Published : 14 May 2025, 01:45 AM
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, মৌলিক সংস্কার সেরে এ বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচন সম্ভব, তবে সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে দ্রুত একমত হতে হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এ সদস্যের ভাষায়, “বল এখন মূলত রাজনৈতিক দলের কোর্টে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউট’এ অতিথি হয়ে এসেছিলেন বদিউল আলম মজুমদার।
সেখানে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি তিনি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সংবিধানের ‘ত্রুটি’, ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রয়োজনীয়তা এবং নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন।
মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে দুই ধাপে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনসহ সংশ্লিষ্টরা সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সরকারের কাছে। এরইমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়েছে এবং তাদের সঙ্গে সংলাপ করছে।
সংস্কারের এই ডামাডোলের মধ্যে বড় প্রশ্ন হল, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় গলদটা কোথায়।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় মূল সমস্যা যদি একটা শব্দ দিয়ে বলতে হয়, তা হল আস্থাহীনতা। আস্থাহীনতার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। আমাদের ভোট ব্যবস্থাটাই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। মানুষের যে ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে মানুষকে বঞ্চিত। অনেক রকম জালিয়াতি হয়েছে। এ জন্যই আস্থাহীনতা।”
তার বিবেচনায়, সেই আস্থা ফেরাতে নির্বাচনি অঙ্গন আর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘পরিচ্ছন্নতা’ আনতে হবে। আর সেটা হতে পারে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হতে পারে এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে। তবে বিএনপিসহ কয়েকটি দল ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়।
বদিউল আলমের বিশ্বাস, ঐকমত্য তৈরি হলে মৌলিক সংস্কার শেষে ‘নির্বাচনের ট্রেন ট্র্যাকে ওঠা’ শুরু করবে।
ইসি নিয়োগে ‘গলদ’ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা
নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও বিগত দিনগুলোতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট করতে না পারার পেছনে নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবার দায় দেখছেন বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেন, “অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের দায় আছে। নির্বাচন কমিশন একটা স্বাধীন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তার দায়িত্ব হল সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন করা। … এখানে আরো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান আছে। বিশেষত রাজনৈতিক দল, অনেকগুলো অংশীজন আছে। তার মধ্যে সরকার, প্রার্থী, বিভিন্ন সরকারি যেই কাঠামো রয়েছে, এ সবগুলোরতে দায় আছে।”
সবগুলো প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে ভূমিকা পালন করলে, সঠিক আইনি কাঠামো আর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
“কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে কার্যকরী নির্বাচন কমিশনও স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে না, যদি নির্বাচনকালীন যে সরকার, তারা নিরপেক্ষ আচরণ না করে। এইজন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার।”
দেশে এ পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এরমধ্যে গত সরকারের আমলে তিনটি নির্বাচন নিয়ে কঠোর সমালোচনা রয়েছে।
এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ হয়েছে সার্চ কমিটির মাধ্যমে; সবশেষ ২০২২ সালে আইনও করা হয়েছে।
এ প্রক্রিয়া ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলে মনে করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম। তার মতে, বিগত দিনগুলোতে স্বাধীনতা চর্চা ও ক্ষমতা প্রয়োগে ইসি ব্যর্থ হওয়ার বড় কারণ ওই ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়া।
“যার ফলে সরকারের অনুগত ব্যক্তিদেরকে, সরকারের খয়ের খাঁ ব্যক্তিদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা অনেক ক্ষেত্রেই তারা ভালো মানুষ। কিন্তু তারা নিরপেক্ষ ছিলেন না এবং তারা মেরুদণ্ড সম্পন্ন ছিলেন না।”
ভালো নির্বাচনের জন্য স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকার এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর জোর দিচ্ছেন বদিউল আলম।
তিনি বলেন, “আমাদের অভিজ্ঞতা, নির্বাচনকালীন সরকার যদি নিরপেক্ষ না হয়, তারা যদি নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেয় এবং একই সাথে তারা যদি প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ না দেয়… এরা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না কারণ দলীয়করণ।
“এই দলীয়করণ যাতে না হয় এবং যারা দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট, তাদেরকে নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে যদি দূরে রাখা হয়, তাহলে কিন্তু সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে। তাই এখানে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
শেখ হাসিনা যেভাবে ‘দানব’
বদিউল আলম মজমুদার মনে করেন, বাংলাদেশের এতদিনের সাংবিধানিক ও অন্য সব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, বিধিবিধান ও আইনি কাঠামো ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার জন্য এবং স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার জন্য ‘অনুকূল’।
তার মতে, ১৯৭২ সালের প্রথম সংবিধানে অনেকগুলো ত্রুটি ছিল, যা স্বৈরাচারী হওয়ার এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুযোগ করে দিয়েছে।
“আমরা যদি অতীতের দিকে তাকাই, শেখ হাসিনা কিন্তু সেই ট্যাংকে চড়ে ক্ষমতায় আসেনি। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা কিন্তু ঊর্দি পরেও আসেনি। ক্ষমতায় এসেও কিন্তু সংবিধান বাতিল করে দেয়নি। শেখ হাসিনা নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছে। যদিও নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আছে।
“তো এই যে কাঠামো, এই যে আইনি ব্যবস্থা, এই যে পদ্ধতি, প্রক্রিয়া এগুলা কিন্তু স্বৈরাচার সৃষ্টির অনুকূলে ছিল।”
এরপর বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলে ২০১১ সালে শেখ হাসিনার সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন।
বদিউল আলম বলেন, “মূলত পুনর্লিখন করে এই ব্যবস্থাকে আরও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুৎসই করেছে, আরও কার্যকর করেছে। সেই জন্যই শেখ হাসিনা দানবে পরিণত হয়েছে।”
করতে হবে সাফ সুতরো
ইসি ও নির্বাচন ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন করে জনগণ ও অংশীজনের আস্থা ফেরাতে ইতোমধ্যে সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সেই সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে ‘দুর্বৃত্তায়িত’ নির্বাচনি অঙ্গনকে ‘পরিচ্ছন্ন’ করা।
“একই সাথে রাজনৈতিক দলগুলোতে দুর্বৃত্তপনা শিকড় গেড়ে বসেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনকেও মুক্ত করা দরকার, পরিচ্ছন্ন করা দরকার।”
বাংলাদেশে সকল অন্যায়, বড় বড় দুর্নীতি যে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় হয়, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “(ভোটে) টাকার খেলা বন্ধ করতে হবে, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে, কার্যকর করতে হবে।”
