Published : 29 Jun 2024, 11:34 PM
‘ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের শোষণ, লুণ্ঠন ও অর্থ পাচারের চরিত্র’ স্বাধীন বাংলাদেশেও রয়ে গেছে বলে মনে করেন দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
তিনি বলেছেন, “ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের চরিত্র সেটা হল, শাসকরা শোষণ ও লুণ্ঠন করে; শোষণের মধ্য দিয়ে যা পায় সেটা পাচার করে। বাংলাদেশে বর্তমানে সে ঘটনাই ঘটছে। উপনিবেশের টাকা পাচারের ঘটনায় পরিবর্তন ঘটেনি।”
শনিবার রাজধানীর শিশু একাডেমির মিলনায়তনে ত্রৈমাসিক পত্রিকা নতুন দিগন্তের আয়োজনে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ৮৯তম জন্মদিন উপলক্ষে আত্মজৈবনিক ‘ফিরে দেখা’ বক্তৃতায় এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, “ব্রিটিশ উপনিবেশ, পাকিস্তান ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ-তিন চরিত্রের রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তিনটি রাষ্ট্রের আকৃতি, নাম, পতাকা ভিন্ন। তবে এই তিন রাষ্ট্রে উন্নয়নের যে ধারা সেটা ভাঙেনি। সেই ধারা হলো পুঁজিবাদী ধারা।
“পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যারা ধনী তারা ব্যাংক লুণ্ঠন, ভূমি দস্যুতা, বৃক্ষ দস্যুতাসহ নানা দস্যুতার মধ্য দিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করে। ঠিক আগে শাসকরা যেমন ছিল। এখনও তেমন উপনিবেশিকতার চর্চা চলছে।”
পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনা করে অধ্যাপক সিরাজুল বলেন, “পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখন শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। পুঁজিবাদীরা যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কথা বলে, তা আর চলবে না। পুঁজিবাদ যে ফ্যাসিবাদের আকার ধারণ করেছে, তা না থামার কারণ হলো তাকে আসলে থাপ্পড় দেওয়ার কেউ নেই।”
অনুষ্ঠানে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হয়, বিরূপ পরিবেশেও তিনি হতাশ নন কেন?
জবাবে তিনি বলেন, “আমি আশাবাদী, কারণ মানুষ স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন না দেখলে মানুষ মানুষ থাকে না। কিছু দিন আগে আমার একটা বই বের হয়েছে, সেটার নাম দিয়েছি ‘স্বপ্ন ছিল, স্বপ্ন থাকবে’। স্বপ্ন আছে বলেই এখনও ঠিকে আছি।
“তরুণরা এখনও বিরূপ পরিবেশে প্রতিবাদ করে, তাদের দেখে আমি আশাবাদী হই। তারুণ্যকে রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি ভয় করে এবং তারুণ্যকে নষ্ট করার জন্য যত রকমের কায়দা আছে, সব করছে।
“ভাবতে পারেন, ৩০-৩৫ বছর ধরে ডাকসু ও হল ইউনিয়ন নির্বাচন নেই, কিন্তু দেশে গণতান্ত্রিক সরকার আছে! তারুণ্যকে ভয় করে বলেই তারা ডাকসু নির্বাচন দিচ্ছে না।”
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ রেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ার কথাও উঠে আসে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্যে।
পুরান ঢাকার একজন মসলা ব্যবসায়ী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “এখন মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে, অধিকাংশ মানুষই পরিবর্তন চায়। কিন্তু এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করে রাখা হয়েছে, যাতে তার মানুষের মনুষ্যত্ব ও সামাজিক চিন্তা বিকশিত না হয়। মানুষের সামাজিকতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।”
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কেবল আমাদের জ্ঞান দিয়ে অবদান রেখেছেন, এটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। তিনি আমাদের বিপ্লবকে যেভাবে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অবদান রেখেছেন এর জন্য আমি তাকে কমরেড বলতে চাই।”
দীর্ঘ বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইমেরিটাস অধ্যাপক তার জীবনের নানা অংশে ঘটে যাওয়া ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নানা ঘটনা তুলে ধরেন তিনি।
“বামপন্থিদেরকে নীতি-নিষ্ঠার ভিত্তিতে সকলকে একত্রিত করার কাজ যিনি করতে পারেন তিনি হলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। কোনো একটা ইস্যুতে সবাইকে এক করতে হলে একমাত্র যার কাছে যাওয়া যায় তিনি হলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।”
বাসদের উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান বলেন, “তিনি (সিরাজুল) দুই বাংলায় নিজের একটা বিশিষ্ট স্থান তৈরি করেছেন তার চিন্তা ও লেখনীর মাধ্যমে। তার মত এত সার্থক শিক্ষক আমি আর পাইনি, তবে আমি তার আযোগ্য ছাত্র।
“আমি শুনেছি তিনি কখনও হতাশ হন না। আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, আমরা এখন যে অবস্থায় আছি এটা সবচেয়ে নৈতিকতার নিম্ন পর্যায়। তাতে আপনি কী করে হতাশ হন না?
“ভণ্ডতে দেশ ভরে গেছে। এ কারণে দেশ ছেড়ে সবাই পালাতে চাচ্ছে। আমি জানতে চাই স্যার আপনি হতাশ হন না এই ম্যাজিকটা কী?”
অনুষ্ঠানের শুরুতে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জীবনী পাঠ করে শোনান লেখক, কবি, অনুবাদক অধ্যাপক আজফার হোসেন। এরপর বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ক্ষুদে শিল্পীরা নৃত্য এবং বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গান পরিবেশন করে।
বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সভাপতি এ এস এম কামাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন লেখক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক,লেখক ও সাংবাদিক আবু সাঈদ খান,বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, শ্রমিক নেত্রী মোশরেফা মিশু, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয় জোনায়েদ সাকি।