Published : 10 Sep 2024, 12:00 AM
মিয়ানমার অভ্যন্তরে চলমান সংঘাত তীব্র হওয়ার জেরে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।
সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা সর্তকর্তার পরও বিভিন্নভাবে ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত কয়েকদিনে নানাভাবে ১০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য জানালেও সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ ও জনপ্রতিনিধিরা রোববার পর্যন্ত এ সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার কথা বলছেন।
উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান মো. গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোববার রাতেও টেকনাফের নাফ নদী সীমান্ত দিয়ে নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে প্রবেশ করতে দেখেছেন।
এসব রোহিঙ্গা যাতে স্থানীয়দের বাসা-বাড়িতে অবস্থান নিতে না পারেন সেজন্য এলাকাবাসীকে সর্তক করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সীমান্ত সুরক্ষায় আরও কঠোর নজরদারীর দাবি জানিয়ে গফুর উদ্দিন বলেন, অন্যথায় আবারও ২০১৭ সালের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামতে পারে।
সীমান্তের বাসিন্দারা বলছেন, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পর কয়েকদিন সীমান্ত এলাকাসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন তৎপরতা ছিল না। মূলত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের সদস্যরা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তা শুরু করে।
সম্প্রতি বিজিবিসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো হলেও তাদের ফাঁকি দিয়ে সংঘবদ্ধ দালালরা রাতের আঁধারে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসতে সহায়তা করছেন।
সরকারি একটি সংস্থার তথ্য বলছে, রোববার মধ্যরাত থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত টেকনাফ ও উখিয়ার ৩০টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অন্তত ৪৭৫ জন রোহিঙ্গা নতুন করে অনুপ্রবেশের তথ্য পেয়েছেন তারা।
এই রোহিঙ্গারা নানাভাবে ক্যাম্পে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ির পাশাপাশি ভাড়া বাসায় অবস্থান নিয়েছে বলে জানতে পেরেছে সংস্থাটি।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিজিবির কক্সবাজার ও টেকনাফের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বক্তব্য জানতে সোমবার মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও কোনো ধরনের সাড়া দেননি তারা। ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও মেলেনি সাড়া।
তবে বিজিবির সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানিয়েছেন, সীমান্তে বিজিবির পক্ষে সর্বোচ্চ সর্তকর্তার সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে। গত এক মাসে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী ৪ হাজার ৫০৬ জন রোহিঙ্গাকে আটকের পর ফেরত পাঠানো হয়েছে।
একই সঙ্গে বিজিবির অভিযানে ইয়াবাসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকপাচার ও অন্যান্য চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৪৩ জন চোরাচালানী এবং অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের দায়ে ১২৫ জন বাংলাদেশী নাগরিক ও ২২ জন ভারতীয় নাগরিককে আটকের পর তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশনের ইনচার্জের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া দেননি তিনি।
টেকনাফে রয়েছে নৌ পুলিশের একটি ফাঁড়ি। ফাঁড়িটির ইনচার্জ পরিদর্শক তপন কুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পাঁচ সদস্য জনবলের ফাঁড়িতে বর্তমানে কোনো কর্মকর্তা নেই। অপর চারজন স্টেশনে রয়েছেন। এছাড়া তাদের কোনো প্রকার জলযানও নেই। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে দেখা গেলেও বাঁশি বাজানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
এ বিষয়ে সরকারের প্রশাসনের শীর্ষ এক কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রদান করতে রাজি না হলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কিছু রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের তথ্য রয়েছে। দালালরা কৌশলে এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তা করছেন। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্তের যে পরিস্থিতি তাতে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জনবল দিয়ে নিশ্ছিদ্র নজরদারী সম্ভব হচ্ছে না। এ সুযোগে দালাল চক্রের মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য নানা মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এসব রোহিঙ্গাদের অনেকেই ক্যাম্পে অবস্থানকারী স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ স্থানীয়দের ভাড়া বাসায় অবস্থান নেওয়ার তথ্য মিলেছে।
তবে কত সংখ্যক রোহিঙ্গা সাম্প্রতিক সময়ে অনুপ্রবেশ করেছে তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
সীমান্তের বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্য বলছে, অগাস্ট মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কম হলেও ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ হয়েছে।
টেকনাফের জাদিমোরা, দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া উপকূল, উখিয়ার বালুখালী, ঘুমধুম সীমান্তসহ অন্তত ৩০টি পয়েন্টে দিয়ে এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে।
শতাধিক দালাল এই কাজে জড়িত রয়েছেন। তাদের সহায়তায় মিয়ানমারের মংডুর উত্তরের প্যারাংপুরু ও দক্ষিণের ফাদংচা এলাকায় জড়ো হয়ে থাকা রোহিঙ্গারা এই অনু্প্রেবেশ অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তাদের তালিকাভুক্ত করারও উদ্যোগ দেখা যায়নি এখনো। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত আসলেও যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় তাদের খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সীমান্তের জনগণ।
এ ব্যাপারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেছেন, মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্তের জন্য তারা তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এখনো নতুন রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি তাদের কাছে। ফলে নতুন রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাদের কোনো উদ্যোগ নেই।
তিনি বলেন, “আমরা খবর পেয়েছি বাংলাদেশের কিছু দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছে। নতুন করে যারা অনুপ্রবেশ করেছে তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আত্মীয় স্বজনের কাছে রয়েছে। যারা যুদ্ধে আহত হয়েছে তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। উপর থেকে নির্দেশনা আসলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মিজানুর রহমান বলেন, “বিষয়টি নিয়ে বিজিবিসহ সবাইকে জানানো হয়েছে আরও কঠোর হওয়ার জন্য।”
আরও খবর