Published : 28 Sep 2024, 08:49 PM
লেবাননের রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরতলীতে হামলায় হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হয়েছেন বলে ইসরায়েল দাবি করার পর এ খবর এরই মধ্যে নিশ্চিত করেছে গোষ্ঠীটি।
তার মৃত্যুর খবর হিজবুল্লাহ নিশ্চিত করার পরই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ)-এর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি টিভিতে এক ভাষণ দিয়েছেন। সেখানে নাসরাল্লাহকে ইসরায়েলের এ যাবৎকালের ‘সবচেয়ে বড় শত্রুদের একজন’ বলেই অভিহিত করেছেন তিনি।
ফলে নাসরাল্লাহকে হত্যা করতে সফল হওয়াটা ইসরায়েলে ‘বিরাট এক জয়’ হিসাবেই দেখা হবে বলে মনে করেন বিবিসি’র সাংবাদিক জেরেমি ব্রাউন।
তার কথায়, ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নাসরাল্লাহই ছিলেন হিজবুল্লাহর প্রাণস্পন্দন। মিত্র ইরানের সহযোগিতায় তিনি হিজবুল্লাহকে একটি শক্তিশালী লড়াকু দল হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। যার পরিণতিতে ২০০০ সালে দক্ষিণ লেবানন থেকে দুইদশক-ব্যাপী দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে বাধ্য হয়েছিল ইসরায়েল।
২০০৬ সালের লড়াইয়ে ইসরায়েলকে থমকে দিতে হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই নাসরাল্লাহ। সম্প্রতি কয়েক বছরেও নাসরাল্লাহই ছিলেন ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় একক শত্রু।
নাসরাল্লাহর কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন কেবল ইয়াহিয়া সিনাওয়ার; যিনি ছিলেন গতবছর অক্টোবরে ইসরায়েলে ঢুকে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী গোষ্ঠী হামাস যোদ্ধাদের নজিরবিহীন হামলার হোতা।
ওই বছর গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রায় এক বছর ধরে লেবানন সীমান্তে পাল্টাপাল্টি হামলার পর সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে হিজবুল্লাহর ওপর চড়াও হয় ইসরায়েল। হিজবুল্লাহকে পরাস্ত করতে সর্বশক্তি দিয়ে লড়ার অঙ্গীকার করে তারা। এক্ষেত্রে ইসরায়েল কান দেয়নি মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শেও।
লেবাননে হিজবুল্লাহর আস্তানাগুলোকে নিশানা করে লাগাতার বিমান হামলা চালাতে চালাতে অবশেষে তারা শেষ করল তাদের ঘোর একজন শত্রুকে।
মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সুপিরিচিত নেতা:
লেবাননের শিয়া মুসলিম সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে অন্যতম পরিচিত এক মুখ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।
ইসরায়েলের হামলায় নিহত হতে পারেন এমন আশঙ্কার কারণে গত কয়েক বছর ধরেই নাসরাল্লাহকে জনসমক্ষে দেখা যায়নি। তার মধ্যেও শনিবার ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানায়, বৈরুতে তাদের বিমান হামলায় নাসরাল্লাহ নিহত হয়েছেন।
হাসান নাসরুল্লাহর ছিলেন ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকা এক ‘ছায়া’ ব্যক্তিত্ব। হিজবুল্লাহকে একটি রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বছরের পর বছর অন্তরালে থাকলেও নাসরুল্লাহ তার সমর্থকদের কাছে ছিলেন সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব।
নাসরাল্লাহর নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ সহায়তা দিয়েছে। ইরাক ও ইয়েমেনের মিলিশিয়াদের পেছনেও আছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ইরানের কাছ থেকে পাওয়া ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেটের বড় ধরনের ভান্ডার আছে হিজবুল্লাহর।
