Published : 29 Aug 2024, 01:36 AM
বানের পানি থেকে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয়েরে খোঁজে ছুটেও নিস্তার নেই হঠাৎ অসহায় হয়ে পড়া মানুষজনের; পেছনে ফেলে আসা বাড়িঘর আর আসবাবের চিন্তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চুরি-ডাকাতির আতঙ্ক।
পানিতে ডুবে থাকার মধ্যে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়া নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর বিভিন্ন এলাকার মসজিদের মাইকে আসছে সতর্কবার্তা। এতে বাধ্য হয়ে অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে থেকে যাচ্ছেন ঘরে।
উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারা বলেন, প্রতি রাতেই কোনো না কোনো এলাকায় নৌকাযোগে ঢুকে চুরি-ডাকাতির খবর পাওয়া যাচ্ছে।
বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে যখন দেশের অন্যপ্রান্তের মানুষও ছুটে আসছে, তখন ‘নিজেদের এলাকার’ লোকদের এমন কর্মকাণ্ড আফসোস বাড়িয়েছে বানভাসি মানুষের। তাদের ভাষ্য, ”এলাকার কিছু মানুষই এসব করছে।”
বুধবার দুপুরে কথা হয় পূর্ব একলাশপুরের শাহাবুদ্দিন মিয়ার সঙ্গে। ষাটোর্ধ এই ব্যক্তি বলেন, "আল্লার গজব হড়ুক ইতানের উফরে, মানুষ এমনে বিপদের শেষ নাই। আর প্রতি রাইতে চুরি-ডাকাতির চিন্তা।
"বেশির ভাগ এলাকায় কারেন্ট নাই, সন্ধ্যা হইতেই সব অন্ধকার হইযায়। প্রত্যেকদিন কোনো না কোনো এলাকায় মসজিদের মাইকে বলে, ডাকাত আইছে, চোর আইছে।"
তিনি বলেন, "এগুন সব এলাকার লোকজনই। আমার ঘরে কী আছে, কোন দরজায় তালা দিছি আপনে জাইনবেন কেম্নে? ভালো-খারাপ সব এলাকাতেই আছে, এগুন এলাকার কিছু পোলাপাইন নৌকা দি ঘুরি ঘুরি কইত্তেছে।"
বুধবার এ গ্রামের বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পূর্ব একলাশপুরের দিকে সড়কের পাশে প্রায় সব দোকানেই ঢুকে পড়েছে পানি। প্রধান সড়ক পেরিয়ে বাজারের গলি ধরে গ্রামের ভেতরের দিকে যাওয়া রাস্তায় কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর সমান।
রাস্তা থেকে বাড়ির উঠোনে নামলেই পানি কোমর ছুঁই ছুঁই। প্রতি ঘরেই প্রায় হাঁটু পানি। কিছু পাকা ঘরে পানি কম থাকায় ইট-কাঠ দিয়ে উঁচু করে আসবাব বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন বটে। কিন্তু এখনও পানি বাড়তে থাকায় আতঙ্কিত সবাই।
বাজারের মুদি দোকানী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গ্রামের শেষে রেললাইনের পূর্ব দিকে জয়কৃষ্ণপুরের দিকে আরও বেশি পানি। এদিকে মানুষজন ঘরে ঢুকতে পারলেও সেখানে সেই উপায়ও নাই।
“রেল সড়কের উফরে দি পানি গড়াই পইড়তেছে। এতো পানি কোনদিন হয়নো।"
এলাকায় ডাকাতির আতঙ্কের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "তিন-চাইর দিন ধরি ডাকাতি হইতেছে, কুবাই-কাবাই সব লই চলি যায়। অনেকে তো এখন বাড়িত নাই, আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেগই। এ সুযোগে তালা ভাঙ্গি চুরি সব লই যাইতেছেগই।"
