Published : 06 Jul 2025, 03:23 PM
বিএনপিকে ‘সংস্কারবিরোধী’ বলে একটি মহল অত্যন্ত ‘পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে’ বলে অভিযোগ করেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপিকে ‘সংস্কারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ বর্ণনা করে তিনি বলেন, তার দল নয় বছর আগে থেকে সংস্কারের কথা বলে আসছে। ‘গণতন্ত্র ফেরানোর’ দাবিতে গত দেড় দশকের আন্দোলনে জুলুম নির্যাতনের শিকার হওয়া বিএনপির অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলেও বর্ণনা করেছেন মির্জা ফখরুল।
রোববার সকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল কথা বলছিলেন।
তিনি বলেন, “মিডিয়ার কিছু অংশ ও কিছু ব্যক্তি তারা বিএনপির সংস্কার সম্পর্কে বিভিন্ন রকম কথা বলছেন যেগুলো সঠিক নয়। বিএনপির কমিটমেন্ট টু রিফর্মস, এটা কোয়েশ্চেন করবার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপি হচ্ছে সেই দল যে, ২০১৬ সালে বেগম খালেদা জিয়া ভিশন-২০৩০ তিনি সংস্কারের কথা বলেছিলেন। তারপরে বিএনপি ’২২ সালে ২৭ দফা এবং অন্যান্য দলের সাথে আলোচনা করে ’২৩ সালে ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি আমরা দিয়েছি।
“এটাতে আমরা আন্তরিক বলেই কিন্তু ৩১ দফা নিয়ে সারা দেশে অসংখ্য প্রোগ্রাম করেছি জনগণের কাছে যাওয়া হয়েছে, সুধী সমাজ, সুশীল সমাজের কাছে যাওয়া হয়েছে। আজকে একটা মহল, একটা চক্র অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে সংস্কার বিরোধী বলে প্রচার করবার একটা অপচেষ্টা চালাচ্ছে।”
গণতন্ত্র ‘ফেরানোর’ আন্দোলনে বিএনপির শক্ত অবস্থানের কথা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, “আমাদের কত কর্মসূচি, কত সমাবেশ, কত লাঠিপেটা আপনারা দেখেছেন, আপনারা কাভার করেছেন। এখন বিএনপিকে নিয়ে এই প্রশ্নটা কেন করে? এটাকে উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত ছাড়া আমি কী বলব?
‘‘বিএনপিকে মেলাইন করা, তাকে ভুলভাবে চিত্রিত করতে এটা একটা গোষ্ঠীর প্রচেষ্টা চালানো মাত্র। কোনো একজন ব্যক্তি বা কয়েকজন ব্যক্তি বা কয়েকটি গোষ্ঠী মিথ্যা প্রচারণা সমানে করে যাবেন আর সেটাতে তারা মনে করবেন জনগণ খুব সাড়া দিচ্ছে। জনগণ সাড়া দিচ্ছে না। জনগণ বলতে গুটিকতক শহুরে লোক নয়, জনগণ বলতে সারা বাংলাদেশ।”
বিএনপির নীতি তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, “বিএনপি প্রমাণ করেছে, এখানে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সংস্কার আমাদের দলের প্রতিষ্ঠা জিয়াউর রহমান করেছেন। বাক স্বাধীনতা, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা, সংগঠন করবার স্বাধীনতা, সংসদীয় গণতন্ত্র, এমন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিয়ে তিন তিনটা নির্বাচন সব কিছুই বিএনপি। সব কিছুই সংস্কারের মাধ্যমে বিএনপি করেছে।“
বিএনপির অবদান নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা করে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির পাঁয়তারা করে কোনো লাভ হবে বলে সতর্ক করেছেন ফখরুল।
‘যারা নির্বাচন বিলম্বিত চায় তারা গণতন্ত্রের শক্তি নয়’
মির্জা ফখরুল বলেন, “নির্বাচনকে যারা বিলম্বিত করতে চায়, তারা নিশ্চয়ই গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি নয়, তারা নিশ্চয়ই জুলাই-অগাস্ট বিপ্লবের পক্ষের শক্তি নয়।”
সংবাদ সম্মেলনে সংস্কার কমিশনের সংস্কার বিষয়ে বিএনপি কোন কোন বিষয়ে একমতে পৌঁছেছে সেটিরও একটি পরিসংখ্যানও তুলে ধরেন ফখরুল
তিনি বলেন, “জুলাই ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে প্রথম যে প্রস্তাব ছিল আমরা আমাদের মতামত দিয়ে দিয়েছি, এটা বহু আগে দিয়েছি। তারপরে তো সরকার বলেছে তারা দায়িত্ব নিয়েছে তারা করবে। এখন পর্যন্ত তারা কিছু আনেনি।
‘‘আমরা যে কোনো সময়ে যেকোনো ব্যাপারে আলোচনা সব সময় ছিলাম, এখনো আছি। এই ব্যাপারে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।”
সম্মেলনে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, “জুলাই সনদের মতামত আমরা বহু আগে দিয়ে দিয়েছি। যারা করছে না, এটা তো আমাদের দায়িত্ব না। যাদের দায়িত্ব তারা যদি কোনো কারণে বিলম্ব করে দায় বিএনপি নেবে না। এই দায় বিএনপির না।”
‘প্রত্যাশা নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে’
সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে নির্বাচন হতে পারে না- বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে কী না জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, “আমরা পরিস্কার করে বলেছি, আমরা মনে করি যে, জনগণ নির্বাচন চায়,যেটা আলোচনা হয়েছে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেব এবং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের।
