Published : 10 May 2025, 09:59 PM
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে সংবিধানের প্রস্তাবনা পরিবর্তনের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছে গণফোরাম।
দলটির নেতারা বলছেন, ঐকমত্য কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ দিতে চাচ্ছে’, এটা হতে পারে না। নতুন করে সংবিধান লেখার ‘কোনো সুযোগ নেই’। আর নির্বাচিত সরকার ছাড়া কেউ সংবিধান সংশোধনও করতে পারে না।
জাতীয় সংসদের এলডি হলে শনিবার বিকাল ৩টায় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে গণফোরামের সংলাপ শুরু হয়, শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টার পর। গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে দলটির ১১ সদস্যেরে প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নেন।
সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের সামনে এসে গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য এ কে এম জগলুল হায়দার আফ্রিক বলেন, “উনারা (ঐকমত্য কমিশন) কিন্তু আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা পরিবর্তন করতে চাচ্ছে, একে তারা বলছে সংবিধান নতুন করে লিখতে হবে। আমরা এটার চরমভাবে বিরোধিতা করেছি।
“আরেকটা জিনিস, প্রস্তাবনা পরিবর্তন করা যায় না। তারা আমাদের সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ বাতিল করতে চায়, ১৫০ অনুচ্ছেদে কী আছে? এটা আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।”
জগলুল হায়দার বলেন, “আমাদের পঞ্চম তফসিলে ৭ই মার্চের কথা বলা আছে, ৭ই মার্চ বাদ দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা বিবেচনা করা যায় না। ষষ্ঠ তফসিলে বলা আছে স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতার ঘোষণা আমাদের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে, স্বাধীনতার ঘোষণার জন্যই ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। তারা এই স্বাধীনতার ঘোষণা বাতিল করতে চায়। আমরা এর চরম বিরোধিতা করেছি।”
তিনি বলেন, “তার পরে সপ্তম তফসিলে বলা আছে প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স, ১০ এপ্রিল যে প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়েছে এই প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স দিয়েই, মুক্তিযোদ্ধারা কাজ শুরু করল, যুদ্ধ শুরু করল। প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স বাদ দিলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বাদ দিলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থাকে কোথায়?
“সংবিধান নতুন করে লেখা যাবে না। যে সংবিধান লাখ লাখ শহীদের রক্তের রঞ্জিত, যেই সংবিধান হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছে, সেটাকে নতুন করে লেখা যাবে না। ড. কামাল সাহেবও বলেছে জন আকাঙ্ক্ষার কারণে আমরা সংবিধানের কিছু অংশ সংশোধন করতে পারি। পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু নতুন করে লেখা যায় না “
নির্বাচিত সরকার ছাড়া কেউ সংবিধানের সংশোধন করতে পারবে না দাবি করে জগলুল হায়দার বলেন, “নির্বাচিত সরকার এসে সংবিধানে সংশোধন বা পরিবর্তন করার জন্য যে প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলো কমিশনের কাছে দেবে তা করবে। নির্বাচনের আগে নির্বাচিত সরকার ছাড়া কেউ সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না। সংবিধান সংশোধন ছাড়া তারা জাতীয় সরকার গঠন করতে পারবে না, আর নির্বাচিত সরকার ছাড়া সংবিধানে কিছু করতে পারবে না।
“সংবিধান সংশোধন করতে হলে নির্বাচিত সরকারই লাগবে। এখানে জাতীয় সরকার হলেও হবে না।”
গণফোরাম দুই কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টে বিশ্বাস করে না জানিয়ে তিনি বলেন, “এখানে একটা সাংঘর্ষিক বিষয় থাকতে পারে, সেটা আলোচনা করে হবে। জাতীয় সরকার গঠনের ক্ষেত্রে আমরা কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দিইনি।”
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, “বিদ্যমান সংবিধানের অধীনেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নিয়েছে, ফলে সাংবিধানিক সরকারের অধীনে সরকার পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের সংবিধান সংশোধন করতে হলে আগামীতে যে জাতীয় সংসদ হবে, সেই জাতীয় সংসদ ব্যতিরেকে আমাদের এই সংবিধান সংশোধন করা বর্তমান কাঠামোতে সম্ভব না।
“সেই ক্ষেত্রে আমরা বলেছি যে সমস্ত বিষয়ে অধিকাংশ দল ঐকমত্য পোষণ করতে, সেগুলো আগামী জাতীয় সংসদের জন্য রেখে দেওয়া হবে। সংবিধানের কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে আমরা বলেছি সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা মতামত দিয়েছি, এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে যে পঞ্চদশ সংশোধনীর রায় হয়েছে সেটা কার্যকর করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ১২০ দিন আমরা প্রস্তাব করেছি। আর অর্থবিল এবং আস্থাভোট ছাড়া সব বিষয়ে সংসদ সদস্যরা (দলের সিদ্ধান্তের বাইরে) মতামত দিতে পারবে সেটা বলেছি।”
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে প্রস্তাব দেওয়ার কথা তুলে ধরে মিজানুর রহমান বলেন, “রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমতা সেটা একেবারেই নেই বললেই চলে। এই জন্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য সেটার করার জন্য প্রস্তাব রেখেছি। সরকার প্রধান এবং দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি থাকতে পারবে না। সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী থাকার বিষয়ে আমরা মতামত দিয়েছি। ডেপুটি স্পিকার একজন রাখার প্রস্তাব দিয়েছি, আর সেটা বিরোধী দল থেকে রাখার প্রস্তাব আমরা দিয়েছি।
“সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল আছে, কিন্তু এটা কার্যকর নয়। এ ব্যাপারে আমরা মতামত দিয়েছি। আর সংবিধানের চার মূলনীতি যেটা আছে, সেটা যাতে পরিবর্তন না করা হয়, সেটা আমরা বলেছি। প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ দুইবার থাকার সুযোগের কথা বলেছি। এছাড়া বাংলাদেশের নাম পরিবর্তনে আমরা একমত নই।”
সংস্কার কমিশন ‘অযথা কালক্ষেপণ করছে’ অভিযোগ করে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্য যে কমিশনগুলো আছে, যেসব সংস্কার ‘এক থেকে দুই মাসের মধ্যে’ করা সম্ভব।
“এটাকে দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। এর জন্য আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে সংশয় প্রকাশ করেছি। ঐকমত্য কমিশনকে আমরা বলেছি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের সাথে যেন এই কথা তুলে ধরা হয়।
“কারণ বিচার ব্যবস্থা নিয়ে নানা ধরনের অসঙ্গতি দীর্ঘদিন ধরে আছে। সর্বশেষ এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরে যে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগ করেছে, এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সুতরাং বিচার বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন এই নিয়ে সরকারে কে গেল আর কে না গেল, সেটা নয়, বাংলাদেশে দুদকে যে প্রধান নিয়োগ করা হয়, এটা যে সরকার তার আস্থাভাজন নিয়োগ করা হয়। এই জন্যে দুদককে ঢেলে সাজানো এবং আইনি কাঠামোতে আনার কথা বলেছি। আর নির্বাচন কমিশনকে যদি ঢেলে সাজানো না হয়, তাহলে ভোটের রাজনীতি সুষ্ঠু হবে না। ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া পূর্বের ন্যায় হবে।”
তিনি বলেন, “এর জন্য আমরা বলেছি কালো টাকার ছড়াছড়ি নির্বাচনে বন্ধ রাখতে হবে। রিটার্নিং অফিসার এবং পুলিশ প্রশাসন নির্বাচনে যে অনিয়ম করেছে তার কোনো বিচার পূর্বে করা হয়নি। এমনকি নির্বাচন কমিশনে কোনো বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে আইনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
“সেই জন্যে নির্বাচন কমিশন সংস্কারের সাথে আমাদের কিছু প্রস্তাব যুক্ত করে দিয়েছি। জনগণ যাতে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, এমন প্রস্তাব দিয়েছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কার শেষ করে নির্বাচনে যাওয়ার কথা আমরা বলেছি।“