Published : 12 May 2024, 02:05 PM
কৃষিতে বিজ্ঞানের ছোঁয়া ও আধুনিকায়ন মাঠ পর্যায়ের কৃষকের হাতে পৌঁছে যাওয়ায় নেত্রকোণায় বেড়ে চলেছে ধানের উৎপাদন। গত দেড় দশকে কাঠা প্রতি ফলন যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে আবাদের জমিও।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এই সময়ে কাঠা (১০ শতাংশ) প্রতি ধান উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে ১ থেকে ৩ মণ। একইসঙ্গে পতিত জমি চাষযোগ্য করে তোলায় প্রতি বছর গড়ে জমির পরিমাণ বেড়েছে ৫০০ হেক্টরের বেশি।
ফলে কৃষকেরা যেমন লাভবান হচ্ছেন তেমনি জাতীয়ভাবে খাদ্য নিরাপত্তায়ও জেলার উৎপাদিত ধান ভূমিকা রাখতে পারছে।
নেত্রকোণা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিদ্যুৎ মজুমদার জানান, দেড় দশক আগে ২০০৯ সালে জেলায় বোরো আবাদ হয়েছিল ১ লাখ ৭৭ হাজার ১৮৫ হেক্টর জমিতে। এ বছর কৃষকেরা বোরোর আবাদ করেছেন ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে। তখন মোট উৎপাদন হয় ১০ লাখ ৫০ হাজার ৬৪০ টন ধান। আর এ বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ লাখ ৩৭ হাজার ২২৪ টন ধান।
“অর্থাৎ ১৫ বছরের ব্যবধানে বোরো ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২ লাখ টন আর আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বেড়েছে ৮ হাজার হেক্টর।”
তিনি বলেন, “যুগোপযোগী নিত্য নতুন জাতের ধান আবিষ্কার, কৃষিতে আধুনিকায়নের প্রয়োগ, প্রয়োজনীয় সার-বীজের সরবরাহ, কৃষক পর্যায়ে সরকারি প্রণোদনা, কৃষি বিভাগের লোকজনের মাঠ পর্যায়ের নিবিড় তত্ত্বাবধানসহ সরকারি নানা উদ্যোগের কারণেই কৃষিতে এই পরিবর্তনের সুবাতাস বইছে।”
এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, “দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখতে ধানের উৎপাদন বাড়ানো দরকার। তাই একদিকে যেমন একই জমিতে ধান উৎপাদন বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে সামনের দিকে যাচ্ছেন কৃষকেরা তেমনি আবাদি জমির পরিমাণও বাড়িয়ে চলেছেন।
“আবাদ বাড়াতে কৃষিবিভাগ থেকেও নানাভাবে কৃষকদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। এতে করে সর্বশেষ গত বছরের চেয়ে এ বছর ৫৩০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ বেশি হয়েছে।”
বিদ্যুৎ মজুমদার বলেন, “তাছাড়া নিত্যনতুন হাইব্রিড জাতের ধান আবিষ্কারে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পথ অনেকটাই এগিয়ে যায়। যেহেতু হাইব্রিড জাতের ধানে ফলন বেশি হয় তাই কৃষি বিভাগ থেকে নানাভাবে বিষয়টি মাঠ পর্যায়ে আবাদের জন্যে কৃষকদের উৎসাহিত করা হয়। কৃষকেরাও ধীরে ধীরে এর সাথে যুক্ত হতে থাকেন আর উৎপাদনও বাড়তে থাকে।
উফশীর বিপরীতে বেড়েছে হাইব্রিড জাতের চাষ
দেড় দশকের আগের সঙ্গে চলতি বছরের বোরোর হিসেবে দিয়ে কৃষি বিভাগের এই কর্মকর্তা জানান, ওই বছর আবাদের ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯৫৫ হেক্টরে উফশী জাত ও ৩৬ হাজার হেক্টরে হাইব্রিড জাতের ধান চাষ হয়। তখন মোট উৎপাদন হয় ১০ লাখ ৫০ হাজার ৬৪০ মেট্রিকটন।