‘‘ আমরা আশা করি যে, সেই লক্ষ্যেই দেশ এগিয়ে যাবে।”
মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যেতে চায়। আমরা কোনো বিপ্লবের মাধ্যমে বা অন্য কিছুর মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে চাই না। আমরা ১৫ বছর ধরে লড়াই করছি, সংগ্রাম করছি একটা মাত্র উদ্দেশ্যে যে আমরা গণতন্ত্রের ফিরে যেতে চাই।
‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) প্রসঙ্গে’
স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা পরিস্কার ভাবে বলেছি, দেশে যাতে আবারো কোনো স্বৈরাচারের উৎপত্তি না হয়। পৃথিবীর কোনো দেশে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারিত থাকার কোনো নজির নাই। আমরা বলেছি, বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের কমিটি স্ট্যাডিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বহাল থাকবে না।
“এটার সাথে আমরা বলেছি, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নির্বাহী বিভাগকে কার্যকরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে তার কোনো পরিধির মধ্যে অন্য কোনো অর্গান এবং অন্য কোনো বডি সৃষ্টি করে যাতে তার (প্রধানমন্ত্রীর) কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত না করে সেজন্য আমরা এনসিসি জাতীয় কোনো ধারণার সাথে একমত হয়নি। এটাই ছিলো আমাদের শর্ত।”
তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে থাকা সালাহউদ্দিন বলেছেন, ঐকমত্যে পৌঁছানোর বিষয়ে তারা আশাবাদী।
“আমরা আশা করি আমরা একটা পারব। আলাপ-আলোচনা হচ্ছে তবে দীর্ঘ আলোচনা কাম্য নয়। এ বিষয়ে সবার সাথে আলোচনা করে খুব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো, সাংবিধানিক বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে আসা যাবে। আমরা আশাবাদী।”
‘সংখ্যানুপাতিক ভোট (পিআর) প্রসঙ্গে’
স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘ যারা এই ব্যবস্থা চাচ্ছে আপনারা কী তাদের কাছে শুনেছেন তারা কেমন পিআর পদ্ধতি চায়? গণতন্ত্র যেমন একটা কনসেপ্ট। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র বিভিন্নখভাবে অনুশীলন হয়, আমেরিকায় যেভাবে হয় ইংল্যান্ডে সেইভাবে হয় না, ফ্রান্সে যেভাবে হয়, ভারতে তো সেইভাবে হয় না, শ্রীলংকায় যেভাবে হয় বাংলাদেশে তো সেইভাবে হয় না, একেক দেশে একেক রকম পদ্ধতি আছে গণতন্ত্র কার্য্কর করার।”
‘‘ তেমনি পিআর হল একটা কনসেপ্ট একটা ধারণা, এটা বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে কার্যকর হয়। এখন যারা পিআরের কথা বলছেন তারা কিভাবে পিআর বাস্তবায়ন হবে এই ব্যাপারে কোনো কথা বলছেন না। তাহলে এই সম্পর্কে একটা অসস্পষ্ট ধারণাই থেকে যাচ্ছে। এটা আলোচনার জন্য আলোচনা হচ্ছে। আমরা মনে করি যে, এই রাষ্ট্র জনগণের সিদ্ধান্ত নেবার মালিক জনগণ।”
ইভিএম পদ্ধতির কথা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা শুধু কিভাবে ভোটটা দেব এজন্য একটা ইভিএম পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল সবার মনে আছে। কতবছর হল? এই ইভিএম পদ্ধতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য অনেক প্রচার-প্রচারণা হয়েছে, যারা এই পদ্ধতি কার্য্কর করবে তাদের প্রশিক্ষণ হয়েছে, সেই প্রশিক্ষণে যারা গেছেন তারা যে ভাতা নিয়েছে আপনারা দেখেছেন এই নিয়ে দুর্নীতির অভিয়োগও হয়েছে। আবার তাদের মাধ্যমে সারাদেশে জনগণকেও প্রশিক্ষিত করার চেষ্টা হয়েছে। তারপরও আজ পর্যন্ত ইভিএম পদ্ধতি কার্য্কর হয় নাই।
নজরুল ইসলামের ভাষ্য, পিআর পদ্ধতি হল গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ‘বদলে দেওয়া’ একটি ব্যবস্থা। এ বিষয়ে জনগণ, সুশীল সমাজ এবং প্রতিনিধিনিত্বশীল ও রজনৈতিক দলগুলোর সংগঠনের সঙ্গে আলোটনা হয়নি।
তিনি বলেন, “এটা (পিআর) অত্যন্ত একটা প্রাথমিক পর্যায় আছে। ফরমালি এ নিয়ে আলোচনা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে শুরুই হয় নাই। অথচ এ নিয়ে আমাদের কিছু কিছু সহকর্মী বলছেন, এটা হতেই হবে না করলে ইলেকশনই করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মানেটা কি?”
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘ পিআর একটা সিম্পল কথা, যারা ভোট দেবে তারা কেউ জানতে যে, তার প্রতিনিধি কে হবে? হয় এটা। কিন্তু তারপরও বিষয় যখন আসবে আমরা আলোচনা করব। আমাদের আলোচনা করতে কোনো বাধা নয়।“
নজরুল বলেন, ‘‘ আমাদের মহাসচিব বলেছেন, আমরাই সংস্কার বেশি চাই। আমরাই বেশি সংস্কার করেছি। যুগান্তকারী যেসব সংস্কার বাংলাদেশে এটা আমরা করেছি। উনার কেউ যখন সংস্কারের ‘স’ উচ্চারণ করেনি তখন আমরা পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। সেই বিএনপিকে অভিযুক্ত করে এটা খুবই অন্যায়।”