লেবাননের ভূখণ্ড দখল করে থাকা ইসরায়েলি সেনাদের তাড়াতে প্রথমে একটি মিলিশিয়া দল হিসেবে গড়ে উঠেছিল হিজবুল্লাহ। পরে এ দলকেই লেবাননের সেনাবাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী এক সামরিক বাহিনীতে পরিণত করেছিলেন নাসরাল্লাহ। গোষ্ঠীটি এখন লেবাননের রাজনীতিতেও প্রভাবশালী। আর কেবল তাই নয়, লেবাননের জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া, শিক্ষা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডেও তারা নিয়োজিত।
জন্ম ও ইতিবৃত্ত:
১৯৬০ সালে বৈরুতের পূর্বাঞ্চলীয় বুর্জ হামুদ এলাকায় জন্ম হাসান নাসরাল্লাহর। তার বাবার নাম আবদুল করিম। তিনি ছিলেন একজন সবজি বিক্রেতা। তার নয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন নাসরাল্লাহ।
১৯৭৫ সালে লেবাননে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তিনি শিয়া ‘আমল আন্দোলনে’ যোগ দেন। কিছুদিন ইরাকের নাজাফে শিয়া সেমিনারিতে কাটানোর পর সেখান থেকে লেবাননে ফিরে আবার আমলে যোগ দিয়েছিলেন নাসরাল্লাহ। তবে ১৯৮২ সালে আমল আন্দোলন ভাগ হয়ে গেলে, তিনিও দলছুট হয়ে যান। এর কিছুদিন পরেই ইসরায়েল লেবাননে হামলা চালায়।
আমল আন্দোলন ভাগ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ইসলামিক আমল’। দলটি ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সামরিক ও সাংগঠনিক সহায়তা পেয়েছিল। লেবাননের বেকা ভ্যালি-ভিত্তিক এই দল পরে শিয়া মিলিশিয়াদের সবচেয়ে বিশিষ্ট ও কার্যকর দল হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে এটিই হিজবুল্লাহ সংগঠনে রূপ নেয়।
১৯৮৫ সালে ‘ওপেন লেটার’ নামে একটি প্রকাশনা বের করার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজ দলের প্রতিষ্ঠার কথা জানায় হিজবুল্লাহ। যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে তারা চিহ্নিত করে ‘ইসলামের প্রধান দুই শত্রু’ হিসেবে। ইসরায়েলকে ধ্বংস করার ডাকও দেয় তারা। দেশটিকে তারা মুসলিমদের ভূমি দখলদার আখ্যা দেয়।
হিজবুল্লাহর সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে দলে নাসরুল্লাহর অবস্থান মজবুত হয়। ওপরের পদে আসীন হতে থাকেন তিনি। হিজবুল্লাহর একজন যোদ্ধা থেকে নাসরাল্লাহ বালবেক এলাকার পরিচালক হন, পরে তিনি পুরো বেকা ভ্যালির দায়িত্ব পান এবং এরপর সংগঠনের বৈরুত শাখার দায়িত্ব নেন বলে জানিয়েছিলেন।
মাত্র ৩২ বছর বয়সে ১৯৯২ সালে হিজবুল্লাহর প্রধান হন নাসরাল্লাহ। এর আগে ইসরায়েলের এক হেলিকপ্টার হামলায় নিহত হয়েছিলেন তার পূর্বসূরি আব্বাস আল–মুসাবি।
হিজবুল্লাহ প্রধানের দায়িত্ব নিয়েই মুসাবি হত্যার বদলা নেওয়া ছিল হাসান নাসরাল্লাহর প্রথম কাজ। সে সময় ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে রকেট হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। হামলায় এক বালিকা নিহত হয়। এছাড়াও, তুরস্কে ইসরায়েলের দূতাবাসে গাড়িবোমা হামলায় এক ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে ইসরায়েলি দূতাবাসে আত্মঘাতী হামলায় ২৯ জন নিহত হয়।
ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যান নাসরাল্লাহ। সেই লড়াইয়ের অবসান হয়েছিল ২০০০ সালে দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলি সেনারা সরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। তবে সেই লড়াইয়ে নাসরাল্লাহর ব্যক্তিগত ক্ষতি হয়েছিল। ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন তার বড় ছেলে হাদি।
ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবানন থেকে পিছু হটার পর নাসরাল্লাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরবদের প্রথম বিজয়ের ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে তিনি অঙ্গীকার করেন, ইসরায়েলকে দমন না করা পর্যন্ত তার দল অস্ত্র পরিহার করবে না। সেবা ফার্মস এলাকাসহ দখল করা লেবাননি সব ভূখণ্ড ইসরায়েলকে ছাড়তে হবে বলে হুঙ্কার দেন তিনি।
২০০৬ সাল পর্যন্ত ইসরায়েল–হিজবুল্লাহ উত্তেজনাকর পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত ছিল। তবে ওই বছর হিজবুল্লাহ ইসরায়েল সীমান্তে হামলা চালালে আট সেনা নিহত হন। দুজন অপহৃতও হয়েছিলেন। পরে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ও বৈরুতের দক্ষিণের শহরতলীতে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। হিজবুল্লাহও ইসরায়েলের ভেতরে প্রায় চার হাজার রকেট ছুড়ে এর জবাব দেয়।
৩৪ দিনের ওই লড়াইয়ে অন্তত ১,১২৫ লেবাননি নিহত হয়, যাদের বেশির ভাগই ছিল বেসামরিক নাগরিক। ১১৯ ইসরায়েলি সেনা ও ইসরায়েলের ৪৫ বেসামরিক নাগরিকও নিহত হয়। লড়াই চলাকালে ইসরায়েল নাসরাল্লাহর বাড়ি ও কার্যালয়ে বিমান হামলা চালায়। তবে তিনি অক্ষত ছিলেন।
সর্বশেষ হিজবুল্লাহ–ইসরায়েল উত্তেজনা:
হিজবুল্লাহ–ইসরায়েল উত্তেজনা সর্বশেষ বেড়ে গেছে গত বছরের ৮ অক্টোবর থেকে। এর আগের দিন ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী গোষ্ঠী হামাসের নজিরবিহীন হামলা হয়। যার জেরে গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েল।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে ওই দিন থেকেই সীমান্তে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহর থেমে থেমে পাল্টাপাল্টি হামলা চলে আসছিল।
গত নভেম্বরে এক বক্তব্যে হাসান নাসরাল্লাহ বলেছিলেন, হামাস ইসরায়েলে যে হামলা চালিয়েছিল সেই হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে শুরু করে তা বাস্তবায়ন করা পর্যন্ত ১০০ ভাগই ফিলিস্তিনের নিজস্ব বিষয়। কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে তার দলের যে গুলি বিনিময় চলছে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়।
হিজবুল্লাহ এই লড়াইয়ে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চল এবং ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভুমিতে আট হাজারের বেশি রকেট ছুড়েছে। ইসরায়েলি সমরযান লক্ষ্য করে ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। বিস্ফোরকভর্তি ড্রোন দিয়েও ইসরায়েলের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় হামলা করেছে।
পাল্টা হামলায় লেবাননে হিজবুল্লাহর আস্তানাকে নিশানা করে বিমান হামলা চালানোর পাশাপাশি ট্যাংকের গোলা হামলা ও গোলন্দাজ বাহিনীও কাজে লাগিয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ।
কিছুদিন আগে লেবাননে পরপর দুইদিন হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহার করা হাজার হাজার পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ৩৯ জন নিহত হয় এবং আরও হাজারো মানুষ আহত হয়। এই হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছিলেন হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরাল্লাহ।
তিনি বলেছিলেন ‘ইসরায়েল সীমা লঙ্ঘন করেছে।’ তবে ওই হামলা তার দলের জন্য এক ‘নজিরবিহীন ধাক্কা’ বলেও তিনি স্বীকার করেছিলেন।
ওই পেজার, ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের ঘটনার পরপরই লেবাননে নাটকীয়ভাবে হামলা জোরদার করে ইসরায়েল। তাদের চালানো বোমা হামলার ঢেউয়ে লেবাননে প্রায় ৮০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।