Published : 11 Aug 2024, 02:58 PM
হিরো বা বীরদের নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে সাম্প্রতিক সময় বদল এসেছে।
বীরত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর নজর দেওয়ার পরিবর্তে নতুন এক গবেষণায় ইঙ্গিত মিলেছে, যে কেউই নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে পড়ে বীরের মতো আচরণ করতে পারে।
‘পরিস্থিতিতে পড়ে বীর’ হয়ে ওঠার এ ধারণাটি মানুষের প্রচলিত ধারণার চেয়েও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কম আভিজাত্যপূর্ণ বলে প্রতিবেদনে লিখেছে নোরিজ।
‘ইউনিভার্সিটি অফ বার্মিংহাম’-এর অধ্যাপক ড. ক্যাথারিনা কারচারের নেতৃত্বে এ গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘ক্রিটিক্যাল স্টাডিজ অন সিকিউরিটি’তে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বীরত্ব দেখানো মানুষের চেয়ে মানুষের বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডকে বেশি মূল্যায়ন করে ব্রিটিশ সমাজ।
“কিছু গবেষক বলেছেন, আমরা পোস্ট-হিরোয়িইক সময়ে বাস করি। যেখানে, উইনস্টন চার্চিলের মতো ক্লাসিক হিরোর সংখ্যা কম। এর পরিবর্তে, বীরত্বপূর্ণ কাজ ও পরিস্থিতিতে পড়ে সচেতন হওয়ার বিষয়টিকে আমরা বেশি মূল্য দিই,” বলেছেন ড. কারচার।
পরিস্থিতিতে পড়ে সচেতন হওয়ার বিষয়টি মানুষের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া জানানোর মূল চাবিকাঠি। আর এর তিনটি অংশ রয়েছে, যেমন– পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ সব খুঁটিনাটি লক্ষ্য করা, পরিস্থিতি বোঝা ও পরবর্তী সময়ে কী ঘটতে পারে তার ভবিষ্যদ্বাণী করা।
এমনকি যুক্তরাজ্যের ‘ন্যাশনাল কাউন্টার টেরোরিজম সিকিউরিটি অফিস’ এমন প্রচারাভিযান চালিয়েছে যেখানে লোকজনকে ‘সতর্ক থাকতে’ ও ‘তাদের সহজাত প্রবৃত্তির ওপর আস্থা রাখতে’ উৎসাহিত করেছে।
ভাল পরিস্থিতিতে সচেতনতা ও জরুরী পরিস্থিতির সময় সাহসী সিদ্ধান্ত ও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া লাগতে পারে, যেমনটি দেখা গেছে ২০১৯ সালে লন্ডন ব্রিজে সন্ত্রাসী হামলার সময়।
সে সময় হামলাকারী উসমান খানের মুখোমুখি হয়েছিলেন ড্যারিন ফ্রস্ট ও স্টিভ গ্যালান্ট নামের দুই ব্যক্তি। এ সন্ত্রাসী হামলা থামাতে ফ্রস্ট একটি নারওয়াল প্রজাতির তিমির দাঁত ব্যবহার করেছিলেন। এ সাহসিকতার জন্য পরবর্তীতে তারা দু’জনই ‘কুইন্স গ্যালান্ট্রি’ মেডেল পেয়েছেন।
ড. কারচার বলেছেন, হিরোদের প্রচলিত প্রেক্ষাপটের সঙ্গে ফ্রস্ট ও গ্যালান্টের এই সাহসিকতা খাপ খায় না। কারণ, সে সময় ফ্রস্ট বিচার মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত কর্মী ছিলেন ও গ্যালান্ট ছিলেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করা একজন দোষী সাব্যস্ত খুনি।
এমন নেতিবাচক অতীত থাকা সত্ত্বেও আক্রমণের সময় তাদের কর্মকাণ্ড ব্যতিক্রমী সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, যে কেউ এমনকি দোষী সাব্যস্ত খুনিও সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে হিরো হয়ে উঠতে পারেন।
ড. কারচার এ গবেষণা করতে গিয়ে ফ্রস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন। এতে তিনি খুঁজে পান, পরিস্থিতিমূলক সচেতনতার বিষয়টি মূল্যায়ন করতে গিয়ে এ নতুন ধরনের বীরত্বগাথার সৃষ্টি হয়েছে। তবে, ফ্রস্ট ও গ্যালান্ট নিজেদেরকে হিরো হিসাবে দেখেন না।
তাদের দাবি, তারা শুধু অন্যদেরকে রক্ষা করেছেন।
প্রথমে নিজেকে হিরো বলতে অস্বস্তি বোধ করেন ফ্রস্ট। তিনি বলেন, “প্রথমে আমি হিরো শব্দটি এড়িয়ে গিয়েছি, যা আমাকে খুব অস্বস্তিতে ফেলেছিল। এটি এমন কিছু ছিল না, যা আমি খুঁজছিলাম বা চাইছিলাম। হ্যাঁ, আমরা সত্যিই ভাল কাজ করেছি। তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে।”
তবে পরবর্তীতে গিয়ে গ্যালান্টের মুক্তির জন্য হিরো তকমাটি গ্রহণ করেছিলেন ফ্রস্ট, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক প্রশ্নও সামনে এনেছে। পরিস্থিতিতে পড়ে হিরো হয়ে ওঠার বিষয়টি যদি নৈতিক প্রত্যাশায় পরিণত হয়, তবে কী হবে? কারও সাহসিকতার প্রশংসা করার সময় কি অতীতের নানা বীরত্বপূর্ণ কাজক উপেক্ষা করা উচিত? সেটাই বড় প্রশ্ন।
গ্যালান্টের ঘটনাটি এইসব বিষয়কেই তুলে ধরেছে। সাবেক এক দমকল কর্মীকে হত্যার দায়ে ২০০৫ সালে গ্যালান্টকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। লন্ডন ব্রিজে হামলার পর তাকে হিরো হিসেবে উদযাপন করার পর অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন ওই দমকল কর্মীর সাবেক সঙ্গী ভিকি ফস্টার।
ড. কারচার বলেছেন, “পরিস্থিতিতে পড়ে সচেতন হওয়ার সঙ্গে বেসামরিক নাগরিকদের ‘বীরত্বপূর্ণ কাজের’ প্রশংসার মহান সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। এতে বোঝা যায়, সাধারণ নাগরিকরাও হিরো হয়ে উঠতে পারেন।”
‘হিরো’ উপাধিটি অনেক প্রত্যাশা নিয়ে এলেও এর মানে দিনকেদিন পরিবর্তিত হচ্ছে। যেহেতু আমরা পরিস্থিতিতে পড়ে সচেতনতার বিষয়টিকে বেশি মূল্য দিই, তাই হিরো যে কেউ হতে পারে, এমনকি আপনিও।
কোনো দেশের সরকার, নিরাপত্তা সংস্থা, গণমাধ্যম ও সমাজের কাছে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে হিরো হয়ে ওঠার মানে কী হতে পারে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।