Published : 23 May 2025, 09:35 AM
জলবায়ু সংকটে হাওর-সমতল-পাহাড় সর্বত্রই প্রাণ-প্রকৃতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। সংকট মোকাবেলায় কার্যকর উদ্যোগের অভাবে বিপদ আরো ঘনীভূত হচ্ছে। এই দুঃসময়ে আশা দেখাচ্ছে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার পাগনার হাওরের সাতটি করচবাগান।
প্রকৃতিতে বিশুদ্ধ নান্দনিকতা প্রদর্শনের সঙ্গে বর্ষা-হেমন্তে নির্মল বায়ু, ছায়া এবং দুর্গম হাওরে বর্ষায় আফাল (উত্তাল ঢেউ) থেকে প্রতিরক্ষা ঢাল বা রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে দৃষ্টিনন্দন এসব বাগান।
জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ও সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিস (সিএনআরএস) সূত্রে জানা গেছে হাওর এলাকায় পরিবেশ ও প্রতিবেশ প্রকল্পে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত জলাবন হিজল-করচ লাগানোর কার্যক্রম চালায় উন্নয়ন সংগঠন সিএনআরএস।
সাসটেইনেবল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট প্রজেক্ট (এসইএমপি)-এ সংস্থাটি হাওরের কান্দা, জাঙ্গালে, হাওরের নদী ও খালের তীরে পরিকল্পিতভাবে হিজল করচের গাছ লাগানো শুরু করে।
এ জন্য তারা বেছে নেয় জামালগঞ্জ উপজেলার দুর্গম পাগনার হাওরের নয় মৌজা এলাকাসহ কয়েকটি এলাকা। কোথাও সরকারি ভূমিতে এবং কোথাও ব্যক্তিমালিকানাধীন গ্রামীণ এজমালি (যৌথ) জায়গায় এসব বৃক্ষ রোপণ করা হয়।
ওই সময়ে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের হাওর-খাল-নদীর তীরে ৩০টি বাগান সৃজন করে সংস্থাটি। প্রতিটি বাগানে ৮ থেকে ১০ হাজার করচ বৃক্ষ লাগানো হয়।
অল্প হিজল বৃক্ষও রোপণ করা হয়েছিল। তবে সেগুলো পরিচর্যা ও সংরক্ষণের অভাবে মারা গেছে। একইকারণে সৃজিত বাগানের মধ্যে ২০টিও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।
এখনও টিকে আছে নয় মৌজার ফেনারবাক ইউনিয়নের ফেনারবাক, বিনাজুড়া, কামারগাঁও, ছয়হারা, কুজারগাঁও, মাতারগাঁও ও ভাটি দৌলতপুরের করচ বাগান। এই সাতটি বাগানসহ একই উপজেলার শুকদেবপুর, শরিফপুর, বদরপুরে বাগানের কিছু বৃক্ষ পরিচর্যার ফলে বেঁচে গেছে।
সেগুলোই এখন হয়ে উঠেছে হাওরের রক্ষা কবচ।
লক্ষ্মীপুর গ্রামের কিষানি রিপা আক্তার বলেন, “আমাদের এলাকায় সাতটি করচ বাগান আছে। খুব সুন্দর। হাওরে ভয়াবহ বন্যা হলেও আমাদের ক্ষতি হয় না। গাছগুলোর কারণে নদী, এলাকার সড়ক এবং ঘরবাড়ি বর্ষার আফালে (উত্তাল ঢেউ) ভাঙে না। মানুষের অনেক উপকার করছে বাগানগুলো। বৈশাখ মাসে দিনমজুর-কৃষক রোদের মধ্যে এসে এখানে আরাম খুঁজেন।”
এছাড়া জামালগঞ্জের বেহেলির কিছু এলাকায়ও তখন কমিউনিটি বেইজড ওয়েটলেন্ড ম্যানেজমেন্ট (সিবিডব্লিউএম) প্রকল্পে আরও কিছু বৃক্ষ লাগানো হয়েছিল। ২০০৩ সালে প্রকল্পের কার্যক্রম শেষ হয়ে গেলে হাওরে পরিকল্পিত এই বনায়ন কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়।
সরেজমিন সম্প্রতি পাগনার হাওরের কানাইখালী নদী ও আশপাশের কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা যায় তীব্র গরমের মধ্যে ধান কাটা শ্রমিক ও কৃষকরা গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছেন। অনেকে খলাঘর করে গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরম থেকে রক্ষার জন্য সেখানে অবস্থান করছেন।
বাগানের ভিতর দিয়ে মাটির রাস্তা ধরে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাতায়াত করছেন এলাকার মানুষজন। কিছু পর্যটকও দেখা গেল বাগানের ভিতর দিয়ে ঘুরে সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। ছবি তুলছেন প্রকৃতির সঙ্গে।
এছাড়া বাগানের ফাঁকে ফাঁকে কৃষকদের গবাদিপশুও ঘাস খাচ্ছে।
আরেকটি বিষয় বিশেষ করে মনোযোগ কেড়ে নেয় সবার, সেটি হল বাগানে অবিরাম গান গাচ্ছে ‘বউ কথা কও’ পাখির দল।
স্থানীয়রা জানান, সবকটি করচ বাগানেই রাতদিন বউ কথা কও পাখির মধুর সুর শোনা যায়। যার ফলে বাগানগুলোয় এক অন্যরকম সুমধুর আবহ বিরাজ করে।
এদিকে প্রকৃতিতে যখন বাগানগুলোর সৌন্দর্য বিলাচ্ছে তখন দেখা গেল প্রতিটি বাগানেই কিছু বৃক্ষ গোড়া সমেত কাটা। জানা গেল, বর্ষায় দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন এলাকার দুষ্কৃতিকারীরা এসে করাত দিয়ে বৃক্ষ কেটে নৌকা ভরে নিয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুর কাছ থেকে শুনে হাওরের দুর্গম এলাকায় করচ বাগান দেখতে এসেছেন রাঙ্গামাটির অসীম চাকমা।
