Published : 14 May 2025, 02:24 PM
পঞ্চাশ বছর পর আবার চাঁদে যাওয়া ও তারপর মঙ্গলে অভিযানের মানে হচ্ছে আক্ষরিক অর্থেই চাকা নতুন করে আবিষ্কার করা। কারণ, মঙ্গলে টায়ার পাংচার হয়ে গেলে পৃথিবীতে ফিরে আসা সহজ নয়।
ফরাসি টায়ার নির্মাতা ‘মিশলাঁ’র প্রধান নির্বাহী ফ্লোরাঁ মেনেগো বলেছেন, “চাঁদে বা মঙ্গলে যা কিছুই হোক, টায়ারে পাংচার যেন না হয়– এটাই সবচেয়ে জরুরি।”
লাল গ্রহ হিসেবে পরিচিত মঙ্গলের কঠিন পরিবেশের প্রমাণ মিলেছে চালকবিহীন কিউরিওসিটি রোভারের অভিজ্ঞতা থেকে। ২০১২ সালে গ্রহটিতে অবতরণের এক বছর পরেই এর ছয়টি শক্ত অ্যালুমিনিয়ামের চাকা ছিদ্র ও ছিঁড়ে যায়।
বিবিসি লিখেছে, চাঁদের ক্ষেত্রে ২০২৭ সালের মধ্যে ‘আর্টেমিস’ মিশনে আবার নভোচারীদের চাঁদে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ‘আর্টেমিস ফাইভ’ মিশনে ২০৩০ সাল থেকে লুনার রোভার ব্যবহার করে চাঁদের দক্ষিণ মেরু ঘুরে দেখার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
আর্টেমিস মিশনের নভোচারীরা চাঁদের বুকে আগের অ্যাপোলো মিশনের তুলনায় অনেক বেশি দূর ভ্রমণ করবে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে অ্যাপোলো মিশনের ছয়টি অবতরণে নভোচারীরা কখনওই চাঁদের ৪০ কিলোমিটারের বেশি দূরে যাননি।
এ প্রকল্প নিয়ে ফ্রান্সের ক্লেরমো ফেরঁ শহরে পরীক্ষা চালাচ্ছেন ‘মিশলাঁ’-এর লুনার এয়ারলেস হুইল প্রোগ্রামের প্রধান সিলভা বার্তে। তিনি বলেছেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ১০ বছরে চাঁদের ১০ হাজার কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করা।”
যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ক্লিভল্যান্ডে নাসার ‘জন গ্লেন রিসার্চ সেন্টার’-এর প্রকৌশলী ড. স্যান্টো পাদুলা বলেছেন, “এখানে আমরা এক-দুই সপ্তাহের ছোট মিশনের কথা বলছি না, আমরা এমন বিষয় নিয়ে কথা বলছি যা দশকের পর দশক ধরে চলবে।”
চাঁদের জন্য কোনো প্রযুক্তি তৈরি করতে গেলে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হচ্ছে, সেখানে তাপমাত্রার ওঠানামার বিষয়টি।
চাঁদের মেরু অঞ্চলে তাপমাত্রা নামতে পারে হিমাঙ্কের ২৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে, যা পরমাণুর চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ‘অ্যাবসোলিউট জিরো’-এর কাছাকাছি তাপমাত্রা। এটি টায়ারের জন্য বড় সমস্যা তৈরি করবে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
ড. পাদুলা বলেছেন, “বিভিন্ন পরমাণুর মধ্যে চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে কোনো উপাদানকে বাঁকানো ও পরে সেটিকে আবার আগের অবস্থায় ফেরানো খুব কঠিন।”
এসব টায়ারকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে পাথরের ওপর দিয়ে চলার সময় বাঁকতে পারে ও আবার আগের মতো আকারে ফিরে আসতে পারে।
ড. পাদুলা বলেছেন, “টায়ার একবার বেঁকে গেলে সেটা যদি চিরতরে বিকৃত হয়ে যায় তাহলে সেটা ঠিকমতো ঘুরবে না। এতে শক্তির অপচয় হবে।”
নতুন যে চাকা তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলোকে অ্যাপোলো মিশনের হালকা বিভিন্ন রোভারের চেয়ে অনেক বেশি ওজন বহন করতে হবে।
তিনি বলেছেন, পরবর্তী বিভিন্ন মহাকাশ মিশনকে “আরও বড় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও চলমান আবাসনের আশপাশে চলাচল করতে হবে, যেগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বড় হবে।”
