Published : 11 May 2025, 12:51 PM
পাল্টাপাল্টি হামলা যখন দৃশ্যতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানের ‘অবিলম্বে অস্ত্র বিরতিতে’ সম্মত হওয়ার খবর দিলেনে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
পরমাণু অস্ত্রধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সবচাইতে ভয়াবহ লড়াই শনিবার অপ্রত্যাশিতভাবেই থেমেছে।
সিএনএন লিখেছে, অস্ত্রবিরতির কথা প্রথম ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প; এই সফলতার কৃতিত্বও তিনি দাবি করেন, তবে এই সমঝোতার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার মাত্রা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের ভাষ্য সাংঘর্ষিক।
অস্ত্রবিরতির ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা বাদে তা লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে উভয়পক্ষ; তাতে এই সমঝোতা কতদিন স্থায়ী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
কীভাবে সমঝোতা হল?
ভারত ও পাকিস্তানে যখন সন্ধ্যা নামছিল, তখন ট্রাম্প ট্রুথ সোশাল পোস্টে অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দেন।
“যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় রাতভর দীর্ঘ আলোচনার পর, আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে ভারত ও পাকিস্তান একটি ‘পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক অস্ত্রবিরতিতে’ সম্মত হয়েছে।”
দুই দেশের নেতাদের ‘কাণ্ডজ্ঞান ও গভীর বুদ্ধিমত্তার’ প্রশংসা করে তাদের অভিনন্দন জানান তিনি।
খানিকবাদে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দাবি করেন, ভারত ও পাকিস্তান কেবল অস্ত্রবিরতিতেই সম্মত হয়নি, সেই সঙ্গে ‘একটি নিরপেক্ষ স্থানে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা শুরু করতেও’ রাজি।
রুবিও বলেন, গত দুই দিন ধরে তিনি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স দুই দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পর এই অস্ত্রবিরতি সম্ভব হয়েছে।
এক মিনিট পরই পাকিস্তান জানায়, যুদ্ধবিরতি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়েছে। এর পরপরই ভারতের তরফেও তা নিশ্চিত করা হয়।
সমঝোতাটি ‘দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সম্পাদিত হয়েছে’ বলে ভারতের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা খাটো করে ট্রাম্পের দাবিকে কার্যত অস্বীকার করা হয়। ভারতের তথ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, “আরো আলোচনা করার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”
কিন্তু পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বলেছেন, “এই অঞ্চলের শান্তির জন্য নেতৃত্বদান ও সক্রিয় ভূমিকার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।”
আলোচনায় সম্পৃক্ত এক পাকিস্তানি সূত্র সিএনএনকে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে মার্কো রুবিও এই চুক্তি সম্পাদনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন। অস্ত্রবিরতি কার্যকর হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আলোচনায় অনিশ্চয়তা ছিল।
ভাষ্য ভিন্ন কেন?
সিএনএন লিখেছে, দুই পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বীর অস্ত্রবিরতি প্রক্রিয়া নিয়ে পরস্পরবিরোধী ভাষ্যে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
বিশ্লেষকদের মতে, নিজেদের উদীয়মান পরাশক্তি হিসাবে দেখা ভারত সবসময় আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা এড়িয়ে চলে। অন্যদিকে, বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল পাকিস্তান মধ্যস্থতাকে স্বাগত জানায়।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাডসন ইনস্টিটিউটের ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক ড. অপর্ণা পান্ডে বলেন, “ভারত কোনো বিরোধে কখনই মধ্যস্থতা মেনে নেয়নি- তা ভারত-পাকিস্তান বিরোধ হোক, ভারত-চীন বিরোধ হোক বা অন্য যে কোনো বিষয় হোক না কেন।
“অন্যদিকে পাকিস্তান সর্বদাই আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা চেয়েছে, তাই তারা মধ্যস্থতার প্রশংসা করবেই।”
তিনি বলেন, “কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে আলোচনা ও সমাধানের জন্য ভারতের ওপর চাপ তৈরি করাই তাদের একমাত্র উপায়।”
শনিবারের অস্ত্রবিরতির আগে যে লড়াই হয়েছে, তাতে উভয় পক্ষই দাবি, পাল্টা দাবি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য জুগিয়েছে। এখন সংঘাত থেমে যাওয়ায় দুই পক্ষই লড়াইয়ের অর্জন ও সমাপ্তি প্রক্রিয়া নিয়ে জনমত গঠনে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
শনিবার কী ঘটেছে?