তিনি বলেন, “আমি পাহাড়ের মানুষ। হাওরে এসে দীর্ঘ করচ বাগান দেখে আমার মনটা জুড়িয়ে গেল। তীব্র গরমের সময় প্রশান্তির ছায়া ও প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়েছি। এটাকে কেন্দ্র করে হাওরে বিরাট পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে। তবে বাগানটির সুরক্ষা প্রয়োজন।”
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থানীয় সুবিধাভোগী নারী-পুরুষদের সংগঠিত করেই হাওরের এই করচ বাগান তৈরির কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অবগত ও সহায়তা নিয়ে গ্রাম কমিটি করে কর্তৃপক্ষ বাগানটির কাজ শুরু করে।
সেজন্য স্থানীয় সুবিধাভোগীদের দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ। পারিশ্রমিক নিয়ে বাগানে নিজেরাই শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন গ্রাম কমিটির লোকজনসহ স্থানীয়রা।
পরবর্তীতে বাগানের সুরক্ষা ও ভবিষ্যতের জন্য বাগান এলাকা বন্দোবস্তের জন্য আবেদন করা হয় গ্রাম কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু কমিটিকে বাগানের ভূমি ইজারা দেওয়া হয়নি।
কিন্তু একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী সুদূরপ্রসারী অসৎ চিন্তা মাথায় রেখে দৌলতপুর, বিনাজুড়া ও কামারগাওয়ের বাগানের কিছু অংশসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমি গোপনে বন্দোবস্ত নিয়েছেন।
ফলে ভবিষ্যতে তারা মালিকানা দাবি করে দৃষ্টিনন্দন বাগানটি নিজেদের ঘোষণা করতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন ও পরিবেশবিদরা।
বাগান তৈরিকালীন সময়ের প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত সিএনআরএসের সাবেক কর্মকর্তা অনীল চক্রবর্তী বলেন, “১৯৯৯-২০০৩ সাল পর্যন্ত সরকারি খাস ভূমিতে আমরা বাগানগুলো তৈরি করি। এর মধ্যে কিছু এজমালি জমিও রয়েছে। সেসময় হাওরের দরিদ্র নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানও হয়। তারা নিজেদের পরিবেশ রক্ষায় কাজ করেন। সংগঠন করে তাদেরকে আমরা প্রস্তুত করেছিলাম।
“প্রকল্প শেষ হওয়ার পর আমরা চলে আসলেও নয় মৌজা এলাকার মানুষ বাগানগুলো রক্ষা করেন। এখন বাগানগুলো সুন্দর হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে বাগান এলাকা গ্রাম কমিটির নামে বন্দোবস্তের জন্য আবেদন করলেও তাদের তা দেওয়া হয়নি। তবে এই সুযোগে কিছু লোক বাগান এলাকা গোপনে ইজারা নিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। ভবিষ্যতে এ নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
সুনামগঞ্জ হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, “হাওরের প্রাণ ও প্রকৃতি এখন হুমকির মুখে। এক সময় হাওরে প্রাকৃতিক অনেক বাগান ছিল। বাগানগুলোর ডালপালা হাওরের পোকামাকড় মাছের খাদ্য জোগান দিতো।
তিনি বলেন, “এখন জলবায়ুর প্রভাব হাওরেও পড়েছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা না, গরম পড়ার কথা না তখন উল্টোটা হচ্ছে। আগাম বন্যা হচ্ছে। এতে মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
“এর মধ্যে স্থানীয়রা নয় মৌজার এই বাগানগুলো তৈরি করেছেন। এই বাগান জলবায়ুর এই পরিবর্তনের খারাপ প্রভাবের সময় আমাদেরকে নানাভাবে উপকার করছে।”
হাওরের উদ্ভিদবৈচিত্র গবেষক কল্লোল তালুকদার চপল বলেন, “হাওরের করচ বাগানগুলো এখন দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। যারা বাগানটি করেছেন তারা একই ধরনের গাছ লাগিয়েছেন। এখানে হাওরের অভিযোজিত বৃক্ষ প্রজাতি লাগালে প্রতিবেশের দিক দিয়ে আরও ভালো হতো। তারপরও বাগানটি প্রকৃতির বিরাট উপকার করে চলছে।”
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুশফিকীন নূর বলেন, আমাদের ফেনারবাক ইউনিয়নের দৃষ্টিনন্দন করচ বাগান থেকে ডালপালা কেটে নিচ্ছে বলে জানতে পেরেছি। আমি সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিদের বিষয়টি অবগত করব। তবে যারা এই কাজে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাগানগুলোর সুরক্ষায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মানুষদেরও নজর রাখা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।