এর মধ্যে উফশী জাতের ধানে কাঠাপ্রতি গড়ে ফলন হয় সাড়ে ৫ মণ আর হাইব্রিড জাতে কৃষকেরা ফলন পান কাঠাপ্রতি ৭ মণ। তখন কৃষকেরা উফশির মধ্যে ব্রি-২৮ আর হাইব্রিডের মধ্যে হীরা জাতের ধানই বেশি আবাদ করেন।
আর চলতি বছর এই হাইব্রিড ধানের আবাদ হয়েছে ৬০ হাজার ৯০ হেক্টরে। উফশী জাতের আবাদ হয় এক লাখ ২৫ হাজার ৬৫ হেক্টর জমিতে। এবার কৃষকেরা উফশীর ফলন পাচ্ছেন গড়ে কাঠাপ্রতি সাড়ে ৬ মণ আর হাইব্রিডের ফলন পাচ্ছেন মোটা-চিকন ধানভেদে গড়ে ৮ থেকে ১০ মণ করে।
দেড় দশক আগের চেয়ে উফশীতেও কাঠাপ্রতি গড়ে ধান উৎপাদন বেড়েছে ১ মণ করে আর হাইব্রিডে বেড়েছে গড়ে কাঠাপ্রতি ১ থেকে ৩ মণ করে।
এবার আবাদ করা হাইব্রিডের মধ্যে এসএল-৮এইচ, হীরা-২, সিনজেন্টা-১২০৮, ১২০৫, মিতালী-৪সহ ৫৫টি জাত রয়েছে। আর উফশীর মধ্যে বঙ্গবন্ধু-১০০, ব্রি-৮৮, ব্রি-৮৯, ব্রি-৯২, ব্রি-৯৬, ব্রি-২৯সহ অন্তত ১৫টি জাতের ধান আবাদ হয়।
বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে হাইব্রিড, জিংকসমৃদ্ধ ও স্বল্প জীবনকাল জাতের ধান আবাদ বেশি হয়েছে বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।
কমিয়ে আনা হয়েছে প্রণোদনা
জেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এই সময়ে আবাদ বাড়লেও ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হয়েছে সরকারি সহায়তার পরিমাণ।
কৃষকদের উৎসাহিত করতে দেয়া সহায়তা বছর বছর কমিয়ে আনার কারণ হিসেবে কৃষি কর্মকর্তারা বলেছেন, ধানের ফলন বাড়াতেই কৃষকদের কৃষি উপকরণ সহায়তা দেয়া হয়। এখন যেহেতু কৃষকেরা হাইব্রিড ও উফশী জাতের ধান আবাদে নিজেরাই ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তাই সহায়তাও ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হয়েছে।
২০০৯ সালে ৪ লাখ ২২ হাজার ৮৫ জন কৃষকের মাঝে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ করা হয়েছিল। ধাপে ধাপে তাদেরকে সার, বীজ সহায়তা দেওয়া হয়।
অন্যদিকে চলতি বছর বোরো আবাদে কৃষি বিভাগ থেকে সার, বীজ সহায়তা দেওয়া হয়েছে মাত্র ৯০ হাজার কৃষককে। এর মধ্যে রয়েছে এক হাজার টন সার ও ৩৩০ টন বীজ সহায়তা।
কৃষকেরা কী বলছেন
কৃষকেরা জানান, নতুন নতুন জাতের ধান আসছে। এইসব ধান আবাদ করে তারা ভাল ফলন পাচ্ছেন।
মদন উপজেলার উচিৎপুর গ্রামের কৃষক মঞ্জুর আলী এবার কয়ার হাওরে ৬২ কাঠা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, “৮৮ ধান কাঠাপ্রতি সাড়ে ছয় থেকে সাত মণ টিকতাছে। চিকন ধান তো তাই। কিছু জমিতে হাইব্রিড ধান লাগাইছি। ওই সব জমিতে আট থেকে ১০ মণ কইর্যা পাইছি।”
কৃষি বিভাগের বিভিন্ন প্রদর্শনী প্লট, সরকারি সহযোগিতা, কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ, সার, বীজের প্রয়োজনীয় সরবরাহ পাওয়ায় ধান উৎপাদন বাড়ায় প্রভাব পড়েছে বলেও জানাচ্ছেন চাষিরা।
