Published : 16 Jun 2025, 12:57 PM
রাজবাড়ীর পাংশা ও গোয়ালন্দ উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী এলাকায় আবার বেড়েছে রাসেলস ভাইপারসহ বিভিন্ন বিষধর সাপের উপদ্রব। এতে আতঙ্কিত চরাঞ্চলের মানুষ। সাপের ভয়ে কৃষি কাজে যেতে ভয় পাচ্ছেন কৃষকেরা।
দুই বছরে জেলায় সাপের কামড়ে আহত হয়েছে ২৩৫ জন। ওঝার কাছে না নিয়ে সাপের কামড়ে আহত রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
আর প্রশাসন বলছে, কৃষকদের সচেতন করতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সাপের কামড় থেকে বাঁচতে তাদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে গামবুট।
রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন এস এম মাসুদ বলেন, গত দুই বছরে রাসেলস ভাইপারসহ বিভিন্ন সাপের কামড়ে আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ২৩৫ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে পাংশা উপজেলায় গত বছর ১০১ জন আহত হয়েছিলেন। চলতি বছরে ১৮ জন আহত হয়েছেন। গোয়ালন্দ উপজেলায় গত বছর ১০ জন আহত হয়েছিলেন। চলতি বছরে এ উপজেলায় আহতের সংখ্যা চার জন।
কালুখালি উপজেলায় গত বছরে ১৭ জন সাপের কামড়ে আহত হয়েছিলেন। চলতি বছর এ সংখ্যা ৯ জন। বালিয়াকান্দি উপজেলায় গত বছর ২৫ জন এবং চলতি বছরে ৫ জন সাপের কামড়ে আহত হন। এছাড়া সদর উপজেলায় গত বছর ২৬ জন আহত হয়েছিলেন। চলতি বছর সাপে কাটে ২০ জনকে।
তবে সাপের কামড়ে মৃত্যুর কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন।
গত মে মাসে পাংশা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের পদ্মার চরে ধান কাটতে গিয়ে দুটি রাসেলস ভাইপার দেখতে পান স্থানীয় কৃষকেরা। সে সময় কাঁচি ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে সাপ মাটিতে পুঁতে রাখেন তারা। এরপর থেকে ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের চর করনেশনা, মহিদাপুর চরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় গত দুই মাসে সাপের কামড়ে আহত হয়ে তিন থেকে চারজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।
বাহাদুরপুর ইউনিয়নের জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক ইয়াকুব আলী বলছিলেন, “আমিসহ ছয় জন দিনমজুর শ্রমিক হিসাবে স্থানীয় শিমুল প্রামাণিকের জমিতে ধান কাটতে যাই। ধান কাটার সময় হঠাৎ বড় একটি সাপ দেখতে পাই। সবাই মিলে কাঁচি দিয়ে সাপটি মেরে ফেলি। পরে জানতে পারি এটি রাসেলস ভাইপার সাপ। এখন তো ভয়ে আছি সাপ নিয়ে।”
তিনি বলেন, “সাপটি প্রায় তিন ফুট লম্বা হবে। মারার পর তিল ক্ষেতে পুঁতে রাখা হয়েছে।”
পাংশার হাবাসপুর ইউানয়নের হাবাসপুর গ্রামের চরআফড়া গ্রামের কৃষক বাদল মোল্লা বলেন, “চরে তো মাঝে মধ্যে বিশাল বিশাল সাপ দেখা যায়। কখনো কদুর (লাউ) মাচার নিচে, কখনো বাদাম ক্ষেতে, কখনো ধান ক্ষেতে। সাপ দেখে তো ভয় লাগেই। কিন্তু কি করার, এভাবেই আমাদের কৃষি কাজ করতে হয়।”
গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া গ্রামের আলতাফ শেখ বলেন, “দুই একদিন পরপরই মাঠে সাপ দেখা যায়। ভয় নিয়েই কাজ করতে হয়। মাঝে মধ্যে শ্রমিক পাওয়া যায় না। বলে যে আপনাদের ওই মাঠে সাপ দেখা গেছে, আমরা কাজ করবো না।”
দৌলতদিয়া ইউনিয়নের চর করনেশনা এলাকার হামিদ মোল্লা বলেন, “ধান কাটতি আসলি মাঝে মধ্যে সাপ দেহি। এহন বেশি দেহা যায় রাসেল সাপ (রাসেলস ভাইপার) আর গুককু (গোখরা)। সেদি ধান কাটার সময় বিশাল এটা পাইছিলাম। হাত পাচেক লম্বা হবি।
“আশপাশে যারা ধান কাটছিল, তাদের ডাক দিই। পরে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারি। লোকজন দেখে কলো রাসেল সাপ।”
গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের মহিদাপুর চরের বাসিন্দা আকরাম হোসেন বলেন, “কিছুদিন আগে চরে এক নারী ঘাস কাটতে গেলে সেখানে তাকে সাপে কাটে। পরে ফরিদপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মাঝে মধ্যে সাপের কামড়ে আহত হয় কৃষকেরা।”
এই সাপ কি তাড়ানোর ব্যবস্থা নাই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “মাসখানেক আগে চরের গর্তের পানিতে একটি রাসেল ভাইপার সাপ দেখি। পাশে ভেকু মেশিনের লোকজন ডেকে এনে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে মারি সাপটি। প্রায় পাঁচ হাত লম্বা হবে।”
সিভিল সার্জন এস এম মাসুদ বলেন, “আমাদের দেশে দেখা যায় সাপের কামড়ে রোগীদের ওঝার প্রতি অন্য রকম অন্ধ বিশ্বাস আছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ সাপ নির্বিষ। কিছু কিছু প্রজাতি আছে বিষাক্ত সাপ। তারমধ্যে রাসেলস ভাইপার। এই সাপ কামড় দিলে আক্রান্ত জায়গায় রক্ত বের হবে। রক্ত জমাট হয়ে ব্রেন কিডনি ড্যামেজ হয়ে রোগী মারা যাবে।
“আর একটি হলো গোখরা সাপ। এটি কামড় দিলে রোগী টেরও পায় না। পরে রোগী দুর্বলতা অনুভব করে। চোখের পাতা পোড়ে, ঘাড় ভেঙে আসে এবং রোগী যদি ঘুমিয়ে যায় তাহলে ঘুমের মধ্যেই মারা যায়।”
তিনি বলেন, “আমাদের পরামর্শ যে, আতঙ্কিত না হয়ে সাপের কামড়ে আহত রোগীকে ওঝার কাছে না নিয়ে যত দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বলেন, “পাংশা ও গোয়ালন্দ উপজেলায় রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রবের বিষয়ে জানতে পেরেছি। এরইমধ্যে দুই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করেছে চাষিদের মঝে। তারা দুজনেই রাসেলস ভাইপারের অ্যান্টিভেনম হাসপাতালে যতটুকু থাকা দরকার সেটা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে।
“তবে এই মৌসুমে গোয়ালন্দ উপজেলায় উপদ্রব বেশি জানতে পেরেছি। সাপের কামড় থেকে বাঁচতে ওই উপজেলায় ১৫০ জন কৃষকের মাঝে গামবুট বিতরণ করেছে। পাংশা উপজেলাতে যদি সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়, তাহলে সেখানেও গামবুট দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবো। এছাড়া আমাদের সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনও অব্যাহত থাকবে।”