Published : 21 Jun 2025, 01:15 AM
আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর রাজনীতির মাঠে বেকায়দায় থাকা জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজন নিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েছে; কর্মী-সমর্থকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে নতুন করে ভাঙনের আওয়াজ উঠেছে এইচ এম এরশাদের প্রতিষ্ঠিত এই দলে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যের ‘পাপ’ থেকে দলকে মুক্ত করতে এরশাদের ভাই জিএম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর উদ্যোগ নিয়েছেন পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি অংশ। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারা এ অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টি থেকে বের হয়ে যেসব দল গঠিত হয়েছে, তাদের শীর্ষ নেতাদেরও এক মঞ্চে এনে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন তারা।
অন্যদিকে জিএম কাদের বলছেন, দলে আবার ‘ভাঙন’ দেখা যাচ্ছে। নতুন একটি গ্রুপ আলাদা হয়ে যাচ্ছে।তবে তারা চলে গেলে জাতীয় পার্টি ‘কলঙ্কমুক্ত’ হবে।
সম্মেলন ঘিরে দ্বৈরথ
২৮ জুন চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় সম্মেলন দিন ঠিক করেছিলেন জিএম কাদেরর নেতৃত্বাধীন দলটি। কিন্তু শেষমেষ সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়, ওই তারিখে প্রধান উপদেষ্টার কর্মসূচি থাকায় অনুমতি দেওয়া যাবে না।
এরপর জিএম কাদের সম্মেলন স্থগিত করে দেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে জেলা পর্যায়ে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।
সেখানে সম্মেলন আয়োজনের জন্যও এখনো প্রশাসনের অনুমতি পাওয়া যায়নি। তবে রোববারের মধ্যে অনুমতি পাওয়ার বিষয়ে তারা আশাবাদী।
জি এম কাদের শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “কাউন্সিলের ভেন্যু (চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র) যেহেতু আমরা পাইনি, সেজন্য ২৮ তারিখের সম্মেলন স্থগিত। এখন কেউ যদি ভিন্ন ভেন্যুতে করে, সেটা তো জাতীয় পার্টির সম্মেলন হবে না।”
অন্যদিকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২৮ জুন জাতীয় পার্টিরই সম্মেলন এবং চেয়ারম্যান এ সম্মেলন ডেকেছেন। কাকরাইলে অফিসের সামনে আগামী সপ্তাহেই সম্মেলন অনুষ্ঠানের সব ধরনের অনুমতি আমরা পেয়ে যাব।
“সম্মেলন হবেই, নেতা-কর্মীরা আসবে। এই সম্মেলনে উনি (চেয়ারম্যান) থাকবেন, অসুবিধা তো নেই; কেউ তো মানা করছে না, কেউ তো বলছে না যে উনি আসতে পারবেন না।”
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলছেন, সম্মেলন স্থগিত করতে হলে চেয়ারম্যানের উচিত ছিল প্রেসিডিয়িাম মিটিং ডাকা।
“২৮ জুন সম্মেলন হবেই। এখানে বিভক্তি কোনো কারণ নেই। ভেন্যু পরিবর্তন করে আমরা পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে করেছি। এখানে অসুবিধাটা কোথায়? আমরা প্রশাসনের কাছেও এই ভেন্যুর জন্য আবেদনও করেছি। যারা ভেন্যু বির্তকে সম্মেলন করতে চাচ্ছে না, তাদের মূলত ভিন্ন চিন্তা আছে, তা পার্টির নেতা-কর্মী-সমর্থকরা বোঝে।”
‘চাই নতুন মুখ’
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারদের অংশের নেতারা দাবি করছেন, তাদের সঙ্গে দলের সাবেক ও বর্তমান জ্যেষ্ঠ নেতাদের বড় একটি অংশসহ বিভিন্ন জেলার নেতারাও রয়েছেন। এতে তারা ভালো সাড়া পাচ্ছেন।
জাতীয় পার্টির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, “আমরা কাউকে দলের নেতৃত্ব থেকে সরানোর উদ্দেশ্য নিয়ে সম্মেলন করছি না। কেন্দ্রীয় সম্মেলন এটা একটি রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্র চর্চার অংশ। এখানে বিভক্তির কিছু নাই।
