Published : 25 May 2025, 09:10 AM
প্রতিষ্ঠার এক যুগ পার হলেও কবি নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র-কুমিল্লা থেকে কোনো গবেষণা বা প্রকাশনার কাজ হয়নি। শুধু ‘রুটিন কাজ’ সেরেই দায়িত্ব পালন করছেন এখানকার কর্মকর্তারা।
অথচ কুমিল্লার সঙ্গে বিদ্রোহী কবির জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জড়িত। তিনি এখানে গ্রেপ্তার হয়েছেন। জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনাও এখানে বাসকালে লিখেছেন। কবির পত্নী প্রমিলা দেবীর বাড়িও কুমিল্লাতে।
নজরুলকে জড়িয়ে এত স্মৃতি-স্মারক থাকার পরেও শুধু বাজেট স্বপ্লতার কারণে কোনো গবেষণা ও প্রকাশনা এখান থেকে হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছে কর্তৃপক্ষ।
অপরদিকে গবেষক ও নজরুল অনুসারীদের অভিযোগ, আসলে কেন্দ্রের অবহেলার কারণেই এমনটা হয়েছে।
নজরুল গবেষকদের মতে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ দফায় প্রায় এক বছর কুমিল্লায় অবস্থান করেছেন। এই সময়ে তিনি ১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কারণে নগরীর রাজগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার হন। পরে ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর নগরীর ঝাউতলা থেকে গ্রেপ্তার হন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লেখা ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতার জন্য।
গবেষকদের দাবি, কুমিল্লায় কাজী নজরুল ইসলাম অন্তত ৫৩টি রচনা, কবিতা, গান লিখেছেন- যা বাংলাদেশের আর কোথায় হয়নি।
কুমিল্লায় বসবাসকালে কবির রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘দোলন-চাঁপা’, ‘অগ্নিবীণা’, ‘ছায়ানট’, ‘ঝিঙে ফুল’, ‘পুবের হাওয়া’র মত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
কোনো কোনো গবেষকের মতে, কাজী নজরুল ইসলাম ৭৩ দিন ছিলেন দৌলতপুরে। সেই সময়ে তিনি ১৬০টা গান ও ১২০টা কবিতা লিখেছিলেন।
‘পাঁপড়ি-খোলা’ নামের বিখ্যাত কবিতাটাও লিখেছিলেন এখানে বসে। এ ছাড়া ‘অবেলায়’, ‘অনাদৃতা’, ‘বিদায়-বেলায়’, ‘হারমানা-হার’, ‘হারামণি’, ‘বেদনা অভিমান’, ‘বিধুরা পথিক প্রিয়া’ কবিতাগুলো লিখেছিলেন।
জেলায় কবির স্মৃতিধন্য এলাকাগুলো হলো- বর্তমান নজরুল অ্যাভিনিউয়ে প্রমীলা দেবীর বাড়ি, ধর্মসাগরের পশ্চিমপাড়ে কবিতার আসর, ঝাউতলায় গ্রেপ্তার হওয়া, বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার, নানুয়া দিঘীর পাড়, দারোগা বাড়ি, ইউসুফ স্কুল রোড বজ্রপুর, মহেশাঙ্গণ ঈশ্বর পাঠশালা, কুমিল্লা বীর চন্দ্র্রনগর মিলনায়তন- টাউন হল, চর্থায় শচীন দেববর্মণের বাড়ি, নবাববাড়ি, বাদুরতলায় ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি, রাণীর দিঘীর পাড় ফুলার হোস্টেল-কলেজিয়েট স্কুল প্রাঙ্গণ, কুমিল্লা রেলস্টেশন, কোতয়ালী থানা, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার, মুরাদনগরের দৌলতপুরের আলী আকবর খাঁর বাড়ি উল্লেখযোগ্য।
কবির স্ত্রী আশালতা সেনগুপ্তা দুলীও কুমিল্লা নগরীর। তিনি বসন্ত কুমার সেনগুপ্তের মেয়ে। তবে কবি তার নাম দিয়েছিলেন ‘প্রমীলা দেবী’।
এর আগে বিদ্রোহী কবি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের খাঁ বাড়ির আলী আকবর খানের ভাগনি নার্গিস আসার খানমকেও বিয়ে করেছিলেন। যদিও তাদের সে বিয়ে টেকেনি।
জাতীয় কবির জীবনে কুমিল্লার প্রভাব ও তার লেখনি নিয়ে গবেষণা, গ্রন্থনা, প্রকাশনা এবং কবির স্মৃতিস্মারক সংরক্ষণ-প্রদর্শণের জন্য ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় কবি নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র। কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য এক যুগেও বাস্তবায়িত হয়নি বলে মনে করেন গবেষকরা।
যদিও কবির জীবনী, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা, লেখার পঠন-চর্চার জন্য কবি নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রের তিনতলা ভবনে রয়েছে জাদুঘর, লাইব্রেরি, চর্চাকেন্দ্র, মিলনায়তন, আবাসিক কক্ষসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। লাইব্রেরিতে রয়েছে জাতীয় কবির জীবন ও কর্ম নিয়ে অন্তত চার হাজার বই। জাদুঘরটিতে কাজী নজরুল ইসলামের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র, বই-খাতা, কলম, পাণ্ডুলিপিসহ অমূল্য সংগ্রহ রয়েছে।
কুমিল্লায় নজরুলকে নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখির জন্য শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুসের ‘কুমিল্লায় নজরুল’ বইটি আকড় গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ছাড়া অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের ‘নজরুল ও কুমিল্লা’, ‘বিদ্রোহী নজরুল ও প্রমীলা পরিবার’, ‘নজরুল চর্চা: প্রসঙ্গ কুমিল্লা’ বইগুলোতেও কুমিল্লাতে নজরুলের পদচারণা নিয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য উঠে এসেছে। তবে এসব বই লেখকরা নিজস্ব তাগিদে লিখেছেন।
