"
নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর প্রথমবারের মত ভাঙন ধরে জাতীয় পার্টিতে, ১৯৯৭ সালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফা ভাঙন হয়।
কাজী জাফর ও শাহ মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে, ২০০১ সালে নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে চতুর্থ দফা এবং ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে জাপায় পঞ্চমবারের মত ভাঙ জাতীয় পার্টি।
এরশাদ মারা যাওয়ার পর সবশেষ ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ ভাগ হয়ে যায়।
পুরনো খবর