এবং মঙ্গলের জন্য এটি আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, কারণ সেখানে মাধ্যাকর্ষণ চাঁদের দ্বিগুণ।
অ্যাপোলো মিশনের বিভিন্ন লুনার রোভারের চাকা ঘিরে ছিল ধাতব জাল। ওই জাল তৈরিতে নাসা ব্যবহার করেছে জিংকের আস্তর দেওয়া পিয়ানোর তার, আর প্রায় ২১ মাইল লম্বা তার লেগেছিল ওই জাল তৈরিতে।
বিবিসি লিখেছে, যেহেতু চরম তাপমাত্রা ও মহাকাশের রশ্মি রাবারকে নষ্ট করে বা সেটিকে ভঙ্গুর কাঁচে পরিণত করে, তাই ধাতু ও উচ্চ-কার্যক্ষম প্লাস্টিক মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে বায়ুশূন্য স্পেস টায়ারের জন্য।
ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি বা ইএসএ-এর ‘রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন মিশন’-এর টিম লিডার পিয়েত্রো বাগলিওন বলেছেন, “সাধারণত বায়ুশূন্য স্পেস টায়ারের জন্য ধাতু বা কার্বন ফাইবারনির্ভর উপাদান ব্যবহার করা হয়।” রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন মিশনটির লক্ষ্য হচ্ছে, ২০২৮ সালের মধ্যে মঙ্গলগ্রহে রোভার পাঠানো।
এক্ষেত্রে কার্যকর উপাদান হচ্ছে নাইটিনোল, যা নিকেল ও টাইটানিয়ামের মিশ্রণ।
‘স্মার্ট টায়ার কোম্পানি’র প্রধান নির্বাহী আর্ল প্যাট্রিক কোল বলেছেন, “এসব উপাদানকে মিশিয়ে একটি ধাতু তৈরি হয়, যা রাবারের মতো কাজ করে। এটিকে বিভিন্নভাবে বাঁকানো গেলেও তা সব সময় নিজের মূল আকারে ফিরে আসতে পারে।”
ড. পাদুলা বলেছেন, নাইটিনোল ‘যুগান্তকারী’ উপাদান হতে পারে। কারণ এ মিশ্রণটি নিজের অবস্থান পরিবর্তনের সময় শক্তি শোষণ ও মুক্ত করতে পারে। এটি তাপ ও শীতলীকরণের সমস্যা সমাধানেও সহায়ক হতে পারে।
তবে ‘মিশলাঁ’-এর বার্তে মনে করেন, চাঁদের দীর্ঘ পথ পাড়ির ক্ষেত্রে টায়ারের জন্য আরও উপযোগী হতে পারে একটি উচ্চ কার্যসক্ষম প্লাস্টিকের কাছাকাছি উপাদান।
অন্যদিকে, উটের পায়ের পাতার মডেল তৈরি করে একটি ‘বায়ো-মিমিক্রি’ পদ্ধতিতে কাজ করছে জাপানের টায়ার কোম্পানি ‘ব্রিজস্টোন’।
পায়ের তলা নরম ও চর্বিওয়ালা হওয়ায় দেহের ওজন বড় পৃষ্ঠে ছড়িয়ে দিতে পারে উট। ফলে তাদের পা নরম বালির মাটিতে ডুবে যায় না। এ ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে টায়ারের থ্রেডে একটি ফেল্টের মতো উপাদান ব্যবহার করছে ব্রিজস্টোন। এগুলোর চাকার মধ্যে পাতলা ধাতুর স্পোক রয়েছে, যা ছড়িয়ে দিতে বা গুটিয়ে আনা যায়।
টায়ারের এমন নমনীয়তা চাঁদের মডিউলের ওজনকে একটি বড় এলাকার মধ্যে ভাগ করে দেয়। যাতে এটি চাঁদের পৃষ্ঠে পাথর ও ধূলিকণায় আটকে না গিয়ে সহজেই চলতে পারে।
‘মিশলাঁ’ ও ‘ব্রিজস্টোন’ আলাদা কনসোর্টিয়ামের অংশ। কোম্পানি দুটি ক্যালিফোর্নিয়ার ‘ভেনচারি অ্যাস্ট্রোল্যাব’-এর সঙ্গে মিলে মে মাসে নাসার ‘জন গ্লেন সেন্টার’-এ নিজেদের প্রস্তাবিত টায়ার প্রযুক্তি উপস্থাপন করেছে।
নাসা আশা করছে, সামনের বছর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে তারা, যেখানে এক বা একাধিক প্রস্তাব থেকে কিছু উপাদান নেবে সংস্থাটি।
ব্রিজস্টোনের বার্তে বলেছেন, অন্যান্য অভিযানের জন্য ইউরোপ নিজে থেকে রোভার তৈরি করতে পারে কি না তার সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছে ইএসএ।