“যিনি চেয়ারম্যান আছেন তিনি সে পদেই থাকুন। দলের গণতন্ত্র চর্চা এবং যৌথ নেতৃত্বে দল পরিচালনা হোক। এটা আমাদের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের চাওয়া।”
তবে পার্টির কর্মীদের মধ্যে একটি চালু ধারণা হল, বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনাতে হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জিএম কাদেরের ভূমিকা নিয়ে যেহেতু নানা প্রশ্ন রয়েছে, সেজন্য পার্টির ভেতরে যৌথ নেতৃত্ব সৃষ্টি করে পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে। সেজন্য পুরনো ও নিষ্ক্রিয় নেতাদেরকে যুক্ত করতে হবে।
মূলত ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ তকমা থেকে জাতীয় পার্টিকে বের করে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজনে জোর দিচ্ছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এবিএম রুহুল আমিন তালুকদাররা। কারণ নির্বাচনের আগে পুরোদমে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফেরার সুযোগ তারা নিশ্চিত করতে চাইছেন।
ঢাকার মীরপুরের একটি স্কুলের শিক্ষক মনিরুল কাদেরও জাতীয় পার্টির সমর্থক। তিনি বলেন, “জাপার নেতারা তিনটি সংসদ নির্বাচনে দালালি করছে, আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করেছে। এখন রাজনীতির হাওয়া বদলে গেছে। এই হাওয়ায় চলতে হলে চেহারা পাল্টানো ছাড়া তাদের পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
“দলের গঠনতন্ত্রের ২০ উপধারা ব্যবহার করে চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বদলাতে হবে, সংস্কার করতে হবে। বলতে পারেন, সংস্কার করে নতুনভাবে জানান দিতে হবে যে অতীতের ভুল আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, “গঠনতন্ত্রের ২০ ধারার (ক) উপধারার সংশোধনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টিতে একক কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করার সুযোগ এসেছে। এটা করতে হবে। এটা নেতা-কর্মীদের জিজ্ঞাসা করেন, তারাও বলবে।”
গঠনতন্ত্রের ২০ ধারার (ক) উপধারার ক্ষমতাবলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান যেকো নো পদে যে কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ, অপসারণ করতে পারেন। এ ধারাকে ‘অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী’ বলছেন দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, “উনি (জিএম কাদের) বলেন যে আমি নেতা, আমি এককভাবেই সবকছু করব। আমরা এটার পরিবর্তন করে আরও গণতান্ত্রিক একটা রূপ দিতে চাই। এবারের সম্মেলনে এই পরিবর্তনে একটা সুযোগ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে।এই সম্মেলনে নেতৃত্ব নির্ধারণ হবে।”
তিনি বলেন, “মেইন জিনিস হচ্ছে একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র। আমরা পার্টি থেকে সেটা সরাতে চাই। পার্টিতে যদি স্বৈরতন্ত্র থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের কথা বলে তো লাভ নাই।”
‘আবার ভাঙন’
জিএম কাদের বলছেন, তাকে বাদ দিয়ে পার্টির নেতৃত্ব গঠনের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, বিষয়টা তিনিও বুঝতে পারছেন।
“আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদারসহ কিছু প্রেসিডিয়াম সদস্য এসব বলে বেড়াচ্ছেন। কিছু কিছু জেলায় ফোন করে বলা হচ্ছে ‘তোমরা আসো, তোমাদের মামলা ক্লিয়ার হবে, নির্বাচনেও যাব, আমাদের সঙ্গে সরকারের আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে, প্রধান উপদেষ্টার মিটিংয়েও যাব। কিছু সিট পাব; তোমরা অন্য কোথাও যেও না। কাদের সাহেবের কথা চিন্তা করো না, কিছুদিনের মধ্যে অ্যারেস্ট হয়ে যাবে’। তারা বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করেছেন যে সরকার এটা করাচ্ছে।”