নাগরিক সমাজ যাতে ‘অতন্দ্র প্রহরীর’ ভূমিকা পালন করতে পারে, সেই সুযোগও তৈরি করে দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান বলেন, “আমাদের নির্বাচনি অঙ্গনকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। একই সাথে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে কেউ ওই যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে না পারে এবং একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী না হতে পারে।”
রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়ানোর সুপারিশও যে কমিশন করেছে, সে প্রসঙ্গ ধরে তিনি বলেন, “দলের অনেকগুলো সংস্কার, তাদেরকে কিন্তু বাস্তবায়ন করতে হবে। তো তারা যদি এটা বাস্তবায়ন শুরু করে, দলের গণতন্ত্র, দলের আর্থিক স্বচ্ছতা, দলের দায়বদ্ধতা, তাহলে কিন্তু এই যে নির্বাচনটা দ্রুত হতে পারে এবং নির্বাচনটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমি মনে করি।”
দলের প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, ‘মনোনয়ন বাণিজ্য ও টাকার খেলা’ বন্ধ করা, আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন বদিউল আলম।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো যদি দুর্বৃত্তদেরকে মনোনয়ন না দেয়, অপরাধীদেরকে যদি মনোনয়ন না দেয়. তাহলে কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যাব।”
‘ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে’
বদিউল আলম মজুমদার বলছেন, সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের সুপারিশ করেছে ‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ রক্ষার জন্য।
“এটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা। …নজরদারিত্বের একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর করা।”
তিনি বলেন, রাষ্ট্র কাঠামোতে বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং সংসদ- এই তিন প্রতিষ্ঠান পরস্পরের ওপর নজরদারি করে, যাতে কেউ ক্ষমতার অব্যবহার করতে না পারে এবং মানুষের অধিকার হরণ করতে না পারে।
“পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই কিন্তু এই চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স, নজরদারিত্ব। তা না থাকলে একনায়ক প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়।”
‘দলের কোর্টে বল’
সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোয় ঐকমত্য তৈরিতে সংলাপ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বদিউল আলম মজুমদার সেই কমিশনের সদস্য।
সংস্কারের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদী। তা না হলে এ কাজ করতে আসনে না।
“আমি আশা করি যে… আমরা সকলেই, বাংলাদেশের সকল নাগরিক, আমাদের রাজনীতিবিদরাসহ আমরা… এই যে শহীদদের রক্তের দাগ এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমরা এর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করব না এবং যাতে স্বৈরাচারের আবার পুনরুত্থান না ঘটে সেজন্য যে সকল পরিবর্তনগুলো করা দরকার, যে সকল সংস্কারগুলো আমরা সকলে মিলে করতে পারব।”
বদিউল আলম মজুমদার জানান, ইতোমধ্যে ৩৫টি দলের মতামত পাওয়া গেছে এবং অধিকাংশ দলের সঙ্গে সংলাপও হয়েছে। সংলাপের প্রথম পর্ব শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। অনেক বিষয়ে তারা একমত, আবার অনেকগুলো মৌলিক বিষয়ে মত পার্থক্যও আছে।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, নির্বাচনের সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বাড়ানো, সংসদ সদস্যদের যোগ্যতা-অযোগ্যতাসহ কয়েকটি সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর মতের পার্থক্য রয়েছে।
“আমরা এখন জানার চেষ্টা করছি যে কোন কোন ক্ষেত্রে তারা একমত, কোন কোন ক্ষেত্রে তারা দ্বিমত, কোন কোন ক্ষেত্রে আংশিকভাবে একমত। আমাদের আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তারা অনেকেই মত পরিবর্তন করছে। আশা করছি আলোচনার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবনার সুযোগ হবে।”
নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো যাতে বাস্তবায়ন করা যায়, সেজন্য দলগুলোকেই এখন দায়িত্ব নিতে হবে বলে মনে করেন বদিউল আলম।
তিনি বলেন, “বলটা কিন্তু মূলত রাজনৈতিক দলের কোর্টে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি একমত হয় তাহলে কিন্তু আমরা দ্রুত একটা জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে পারি। জাতীয় সনদটা হবে রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। যেসব বিষয়ে তারা একমত হবে এবং যেগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ হবে।
“যত দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, একসাথে ঐকমত্যে পৌঁছাবে, তত দ্রুত আমাদের এ জাতীয় সনদ প্রণীত হবে এবং নির্বাচনী ট্রেন ট্র্যাকে ওঠা শুরু করবে।”
‘না’ ভোট কেন, কেন ইভিএম নয়
‘না’ ভোট ফেরানোর পাশাপাশি ন্যূনতম ৪০ শতাংশ ভোট না হলে সংশ্লিষ্ট আসনের নির্বাচন বাতিলের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, নবম সংসদ নির্বাচনের সময় ২০০৮ সালে ‘না’ ভোটের বিধান ছিল। তখন কোনো রকম ‘সমস্যা হয়নি’।
“বিষয়টা হল বিকল্প থেকে বেছে নেওয়া। যারা প্রার্থী আছে তারা যদি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে আমি ‘না’ বলতে পারি। ওটা হল আরেকটা বিকল্প।”
ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক করার পরিবর্তে অন্তত ৪০ শতাংশ ভোটের বিধানটি যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেন, “অনেক দেশে আছে ৫০ শতাংশ। ৫০ শতাংশ যদি ভোট না পড়ে, তাহলে আবার রান অফ ইলেকশন হয়।… আমরা বলেছি যে জনগণের সম্মতি প্রতিষ্ঠিত হলে একটা ন্যূনতম অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়া দরকার নির্বাচনে।”
তার ভাষায়, নির্বাচন মানে হল গণতন্ত্র, জনগণের সম্মতির শাসন। জনগণের উপস্থিতি যদি না থাকে, জনগণ যদি ভোট না দেয়, তাহলে জনগণের সম্মতি প্রতিষ্ঠিত হয় না।
কমিশন কেন ইভিএম বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে, তারও ব্যাখ্যা দেন বদিউল আলম মজুমদার।
তার ভাষায়, যে ইভিএমে এতদিন ভোট নেওয়া হত, তা ‘নিম্নমানের’, যা গ্রহণযোগ্য নয়।
“জার্মানিতে ইভিএম আদালতের নির্দেশে বন্ধ করা হয়েছে। কারণ ইভিএম একটা ব্ল্যাক বক্স। আমি ভোট দিলাম একটা বোতাম চাপলাম। কিন্তু এরপরে আমি আর দেখলাম না একটা ফলাফল বের হল। এখানে কোনো রকম কারসাজি হয়েছে কিনা, তা মানুষ দেখতে পায় না।”
তিনি বলেন, ব্যালট পেপারের ভোট পদ্ধতিতে ভোটারের কাছে সবকিছু দৃশ্যমান, অন্যদিকে ইভিএমে অদৃশ্য। তাই মানুষের সন্দেহ হয়।
তাছাড়া এই ইভিএমে পেপার ট্রেইল ছিল না, ফলে কোনো প্রশ্ন উঠলে পুনর্গণনার সুযোগ ছিল না।
“এই ইভিএম কেনার সময় বুয়েটের সাবেক উপাচার্য জামিলুর রেজা চৌধুরী, তিনি কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির প্রধান ছিলেন, তিনি এটার বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছেন। তার বিরোধিতা উপক্ষো করেই কিন্তু এটা কেনা হয়েছে স্বার্থ প্রণোদিত হয়ে, দুর্ভাগ্যবশত। তাই এই ইভিএমটা দিয়ে কিন্তু কারসাজি করার সুযোগ ছিল।”
এখন ইসি ‘পোস্ট অফিস’
ইসির দায়বদ্ধতা, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে তদন্ত, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভোট সঠিক হয়েছে এমন সার্টিফিকেশনসহ অন্তত ১০টি সুপারিশের বিষয়ে আপত্তি রয়েছে নির্বাচন কমিশনের।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সংস্কার কমিশন প্রধান বলেন, “আমরা বলেছি, নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধ হতে হবে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে কেউ দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। …এখন নির্বাচন কমিশন একটা পোস্ট অফিসের মত ভূমিকা পালন করছে। চিঠি আসলো, সিল মেরে পাঠিয়ে দিল।”