এলাকার মালেক ভুঁইয়ার বাড়ি, চকিদার বাড়িতে ডাকাতি হওয়ার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, "এক সপ্তাহের উফরে পল্লী বিদ্যুতের কারেন্ট নাই। এহন তো হেতাগোই সুযোগ। নৌকা লই আসি গত রাইতে চকিদার বাড়ির এক ঘরেরতুন ফ্রিজখানও তুলি লই গেছে। মালেক ভুঁইয়ার বাড়ি ডাকাত ঢুইকছে, একজন ধরবার লাই গেছে হেতেরে কুবাই হালাই চলি গেছে।
"গতরাইতে এশার নামাজের পরে বাড়ি থেকে ফোন দিছে, মসজিদের মাইকে নাকি ডাকাতির কথা বইলতেছে। মানুষের খাওয়ার মতোন কিছু নাই, এরলাই চুরি-ডাকাতি বাড়ি গেছে।"
তবে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কিছুটা দূরের মালেক ভুঁইয়ার বাড়ি ও চৌকিদার বাড়িতে তাৎক্ষণিকভাবে খোঁজ নিয়ে ডাকাতির বিষয়টি যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
এ গ্রামের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, "চুরি-ডাকাতি কিছুতো হইতেছে। বহুতজন বাড়ি ছাড়ি চলি গেছে না? ১০টা ফ্যামিলির ভিতরে দুইটা ফ্যামিলি আছি। বাকি ৮টা ফ্যামিলি চলি গেছে, ঘরতো খালি। এভাবে হয়তো দেখা গেছে চোর ঢুকবেই। সবাইতো আর ভালা না।"
চুরি-ডাকাতির বিষয়ে বেগমগঞ্জ থানার ওসি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, "প্রতি রাতেই বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাকাত এসেছে বলে ফোন পাচ্ছি। মসজিদের মাইকে ডাকাতি হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। রাত হলে নানা এলাকা থেকে এমন প্রচুর ফোন পাচ্ছি। কিন্তু এখনও ডাকাতি হয়েছে এমন কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি।"
খবর পেলে ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমার মনে হয় মানুষজন নৌকা দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে এমনটা করছে। আমরা খবর পেলে যতটুকু সম্ভব যাচ্ছি। গতকাল রাতেও আলীপুর ও হাজীপুর এলাকায় গিয়েছি।
”আমাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে, আমাদের তো নৌকা নাই। এরমধ্যে যতটুকু সম্ভব রেসপন্স করা যায় আমরা করছি।"
ত্রাণের কিছু পেলে খাচ্ছেন, জ্বলছে না চুলা
পানিবন্দি অবস্থায় যারা এখনও বাড়িতে আছেন, তাদের কারও ঘরে রান্না-বান্নার উপায় নেই। যেখানে নিজেরাই কোনও রকমে খাট উঁচুতে তুলে কিংবা ঘরে মাচা বেধে রাত কাটাচ্ছেন সেখানে রান্নার আয়োজন করার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। শুকনো খাবার কিংবা বিভিন্ন সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে পাওয়া খাদ্যসামগ্রীর উপরই নির্ভর করে দিন কাটছে তাদের।
খাবার-দাবার পাওয়ার আশায় অনেকে এলাকা থেকে এসে সড়কের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। মানুষজন রাস্তার হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকছেন।
পূর্ব একলাশপুর গ্রামের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, "বাড়িতে পানি কোমর সমান, ঘরের ভিতরে হাঁটুর উপরে। খাডের নিচে কলাহাছ ঢুকাই খাডেরে ভাসাই দি কোনরকম থাকতেছি।"
এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক পেশায় সিএনজি চালক দেলোয়ার বলেন, "কিছুক্ষণ আগে ভাত আসছে ভাত খাইছি, আর মুড়ি-চিড়া খাইতেছি, যা আসতেছে তাই চলতেছে। রান্নার কোনো ব্যবস্থা নাই। বউ আর বাইচ্চা-কাইচ্চারে বাইরে পাডাই দিছি। নিজে কেবল ঘরে আছি।"
একই গ্রামের শাহাবুদ্দিন মিয়া বলেন, "মানুষ ভাইবছে পানি কমি যাইবো। কোনমতোন ২-৩ ডা দিন থাইকলেই চইলবো। গতকাইল সেই আশাও শেষ করি দিছে, কাইল থেকে পানি আরও বাইড়তেছে।"
এক ছেলে ও স্ত্রীসহ বাড়িতেই আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, "বুক সমান পানি পার হই বাড়ি ঢুকতে হয়, আর ঘরে হাঁটু পানি। খাটের উপর খাট দি, কোনমতোন টিকি আছি। রান্নাবান্নার কোনো ব্যবস্থা নাই, টাকা দি যে কিনি খামু সেই টাকাও নাই। কিছু পাইলে খাই, না পাইলে না খাই।"
বিবি মাফিয়া নামে এক ষাটোর্ধ নারী বলেন, "জায়নামাজ বিছাই নমাজ হড়ারও অবস্থায় নাই। ঘরে এক মাজা (কোমর) পানি। চহির উফরে থাকি তলে পানি। রশিঘর পানি, চুলাতও পানি। বেডারা এক প্যাকেট বিরিয়ানি দিছে আষ্ট ভাগ কইচ্ছি। আষ্ট ভাগ করি তই খাইছি।"
অসন্তোষ ত্রাণ নিয়ে
খাবারের এমন কষ্টের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। প্রায় প্রত্যেকের অভিযোগ কিছু মানুষ যারা সারাক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকছে তারাই পাচ্ছে, যারা বাড়িতে আছে তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না কিছুই।
একলাশপুর গ্রামের উপর দিয়ে ত্রাণ নিয়ে জয়কৃষ্ণপুরের দিকে যাওয়ার সময় বাধার মুখে পড়েন তোহফা ফাউন্ডেশনের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী। এই গ্রামে না দিয়ে অন্যত্র যাওয়া যাবে না বলে বাধা দেন গ্রামের শেষপ্রান্তের রেল লাইনের কাছে থাকা কিছু মানুষ। এরপর স্বেচ্ছাসেবীরা রাগ করে কিছু না দিয়েই এলাকা ছেড়ে যেতে দেখা গেছে।
স্বেচ্ছাসেবীদের একজন মো. জামাল বলেন, "আমরা চট্টগ্রাম থেকে আসছিলাম ত্রাণ নিয়ে, আমরা দিতে পারি নাই। আমরা ব্যর্থ। আমরা আর কিছু দিব না, চলে যাব।"
কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, "গণ্ডগোল লেগে গেছে। আমরা ওই সাইডে যাইতে চাইলে মাইরপিট খুনাখুনি হবে।
"আমরা ভেবেছি এইখানে অনেকেই ত্রাণ দিয়েছে, কম-বেশি এখানকার মানুষ পাচ্ছে। কিন্তু ওইদিকে নদীর ওপারে আমরা দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এখানে আমাদের বাধা দিছে। তারা বলে, এইখানে না দিয়ে অন্য কোথাও যাওয়া যাবে না।"
বিবি মাফিয়া বলেন, "হেতেরা কয় আমরা আইছি আন্নেগরে খাওয়াইতাম, আর এহানের পোলাপাইন হেতাগরে জুতা দি হিডি দিছে।"
২০ টাকার পথে যেতে এখন ৪০০
পূর্ব একলাশপুরের ভেতর দিয়ে গ্রামের শেষে রেললাইন পর্যন্ত যেতে অন্য সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ১০ টাকা আর রিকশায় যেতে ভাড়া লাগতো ২০ টাকা। সেই পথ এখন পাড়ি দিতে প্রয়োজন পড়ছে ৪০০ টাকা। কারণ পুরো রাস্তার উপর দিয়ে এখন নৌকা চলাচল করছে।
