Published : 20 Jun 2025, 11:45 AM
চড়া দামের কারণে ইলিশ এখন সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। চাঁদপুরসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সিন্ডিকেটের কারণে ইলিশের দাম বছরজুড়েই ঊর্ধ্বমুখী থাকে।
জাতীয় এ মাছ মানুষের নাগালের মধ্যে আনতে দাম নির্ধারণের জন্য গত ১৭ জুন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। এরপরই এ নিয়ে জেলাজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
প্রশাসনের এ উদ্যোগে আপত্তি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের প্রাপ্যতা কমে যাওয়ায় এমনিতেই সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। এ অবস্থায় দাম বেঁধে দিলে ইলিশ শিকারে আগ্রহ হারাবেন জেলেরা।
ডিসির চিঠির বিষয়ে বৃহস্পতিবার চাঁদপুর মাছঘাটে কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। প্রশাসনের দাম নির্ধারণের উদ্যোগ যে তারা মেনে নিতে পারছেন না, তা বোঝা গেল স্পষ্টই।
ইলিশের দাম নির্ধারণ করলে সরবরাহ আরও কমে আসবে বলে মন্তব্য করেন কয়েকজন ব্যবসায়ী।
ঘাটের ‘শান্তি ফিস’ আড়তের সত্ত্বাধিকারী সম্রাট ব্যাপারী বলছিলেন, “আমরা জানতে পেরেছি জেলা প্রশাসন ইলিশ মাছের দাম নির্ধারণ করে দিতে উদ্যোগ নিয়েছেন। এটা আমাদের কাছে অযৌক্তিক মনে হচ্ছে। দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করা সম্ভব না। খরচ এবং সরবরাহের ওপর দাম নির্ধারণ হয়। প্রশাসন যদি দাম নির্ধারণ করে, তাহলে ঘাটে আর মাছ আসবে না।”
‘মেসার্স আনোয়ার হোসেন জমাদার’ আড়তের ব্যবসায়ী মনছুর আহমেদ মাহিন বলেন, আড়তে এখন বড় ইলিশ আছে। ছোট আকারের ইলিশ কম। তবে দাম কেজিতে ২০০-৩০০ টাকা কমেছে।
বৃহস্পতিবার বাজারে ১ কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৩০০ থেকে ২৫০০ টাকায়। দেড় কেজি ২৭০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় এবং ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মাহিন বলছেন, “ইলিশ কম পেয়ে জেলেরা এমনিতেই লোকসানে মুখে রয়েছে। দাম নির্ধারণ করলে ইলিশ শিকারে তাদের আগ্রহ হারাবে।”
মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে জেলা প্রশাসক উল্লেখ করেন, প্রাচীনকাল থেকেই চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনা নদীর ইলিশ অত্যন্ত সুস্বাদু এবং মানের দিক থেকেও অতুলনীয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের প্রথম জেলা ব্র্যান্ডিং হিসেবে চাঁদপুরকে ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ হিসেবে সরকার স্বীকৃতি দেয়।
ইলিশের এ স্বাদের সুযোগ নিয়ে চাঁদপুর ও আশপাশের জেলার কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী ও আড়তদার নিজের ইচ্ছেমতো দাম হাঁকাচ্ছেন; যা ক্রেতার নাগালের বাইরে। এমনকি চাঁদপুরের স্থায়ী বাসিন্দাদেরও অভিযোগ ইলিশের চড়া মূল্যের কারণে ইলিশ তাদের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে।
চিঠিতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, যেহেতু ইলিশ চাঁদপুরসহ অন্যান্য জেলাতেও ধরা পড়ে, সেহেতু জেলা প্রশাসন ইলিশের মূল্য নির্ধারণের উদ্যোগ নিলে এর ফলপ্রসূ প্রভাব পড়বে না।
চাঁদপুরের পাশাপাশি বরিশাল, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠিসহ অনেক সাগর তীরবর্তী জেলায় ইলিশ ধরা পড়ে থাকে। নদী বা সাগরে ইলিশ উৎপাদনে জেলেদের কোনো উৎপাদন খরচ না থাকলেও ইলিশের দাম অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। যেহেতু ইলিশ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদন হয় সেহেতু ইলিশ আহরণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে ইলিশের মূল্য নির্ধারণ প্রয়োজন। এ অবস্থায়, জাতীয় মাছ ইলিশের মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্যে বিনীত অনুরোধ করা হলো।
ইলিশের দাম নির্ধারণের বিষয়টিকে ‘অযৌক্তিক’ মনে করেন চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক শবে বরাত সরকার।
তিনি বলেন, “প্রশাসন থেকে ইলিশের যে দাম নির্ধারণ করতে চাচ্ছে, তা আমাদের কাছে অযৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে। কারণ সরবরাহের ওপর নির্ভর করে দাম বাড়বে নাকি কমবে। প্রশাসনের বিষয়টি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
“কারণ হঠাৎ করে দাম নির্ধারণ করলে ব্যবসায়ীরা মেনে নিবে না। আগে যেখানে ইলিশ সরবরাহ হতো ৫০০ থেকে ১ হাজার মণ। এখন এক-দেড়শ মণ ইলিশও ঘাটে আসে না।”
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল বারি জমাদার মানিক বলেন, এভাবে ইলিশের মূল্য নির্ধারণ না করে কিভাবে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে সরকারের প্রদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আমরা বিগত তিন বছর দেখে আসছি ইলিশের উৎপাদন কমছে। উৎপাদন কেন কমছে, এই বিষয়ে গবেষণা বাড়ানো প্রয়োজন।”
তবে ইশিলের দাম নির্ধারণে প্রশাসনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ক্রেতা।
ঘাটে ইলিশ কিনতে আসা এ ক্রেতা বলছিলেন, “বেশ কয়েক বছর ধরে ইলিশের দাম বেশি। দাম বাড়ার প্রবণতা বেশি। কি কারণে দাম বাড়ে আমাদের জানা নেই। ইলিশ উৎপাদনে জেলে কিংবা ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ করতে হয় না। আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। তাহলে কেনো দাম বাড়বে ইলিশের?”
সিন্ডিকেট ভেঙে ইলিশের দাম নির্ধারণ করাই যৌক্তিক বলে মনে করেন তিনি।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, “চাঁদপুরসহ দেশের ১০ থেকে ১২ জেলায় ইলিশ ধরা পড়ে এবং ক্রয়-বিক্রয় হয়। আমরা মনে করছি চাঁদপুরে অংশীজনদের নিয়ে ইলিশের দাম নির্ধারণ করে দেই, তখন এই ইলিশ অন্য জেলায় গিয়ে বিক্রি হবে। এরই ভিত্তিতে আমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি।
“ইলিশের বাজার মূল্য যাতে করে সিন্ডিকেটের খপ্পরে না পড়ে এবং উচ্চমূল্য না হয়।”
আরও পড়ুন
সিন্ডিকেট: চাঁদপুরে ইলিশের দাম নির্ধারণ করতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি