Published : 18 Feb 2023, 05:39 PM
উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় না আসায় মাঠ পর্যায়ে আদেশ বাস্তবায়নে যে জটিলতা দেখা দেয়, সে কথা উঠে এল রাজধানীতে এক ‘মুক্ত আলোচনায়’।
ইংরেজিতে দেওয়ার কারণে রায়ের বিষয়বস্তু, রায়ের কারণ উপলব্ধি করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি স্বয়ং পুলিশ কর্মকর্তারাও পুরোপুরি বুঝতে পারেন না ‘আদেশটা কী’, তাদেরকে ‘কী করতে হবে’।
বিচারপ্রার্থীদের খরচও বেড়ে যাচ্ছে এ কারণে। কারণ, আদালতের ভাষা বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হয় তাদের।
‘আদালতের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন’ বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন’ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এই এক মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে।
সেখানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ইংরেজিতে রায় দেওয়ার পরবর্তী জটিলতার বিষয়গুলো তুলে ধরেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাহিদ ফেরদৌসী।
হাকিম বা জজ আদালতে কিছুক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন থাকলেও উচ্চ আদালতে ইংরেজির প্রাধান্য চলছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ইংরেজি ভাষায় রায় ঘোষণা করলে রায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য রায়ের বিষয়বস্তু, রায়ের কারণ উপলব্ধি করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিচারপ্রার্থী প্রায় সকলেই বাংলা ভাষাভাষী।”
দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে আদালতের রায় ও আদেশে কার জমি কে পেল, কেন পেল, কার অংশ কতটুকু হল, নিষেধাজ্ঞা কোন কোন বিষয়ে বা কতদিন পর্যন্ত দেওয়া হল- এসব বিষয়ে বাংলা প্রয়োগ না করলে ‘রায়ের গুরুত্ব কমে যায়’।
তিনি বলেন, “ফৌজদারি মামলার রায়ে পুলিশ প্রশাসনের জন্য নতুন নির্দেশনা থাকে। শুধুমাত্র ইংরেজিতে রায় হওয়ার কারণে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ অফিসার স্পষ্টভাবে সব জানতে পারেন না। এভাবে প্রায় ক্ষেত্রেই বিচারপ্রার্থীরা আদালতের চিন্তা ও যুক্তির কোনোটাই বুঝতে পারেন না।”
মাতৃভাষায় রায় দেওয়া হলে মামলার বাদী-বিবাদীর রায়ের সারমর্ম বোঝা বা পরিকল্পিত পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সহজ হয় বলেও নিজের মূল্যায়ন তুলে ধরেন আইনের এই শিক্ষক।
ইংরেজিতে রায়ের এই প্রবণতা সংবিধানবিরোধী বলে মনে করেন নাহিদ ফেরদৌসী। তিনি বলেন, “দেশের সকল আদালতই প্রজাতন্ত্রের আদালত। সংবিধানের তিন অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা'। সে অনুযায়ী আদালতসহ প্রজাতন্ত্রের সব কাজ বাংলায় হওয়ার কথা।”
রায় বাংলায় না আসায় তা বিচারপ্রার্থীর খরচ কীভাবে বাড়াচ্ছে তা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “আদালতের সিদ্ধান্ত ও রায় বাংলা ভাষা ব্যতীত ইংরেজি ভাষায় লেখা হলে তা বোধগম্যতার জন্য আইনজীবীদের অতিরিক্ত ফি দিয়ে অনুবাদ করাতে হয়।”
বাংলায় রায় লিখতে প্রণোদনার পরামর্শ
মুক্ত আলোচনায় অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ মো. শাহজাহান বলেন, “আদালতে ইংরেজিতে বললে মনে হয় খুব ভালো লাগে। আসলে এমন না। অন্য শ্রোতা দর্শক যারা থাকেন তারা বুঝতে পারে না। মনে করে ‘কী অর্ডার দিল কিছু বুঝলাম না’। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে- ভাষা কি তাহলে সমস্যা তৈরি করছে?”
বাংলায় রায় লিখতে বিচারকদের উৎসাহী করতে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “অনেকে বলেন- বাংলায় আইনের ভাষার অনেক পরিভাষা নেই। আমাদের বাংলা একাডেমি তো আছেই সেজন্য। এটা বলে তো আমরা বসে থাকতে পারি না। বাংলা ভাষায় রায় দিতে বিচারকদের উৎসাহিত করতে ভাতা দেওয়া যেতে পারে। বাংলায় রায় লিখে কিছু আয়ের সুযোগ তৈরি হলে আগ্রহ বাড়বে।”
তবে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল মতিন রায়ের ভাষা নিয়ে কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার পক্ষে নন। তিনি বলেন, “অর্থ বা ভাতা দিয়ে বাংলা ভাষায় রায় লেখা বা আদালতে বাংলার প্রচলন করা যাবে না। আদালত চলে আইনের মাধ্যমে, আইনের অনুশাসনে। আইনের প্রয়োগ করেই বাংলার প্রচলন করতে হবে।“
বিচারপতি মতিন বলেন, “চাইলে রাতারাতি আদালতের সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন সম্ভব। এটা জনগণকে চাইতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।”
ইংরেজিতে রায় ‘আইনের লঙ্ঘন’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, “সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদ কার্যকরের ক্ষেত্রে ১৯৮৭- এর যে আইন সে অনুযায়ী আমাদের অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান এখন পুরো বাংলায় চলছে, ইংরেজি শূন্যের পর্যায়ে চলে গেছে।”
এরপরেও আইন ও বিচার ব্যবস্থাপনায় কেন তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না- সেই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “এই আইনের ৩ এর ২ উপধারায় বলা আছে- ‘কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে’।”
বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ নিয়েও কথা হয় মুক্ত আলোচনায়। আইনের ৩ এর ১ উপধারায় বলা আছে, ‘বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’
শীপা হাফিজা বলেন, “বিচার কার জন্য- সাধারণ মানুষের জন্য, যারা ইংরেজির দুটো ভাষাও বোঝে না। এই আইনের ভাষা কঠিন করার যে প্রবণতা, তার একটা বৈষয়িক দিক আছে। আইনের ভাষা যত কঠিন হবে, মানুষ তত বেশি তাদের কাছে আসবে। যারা আইন চর্চা করেন, যারা পড়ান- তাদের সবাইকেই এখানে দায়ী করতে হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় ড. মো. আনিসুজ্জামান, লেখক ও গবেষক রাখাল রাহা, ফারুক ওয়াসিফ আলোচনায় অংশ নেন।