নিজেদের নৌকা থাকলে নিজেরাই বাজারে চলাচল করছেন রাস্তা হয়ে, নয়তো হেঁটেই যাচ্ছেন সবাই। তবে প্রয়োজনে ২-১টি নৌকা পাওয়া যাচ্ছে ভাড়ায়।
১৫ বছর বয়সী মিনহাজুল ইসলাম নীরব ও তার বাবা নজরুল ইসলাম একটি নৌকা দিয়ে এভাবে যাত্রী পারাপার করছিলেন।
নজরুল বলেন, "আমি ৯ হাজার টাকা দি এই নৌকা কিনছি। কিন্তু এতদিন কারও উদ্ধার লাগলে, কোনদিক যাওন লাগলে ফ্রি করি দিছি। কিন্তু আমার নিজেরও তো বউ-বাইচ্চা আছে, এজন্য কালকে থেকে ভাড়ায় যাত্রী টাইনতেছি।"
তিন সন্তানের জনক নজরুল তার বাড়ির বিষয়ে বলেন, "ঘরে মাচা বান্ধি থাকতেছি। উপরেত্তে নামলেই কোমর পানি।"
তার ছেলে নীরব বলেন, "কী খরা খাইতে হইলেতো, পেডে দিতে হইলেতো নামতেই হইবো।"
এখনও আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ
প্রায় ১০ দিন ধরে বন্যার পানিতে আটকে থাকা এ অঞ্চলের মানুষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন নিজের বাড়িতেই থাকতে। উঠোন ছেড়ে ঘরেও ঢুকে পড়া পানি বাড়ার সঙ্গে খাট বা চকির নিচে ইট দিয়ে উঁচু করেও থেকেছেন বাড়িতে। কিন্তু একপর্যায়ে নিরুপায় হয়ে ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে।
একলাশপুর ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা, ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ও নূরানী মাদ্রাসার পাশাপাশি তিনটি ভবন এখন ব্যবহৃত হচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে।
ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা গেছে, প্রচুর মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশুরা সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। এক একটি কক্ষে ২৫-৩০ জন মাটিতে বিছানা পেতে থাকছেন।
মাদ্রাসার বারান্দায় রান্না করতে দেখা গেল বিবি রহিমা নামে এক বয়োজ্যেষ্ঠকে। ছেলে-ছেলের বউ ও দুই নাতিসহ গত বুধবার থেকে আশ্রয় নিয়েছেন এখানে। এখান থেকে বিভিন্ন খাবার দিলেও ভাত ছাড়া চলে না বলে জ্বালানি কাঠ কুড়িয়ে এনে রান্না করছিলেন তিনি।
বাড়ির অবস্থা জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, "হানিতে ঘরের চহিও ডুবি গেছে। যদি না ডুবতো তাও থাইকতাম। আর ভাল্লাগে না এই গেঞ্জাম, সইহ্য হয় না। মনে কয় উড়াল দিয়ে চলি যাইতাম ঘরে দুয়ারে।
"নাতি দুইডারে লই কয়দিন হানি উডার হরেও আছিলাম। হরে হিগুনরে পার করিদি ভাইবজি আমি থাকি যাইয়ুম। আল্লা খোদারে বুলামু নামাজ কালাম পরমু, দেখি আল্লায় কিয়রে। ও মা চাইগো চহিও ডুবি গেছে, আমি ভাসি গেছি। দড়ি টানি আর নিচ করতারিনা। পরে নৌকাত করি চলি আইসছি।"
তিনি বলেন, "এখান থাকি খানাটানা যাই দেয় ভালা লাগে না, কাইলও ভাত খাইনো। বেশি খাইনো, কিন্তু দুগা না খাইলে থাইকতারিনো।"
আরও পড়ুন
বন্যা: নোয়াখালীতে আশ্রয়কেন্দ্রে সন্তান প্রসব
২ গর্ভবতী নারীকে উদ্ধার, সন্তানসহ দিন কাটছে বিশ্ববিদ্যালয় হলে
বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, সামিট, ওরিয়ন ও নাসা গ্রুপের মালিকদের বিষয়ে অনুসন্ধানে এনবিআর