Published : 14 Jun 2025, 10:02 PM
ছয় দশকের রাজনৈতিক জীবনের শেষ ১০ বছর রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আবদুল হামিদের কেটেছে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। এরপর তিনি বহুল কাঙ্ক্ষিত ‘মুক্ত জীবনে’ ফিরতে পারলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন জটিলতায় পড়েছেন।
চিকিৎসার জন্য গত ৭ মে গভীর রাতে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ঢাকা ত্যাগ করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কিশোরগঞ্জের এক মামলার আসামি হয়েও তিনি কীভাবে দেশত্যাগ করলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী তখন বলেছিলেন, “দরকার হলে তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরে আনা হবে।”
এরপর দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপারসহ চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়।
এর মধ্যে এক মাসের চিকিৎসা শেষে গত রোববার রাতে দেশে ফেরেন হামিদ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত রাষ্ট্রপতি হিসেবে টানা দুটি মেয়াদ পূর্ণ করা আবদুল হামিদ বঙ্গভবন ছাড়ার আগ মুহূর্তে ‘বন্দি জীবন’ শেষে ‘মুক্তভাবে চলার’ সুযোগ মেলায় স্বস্তি প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “আমি রিলিভড বোধ করছি। আমি খুবই আনন্দিত। ১০ বছর পরে আমি একটা মুক্ত জীবনে ফিরে যেতে পারছি। কারণ আপনার শুনেছেন, অনেক সময় আমি বলেছি- আমি একটা বন্দি জীবনে আছি।
“এর থেকে আমি মুক্তি পাচ্ছি। এখন আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে একটু ফ্রিলি মুভ করতে পারব। এটাই আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ।”
দায়িত্ব শেষে বঙ্গভবন ছেড়ে আবদুল হামিদ উঠেছিলেন রাজধানীর নিকুঞ্জে তার নিজের বাড়িতে। ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর নিকুঞ্জ-১ আবাসিক এলাকার লেইক ড্রাইভ সড়কে তিন কাঠা জমি পান তিনি। ২০০০ সালের শেষ দিকে সেখানে বাড়ির কাজ ধরেন। কয়েক বছর কাজ শেষে তৈরি হয় তিনতলা বাড়ি।
নিকুঞ্জ-১ আবাসিক এলাকার লেইক সাইড রোডের সেই বাসার সামনে সার্বক্ষণিক পাহারার জন্য টিনশেড করা হয়। সবশেষ আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগ পর্যন্ত পুলিশের একটি নিরাপত্তা টিম সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় ছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও ওই বাসাতেই থাকছিলেন আব্দুল হামিদ। তখন নিরাপত্তায় পুলিশের আলাদা টিম রাস্তায় না থাকলেও ওই বাসায় তাদের আনাগোনা দেখেছেন স্থানীয়রা।
বর্তমানে পুলিশের কোনো পাহারা না থাকলেও সাদা পোশাকের কয়েকজন পুলিশ বাড়ির আশপাশে ঘোরাফেরা করেন বলে তারা জানিয়েছেন।
লেইক সাইড রোডের ৩ নম্বর সড়কের বাসিন্দা সাব্বির আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চিকিৎসা শেষে বিমানবন্দর থেকে গভীর রাতে তিনি এই বাসায় এসেছিলেন। আবার ভোর বেলায় কয়েকটি গাড়ি একত্রিত হয়ে চলে গেলেন মনে হয়েছে। তিনি মনে হয় এই বাসায় নাই।
“থাকলে তো কেউ না কেউ বাসায় আসা যাওয়া করত। কয়েকদিন ধরে কাউকে বাসায় আসা-যাওয়া করতে দেখা যায় না।”
পাশের ভবনের নিরাপত্তা কর্মী শাহিন আহমেদ বলেন, “আগে তো বাসায় সবসময় পুলিশ থাকত, ৫ অগাস্টের আগে শেডে সবসময় পুলিশ বসে থাকত।
“চিকিৎসার সময় বিদেশ যাওয়ার পর থেকে এখানে কাউকে দেখা যায় না। এখন শুনেছি বিমানবন্দর থেকে বাসায় রাতে আসছিল, আবার সকালে কোথাও নাকি চলে গেছেন।”
৬ নম্বর বাসা লাগোয়া ভবনের নিরাপত্তা কর্মীরা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তাদের ভাষ্য, ‘ভালো কথা’ বললেও সমস্যায় পড়তে হবে। তাই তারা কোনো বিষয়েই কথা বলতে চান না।