দায়বদ্ধতার বিষয় থাকলে গত তিনটা নির্বাচন কমিশন ‘কাজ করার আগে দশবার চিন্তা করত’ বলে মন্তব্য করেন বদিউল আলম।
তিনি বলেন, “আমরা প্রস্তাব করেছি যাতে নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধ করা যায়। এটার উদ্দেশ্য তাদের মর্যাদাহানি নয়, কিছুই নয়। তার উদ্দেশ্য হল তারা যেন কোনো রকম জালিয়াতি কিংবা কোনো রকম অপকর্মে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার কাজ থেকে বিরত থাকে।
“আর তারা যদি বিরত থাকে তাহলে তো এটা প্রযোজ্য হবে না।… যদি দায়বদ্ধতার কাঠামো থাকত তাহলে কিন্তু গত তিনটা ইসি যে নির্বাচন করেছে, তারা এর থেকে বিরত থাকত।”
‘দ্রুত নির্বাচন দরকার, ডিসেম্বরে সম্ভব’
সংস্কারে জোর দিলেও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে।
তিনি বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের দ্রুত নির্বাচন হওয়া দরকার, যত দ্রুত সম্ভব। এবং আমাদের কতগুলো সংস্কার হওয়া দরকার, যাতে নির্বাচনের মাধ্যমে আবার স্বৈরাচার ফিরে আসার পথ যেন রুদ্ধ হয়।”
সংস্কার কার্যক্রম শেষ করে ডিসেম্বরেই নির্বাচন করা সম্ভব বলে মনে করেন বদিউল আলম।
তিনি বলেন, “আমি তো বলছি আগেই, এ বলটা রাজনৈতিক দলের কোর্টে। তারা যদি রাজি হয়ে যায়, কালকেই রাজি হয়ে যায়, তাহলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার যে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ দরকার, সেটা আরম্ভ হওয়া সম্ভব।”
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ প্রণয়নে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ঐকমত্য কমিশনের এ সদস্য বলেন, “এখনো আমরা শুনছি। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কথাবার্তা বলছি। আমরা এখন নিশ্চিত নই কোন কোন বিষয়ে তারা একমত। তা আমরা আশা করব পরবর্তী ধাপে।
“এটা তো প্রথম ধাপ, আমাদের আলোচনা হচ্ছে। পরবর্তী ধাপে আমরা এর মাধ্যমে ওইরকম একটা পর্যায়ে পৌঁছতে পারব, যার মাধ্যমে একটা জাতীয় সনদ প্রণীত হবে।”
সংস্কার কার্যক্রমের এ পর্যায়গুলো শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করা সম্ভব মন্তব্য করে বদিউল আলম বলেন, “আমরা তো আশা করছি যে এই মাসের মাঝামাঝি আমাদের এই ধাপ শেষ হবে। তারপরে পরবর্তী ধাপ এবং ডিসেম্বর মধ্যে নিশ্চয় করা সম্ভব হবে।”
তিনি জানান, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের জরিপে ৬৫-৬৬ শতাংশই বলেছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হোক, জাতীয় নির্বাচন পরে।
“এখন জনমত আছে এর পক্ষে এবং অনেক রাজনৈতিক দলও এর পক্ষে আছে। আবার রাজনৈতিক দল বিপক্ষেও আছে। এটা নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলেরগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের ওপর।”
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের মত বদিউল আলমও মনে করেন, সবার সহযোগিতা পেলে আগামী জাতীয় নির্বাচন ‘শ্রেষ্ঠ’ নির্বাচন হতে পারে।
“সবারই আকাঙ্ক্ষা হওয়া উচিত যে এটা সেরা নির্বাচন হোক। আমরা যদি সবাই আকাঙ্ক্ষা করি এবং আমরা সবাই যদি এই লক্ষ্যে কাজ করি, আমাদের ভূমিকা রাখি, আমাদের যা করণীয়, আমাদের রাজনৈতিক দল, তারপরে সরকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তারা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অন্যান্য অংশীজন, আপনাদের গণমাধ্যমেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
“আমরা সবাই যদি আমাদের ভূমিকাটা সঠিকভাবে পালন করি, আমার তো মনে হয় একটা শ্রেষ্ঠ নির্বাচন হতে পারে এবং হওয়া উচিত।”
পুরনো খবর
চার কমিশনের প্রতিবেদন: রাষ্ট্র সংস্কার কোন পথে?
৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনর্নির্বাচনে কমিশনের সুপারিশ
নির্বাচন ব্যবস্থা ভাঙায় দায়ীদের বিতাড়িত করার সুপারিশ করেছি: বদিউল
সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আপত্তি জানিয়ে ঐকমত্য কমিশনে ইসির চিঠি