বিশিষ্ট নজরুল গবেষক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক বলেন, “ইন্দ্রকুমার সেনের সঙ্গে সখ্যতায় কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় পাঁচবার এসেছেন। এর মধ্যে দুই মাস দৌলতপুর, নয় মাস কুমিল্লা শহরে ছিলেন। কুমিল্লায় পাঁচবার এসেছেন কবি। সেসময় তার জীবনে এমন কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে যা নজরুলের জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং সন্দিগ্ধ অংশ।”
কবি নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র স্থাপনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক বলেন, “এই ইনস্টিটিউটের কাজ প্রধানত কুমিল্লায় নজরুলের জীবনী গবেষণার মাধ্যমে জাতির কাছে তুলে ধরা। কিন্তু দুঃখের তিনটি বিষয় হল- প্রথমত, যারা নজরুল ইনস্টিটিউটে চাকরি করতে এসেছেন, তাদের নজরুলকে নিয়ে প্রেম বা জ্ঞানগরিমা কতটুকু তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় নাই। দ্বিতীয়ত, আমরা মনে করেছিলাম- কুমিল্লায় যারা একনিষ্ঠভাবে নজরুল নিয়ে গবেষণা করেন ইনস্টিটিউট তাদের ডেকে নেবে এবং তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গবেষণার কাজটি প্রসারিত করবে। কিন্তু তারা সে জিনিসটা করে নাই।
“তৃতীয়ত, একসময় দেখা গেল নজরুল ইনস্টিটিউটে যে জনবল কাঠামো প্রয়োজন তা আর নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। তাই এখানকার কবি নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র বর্তমানে কবির নামধারী শ্বেতহস্তীতে পরিণত হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “কুমিল্লায় আমরা যারা নজরুলকে নিয়ে যে অল্পস্বল্প লেখালেখি করি বা করতে চাই, তা আমরা ব্যক্তিগতভাবেই করি। নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে কিছুই করা হয় না। এই বিষয়টি নিয়ে আমি পরিপূর্ণভাবে হতাশ।”
নজরুল গবেষক অধ্যাপক আলী হোসেন চৌধুরী বলেন, “কুমিল্লার কবি নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র আসলে ঢাকার বাইরে কিছু ভাবছে না। আর এখানে যারা আছেন তারা নিয়মমাফিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
“কিন্তু এটি কোনো রুটিন কাজ নয়, সৃজনশীল কাজ। এই সৃজনশীলতা চর্চার জন্য যে উদ্ভাবনী চিন্তা ও ক্ষমতা দরকার তাতে সহযোগিতা করতে হবে। বিশেষ করে যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দরকার হয়, সেটি মাথায় রেখে নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র যদি কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করে তবেই কুমিল্লার জন্য এবং কুমিল্লায় নজরুলের জন্য ভালো কিছু হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কুমিল্লায় নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র চেয়েছিলাম, পেয়েছি। কিন্তু যে কারণে চেয়েছিলাম তা হয়নি। গবেষণা ও সৃজনশীল চর্চা চেয়েছিলাম- তা হয়নি। এখানে যারা আছেন তাদেরও করণীয় তেমন কিছু নাই, ঢাকা থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবে যে কী করা যায়।”
কুমিল্লা কবি নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ জানালেন, এই কেন্দ্রে কোনো প্রকাশানা শাখা নেই। এই কেন্দ্রের সব প্রকাশনা ঢাকা কেন্দ্র্র থেকে আসে। এ ছাড়া বিগত সময়ে বাজেট স্বল্পতার কারণে গবেষণা খাতে নজর দেওয়া সম্ভব হয়নি।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ইকবাল হাসান বলেন, “কুমিল্লায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গান-কবিতা ও চর্চা নিয়েও আলাদা গবেষণা হওয়া উচিত। সেই গবেষণা থেকে উঠে আসা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে চাইলে কুমিল্লা নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র আলাদা প্রকাশনা করতে পারে।”
কুমিল্লা কবি নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রের সহকারী লাইব্রেরিয়ান খাইরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের সব প্রকাশনা ঢাকা থেকে হয়। আমরা ঢাকা থেকে গিয়ে বই নিয়ে আসি। কুমিল্লা থেকে কিছুই হয় না। এখানে যে লাইব্রেরি আছে সেখানে নজরুলকে নিয়ে প্রচুর বই আছে এবং নিয়মিত পাঠকও আসেন।”
কুমিল্লা কবি নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রের উপ-পরিচালক মো. আল আমিন বলেন, “এখনে নজরুল সঙ্গীত চর্চা, কবিতা আবৃত্তি ও নাচ, উচ্চারণ প্রশিক্ষণের মত বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। তবে এখানে আলাদাভাবে গবেষণা ও প্রকাশনা নেই। আমরা বিষয়টি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জানাব।
“এখান থেকে বই, ম্যাগাজিন প্রকাশ কিংবা গবেষণার উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয় লেখক ও গবেষকরা বেশি আগ্রহী হবেন।”