তিনি বলেন, “গত বছর কৃষি বিভাগের উদ্যোগে আমরার হাওরে একটা প্রদর্শনী প্লট হইছিল। ওই প্লটে ভালা ধান অইছিল। ওইটা দেইখ্যা তহনই মনস্থ করছিলাম আমিও এই ধান লাগায়াম। এইবার লাগাইছিলাম। কাঠাপিছে ১০ মণ কইর্যা পাইছি।
“অনেক ধান বেশি হইছে আমার। দেহেন খরচও বেশি না। কিন্তু ধান পাইছি বেশি। এইবার সার কইন আর বীজ মোটামুটি সবই সময়মতো পাইছি। কোন সংকট আছিল না। সেচও দিছি সময়মতো।”
একই গ্রামের কৃষক নাজমুল হাসান নাজিম বলেন, “আমি এইবার ২০ কাঠার মতো জমিতে হাইব্রিড লাগাইছিলাম। কৃষি বিভাগের মাঠের কর্মকর্তারার কাছ থেইক্যা পরামর্শ পাইছি। কখন কতটুকু কি সার দেয়ন লাগবো হেরা কইয়া দিছে।
“ধান কাটার পর সাড়ে ৯ মণ থেকে সাড়ে ১০ মণ ফলন পাইছি। এক কাঠা জমিতে আর কতো ধান অইবো। এক কাঠা খেতে অতোতা ধান অইবো এইডা কোনো দিনও ভাবছি না।”
তিনি বলেন, “আমরা এলাকার সবাই কিন্তু কিছু কিছু জমিতে হাইব্রিড লাগাইছে। সবাই ভালা ফলন পাইছে।”
গোবিন্দশ্রী গ্রামের চাষি কনক মিয়া বাগুয়া হাওরে আবাদ করেছেন ১৬ কাঠা জমি। তিনিও ভাল ধান হওয়ার কথা জানালেন।
কনক বলেন, “এইবার হাওরের জমিতে ভালা ধান হইছে। গত কয়েক বছর অমন ধান আর অইছে না।”
কেন্দুয়া উপজেলার দুল্লী গ্রামের লিয়াকত আলী বলেন, “জমিতে হাইব্রিড ধান লাগায়া ব্যাপক ফলন পাইছি। প্রচুর ধান অইছে। এক কাঠায় কম করে হলেও ১০ মণ হইছে। কারও কারও ১১ মণ কইর্যাও হইছে।
“আগে যে জমিতে ৫ থেইক্যা ৬ মণ ধান আইতো অহন এইসব জমিতে ৯ থেইক্যা ১১ মণ কইর্যা ধান পাইতাছি। এলাকার অন্যরারও একই অবস্থা। সবাইরই ভালা ধান অইছে।”
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, নেত্রকোণায় দিন দিন ধানের ফলন বেড়ে চলেছে। কৃষকেরা উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ধান আবাদে ঝুঁকছেন বলেই উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকে প্রদর্শনী প্লট করে কৃষকদের দেখানো হয়েছে উদ্ভাবিত নতুন নতুন জাতের ধান আবাদে একই জমিতে অনেক বেশি পালন পাওয়া সম্ভব। তাতে কৃষকেরা উৎসাহিত হয়েছেন বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “কৃষক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, কৃষি উপকরণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সারের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করতে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা নিবিড়ভাবে কাজ করছেন। কৃষকেরা যাতে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় সার, বীজ পান তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
“একদিকে কৃষকেরা যেমন একই জমিতে ফলন বেশি পেয়ে লাভবান হচ্ছেন তেমনি জাতীয়ভাবে খাদ্য নিরাপত্তায়ও জেলার উৎপাদিত ধান ভূমিকা রাখতে পারছে।”
মোট উৎপাদন বাড়াতে পতিত জমিও আবাদের আওতায় আনা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বিশেষ করে হাওরে থাকা পতিত জমির পরিমাণ বেশি। সেই জমিগুলো দ্রুত আবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। আশা করছি আগামী বছর আরও পতিত জমি আবাদের আওতায় আসবে।”