শুক্রবার দুপুর আড়াইটার দিকে নিকুঞ্জ-১ আবাসিক এলাকার লেইক ড্রাইভ সড়কে ৬ নম্বর বাড়ির সামনে কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়েও কারও দেখা পাওয়া যায়নি। তিনতলা বাড়িটির প্রধান ফটকের তালা খোলা থাকলেও অটো লক লাগানো থাকায় দরজাটি আসলে ভেতর থেকে লাগানো নাকি বাইরে থেকেই আটকানো- সেটা বোঝা মুশকিল। বেশ কয়েকবার কড়া নাড়লেও কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি।
যেসব সুবিধা পাওয়ার কথা
রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পূর্ণ করার পর আইন অনুযায়ী অবসর ভাতা, চিকিৎসা সুবিধাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন আবদুল হামিদ।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে সর্বশেষ যে মাসিক বেতন পেতেন, তার ৭৫ শতাংশ হারে মাসিক অবসর ভাতা পাবেন আমৃত্যু।
রাষ্ট্রপতি অবসর ভাতা গ্রহণ করে মারা গেলে তার বিধবা স্ত্রী অথবা ক্ষেত্র অনুযায়ী বিপত্নীক স্বামী তার প্রাপ্য অবসর ভাতার দুই-তৃতীয়াংশ হারে মাসিক ভাতা পাবেন আমৃত্যু।
অবসর ভাতা পাওয়ার যোগ্য একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি অবসর ভাতার পরিবর্তে আনুতোষিকও (এককালীন অর্থ) নিতে পারেন।
অবসরে যাওয়ার পর সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে একজন ব্যক্তিগত সহকারী এবং একজন অ্যাটেনডেন্ট (সাহায্যকারী) পাবেন আবদুল হামিদ। একজন মন্ত্রীর প্রাপ্য চিকিৎসা সুবিধার সমপরিমাণ চিকিৎসা সুবিধা পাবেন।
আবাসস্থলে একটি টেলিফোন সংযোগ, সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে একটি কূটনৈতিক পাসপোর্ট, দেশের ভেতর ভ্রমণকালে সরকারি সার্কিট হাউস বা রেস্ট হাউসে বিনা ভাড়ায় থাকার সুবিধা পাবেন আবদুল হামিদ। তিনি দাপ্তরিক ব্যয়ও পাবেন, এর পরিমাণ সরকার নির্ধারণ করে দেবে।
রাজনীতিতে ছয় দশক
১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে জন্ম নেন আবদুল হামিদ। ১৯৫৯ সালে ছাত্রলীগে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে সে সময়ের ময়মনসিংহ-১৮ (বর্তমানে কিশোরগঞ্জ-৪) আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেশ স্বাধীন করতে অস্ত্র ধরেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৩ সালে আব্দুল হামিদকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে সরকার।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচন, ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ এবং ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনেও তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন।
সপ্তম সংসদে ১৯৯৬ সালের ১৩ জুলাই থেকে ২০০১ এর ১০ জুলাই পর্যন্ত ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালনের পর ২০০১ এর ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত স্পিকার হিসাবে সংসদ পরিচালনা করেন আবদুল হামিদ। নবম সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মত স্পিকার হন।
দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের অসুস্থতার কারণে ২০১৩ সালের ১১ মার্চ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান আবদুল হামিদ। জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি; ২৪ এপ্রিল শপথ নেন দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে। এরপর ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নেন।
বাংলাদেশে এত দীর্ঘসময় রাষ্ট্রপতি থাকার রেকর্ড আর কারও নেই। বাংলাদেশের আইনে দুই মেয়াদের বেশি কারও রাষ্ট্রপতি থাকার সুযোগও নেই।
পুরনো খবর
'সাধারণ মানুষের মুক্ত জীবনে' ফিরে আনন্দ আবদুল হামিদের