এর পেছনে অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, “জাতীয় পার্টিকে বাদ দিতে পারছে না। কাজেই জিএম কাদের মাইনাস হয়ে জাতীয় পার্টি– সেটা হল সরকারের পলিসি টু কাম কামিং ইলেকশন। বিএনপি-জামায়াত ওরা আওয়ামী লীগকে থাকতে দেবে না। আর জাতীয় পার্টিকেও বাদ দিতে চাচ্ছিল, কিন্তু যেহেতু পারছে না, সেহেতু জিএম কাদের মাইনাস, সেটা তারা চায়। কাউন্সিল করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিলে লাঙ্গলও পাবে, এটা তারা বলে বেড়াচ্ছে।”
এইচএম এরশাদের আমল থেকেই জাতীয় পার্টি বারবার ‘ব্ল্যাকমেইলের শিকার’ মন্তব্য করে তার ছোট ভাই বলেন, “এসব যারা করছেন, তাদের কারণে জাতীয় পার্টি কোনোদিন সঠিক পথে থাকতে পারেনি। শেখ হাসিনার সরকারের সময় আমরা বিভিন্নভাবে নিষ্পেষিত হয়েছি। এরশাদ সাহেবের সময়ও হয়েছে। আমরা বিকশিত হতে পারিনি। এবার অন্তবর্তী সরকারের আমলেও দলে ভাঙন দেখা যাচ্ছে। নতুন একটি গ্রুপ আলাদা হয়ে যাচ্ছে।”
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, “আমি মনে করি, উনারা আলাদা দল করেছেন। উনারা যদি চলে যান, জাতীয় পার্টি কলঙ্কমুক্ত হবে।”
পুরনো জাপা ফেরানোর চেষ্টা
জুলাই অভ্যুত্থানের পর জাতীয় পার্টিকে একটা বিশেষ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। দলের নেতারা মনে করেন এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একটাই পথ, সেটা দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চার পথ তৈরি করা।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, “আমাদের এই সম্মেলনের দুটো উদ্দেশ্য। একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে যে ঐক্য গড়ে তোলা। সবাইকে আনতে হবে পার্টিতে। যারা আসতে চায়, তাদের সবাইকে নিয়ে আমরা চাই, পার্টিকে সুসংসংগঠিত করতে চাই। আর সাথে পার্টিতে গণতান্ত্রিক ধারাগুলো আমরা ফিরিয়ে আনতে চাই।”
পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, কাজী মামুনুর রশীদ, আবু হোসেন বাবলা, শফিকুল ইসলাম সেন্টুসহ যারা বিভিন্ন ভাঙ্গনে জাপা ছেড়েছেন, তাদের নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে চায় জাতীয় পার্টির এ অংশ।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, “পার্টি অনেক ভাঙাভাঙি হয়েছে। সবাইকে গেস্ট হিসেবে সম্মেলনে ডাকা হয়েছে। পরে ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু হবে।”
‘ঐক্য প্রক্রিয়ার’ দিকে তাকিয়ে রওশন-মামুনের জাপা
জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২৮ জুনের সম্মেলনের আমন্ত্রণ তারা পেয়েছেন, তারা সেখানে থাকবেন।
“আমরা তো ঐক্যের একটা ডাক দিয়েছি। আমরা কাজ করতেছি ঐক্যবদ্ধ করার জন্য। এখন সেক্ষেত্রে যদি জিএম কাদের না আসে, সম্মেলনটা… তাহলে ঐক্যটা কেমনে হবে?
“আমরা তো গণতান্ত্রিক জাতীয় পার্টি চাই। সেক্ষেত্রে যদি কেউ বাধা হয় গণতান্ত্রিক জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রে, ধারা উপধারা থেকে স্বৈরাচারী মনোভাব বিলুপ্ত করে তারা যদি না আসতে চায়, তারা তো আসলে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
তবে জি এম কাদেরকে বাদ দিয়ে যে প্রক্রিয়া চলছে, ‘তার মধ্যে নেই’ বলে দাবি করেন কাজী মামুন।
তিনি বলেন, “কাউকে বাদ দিয়ে করার বিষয়টি আমি সমর্থন করি না। রেখেই করার পক্ষে। কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব হতে পারে। সেটা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, হাওলাদার সাহেব, জিএম কাদের সাহেব, মজিবুল হক চুন্নু সাহেব হতে পারে। আবার আমাদের থেকে আমরা এক হতে চাচ্ছি।
“কিন্তু এটা যদি সকলের না হয়, তাহলে এটা কী হবে? আরো দুই চারদিন না গেলে মন্তব্য করা কঠিন হবে
পুরনো খবর