সকালের তীব্র লড়াইয়ের পর সন্ধ্যায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা ছিল বেশ বিস্ময়কর।
পাকিস্তান শনিবার ভোররাতে দাবি করে, ভারত তাদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিমান ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। তাদের দাবি, পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর থেকে রাজধানী ইসলামাবাদের কাছাকাছি একটি সামরিক ঘাঁটি পর্যন্ত এই হামলা হয়েছে।
এর জবাবে ভারতের সামরিক বিমান ঘাঁটিগুলোতে পাল্টা হামলা চালানোর কথাও বলেছে ইসলামাবাদ। তাদের সামরিক বাহিনীর ভাষায় বিষয়টি ছিল, ‘চোখের বদলে চোখ’।
কয়েক ঘণ্টা বাদে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বৃহৎ শহর শ্রীনগর ও জম্মুতে বিস্ফোরণের খবর আসে। প্রধানমন্ত্রী শরিফ বলেন, ভারতীয় আগ্রাসনের ‘জোরালো জবাব’ দিয়েছে পাকিস্তান।
চার দিন ধরে একে অপরের ভূখণ্ডে সরাসরি সামরিক হামলা চালানোয় অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন, কার্যকর আন্তর্জাতিক চাপ না থাকলে এই পাল্টাপাল্টি হামলা আরও বাড়বে।
সংকটের নেপথ্যে কী?
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ।
ব্রিটিশ ভারতের রক্তাক্ত বিভাজনে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে পাকিস্তান গঠিত। দুই দেশই কাশ্মীরকে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের দাবি করে, যদিও কাশ্মীরের দুই অংশ দুই দেশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই তারা ওই ভূখণ্ড নিয়ে যুদ্ধে জড়ায়, যা ছিল তিনটি যুদ্ধের মধ্যে প্রথম।
গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পাহাড়ি পর্যটনস্থল পেহেলগামে একদল দর্শনার্থীর ওউপর বন্দুকধারীরা গুলি চালায়। এই হামলায় অন্তত ২৫ ভারতীয় নাগরিক ও একজন নেপালি নিহত হন।
নয়া দিল্লি তাৎক্ষণিভাবে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদে সমর্থনের অভিযোগ তুলে ইসলামাদের ওপর এ ঘটনার দায় চাপায়। পাকিস্তান হামলায় কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা প্রত্যাখ্যান করে।
পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডের দুই সপ্তাহ পর গত বুধবার পাকিস্তান ও তাদের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর অঞ্চলে ধারাবাহিক হামলা চালায় ভারত। ওই অভিযানের নাম তারা দেয় 'অপারেশন সিঁদুর'।
এরপরের সংঘাতের পরিধি আগের লড়াইগুলোর চেয়ে অনেক বিস্তৃত হয়, উভয় পক্ষই একে অপরের ভূখণ্ডের গভীরে হামলা চালায়।
যুক্তরাষ্ট্র কেন সম্পৃক্ত হল?
ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত তীব্র হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জে ডি ভ্যান্স দুই দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তিনি বৃহস্পতিবার ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, “আমরা যেটা করতে পারি তা হল উত্তেজনা কমাতে তাদেরকে খানিকটা উৎসাহিত করার চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু আমরা একটা যুদ্ধের মাঝখানে গিয়ে জড়িয়ে পড়তে পারি না, কার্যত যেটা আমাদের দেখারই বিষয় নয় এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতার বাইরে।”
সেই ভ্যান্সের অবস্থান বদল এই ইঙ্গিত দেয় যে, পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল।
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা সিএনএনকে বলেছেন, শুক্রবার সংঘাত কতটা বাড়তে পারে সে সম্পর্কে আশঙ্কাজনক গোয়েন্দা তথ্য পেয়ে পররাষ্ট্র দপ্তর মনে করে, দুই পক্ষের আলোচনায় ভূমিকা রাখা ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্প নেই।
অস্ত্রবিরতি টিকবে?
সিএনএন লিখেছে, যদিও ভারত ও পাকিস্তান আপাতত সংঘাত থেকে সরে এসেছে, তবে অস্ত্রবিরতি বজায় থাকবে কিনা- তা এখন দেখার বিষয়।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি শনিবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্রবিরতি সমঝোতা বারবার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন। এর আগে ভারত ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর উভয় অংশে বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা যায়।
পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে সমঝোতা লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে, তবে জোর দিয়ে বলে তারা ‘অস্ত্রবিরতির শর্তের বিশ্বস্ত বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’।
পর্যটক হত্যাকাণ্ডের পর দুই দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে ভিসা স্থগিত ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো ব্যবস্থা নেয়। ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ পানিবণ্টন চুক্তি থেকে সরে আসার কথা জানায়। এই পদক্ষেপগুলো প্রত্যাহার করা হবে কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়।