Published : 04 Jul 2025, 11:35 PM
টেলিকম খাতের যে খসড়া নীতিমালা নিয়ে বিএনপি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তা পুরনো বা আগের খসড়া বলে মনে করেন প্রধান উপদেষ্টার আইসিটি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
তার ভাষ্য, বিএনপি মহাসচিব যেসব বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন, নতুন খসড়ায় সেসব আপত্তিকে ‘অ্যাড্রেস’ করা হয়েছে।
সরকার ‘টেলিকম নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং রিফর্ম পলিসি-২০২৫’ ঘোষণার ক্ষেত্রে সরকার তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে ‘উদ্বেগ’ জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ফখরুল বলেন, “খসড়া নীতিমালাটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এতে কিছু গুরুতর সমস্যা রয়েছে, যা টেলিকম খাতে সমতাভিত্তিক ও টেকসই উন্নয়ন বাধা হতে পারে।”
এই নীতিমালা ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সরকারের প্রতি আহ্বান রেখে তিনি বলেন, এসএমই, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, গ্রাহক সংগঠনসহ সব পক্ষের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করার পর যেন এই ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়।
বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটায় বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের প্রধান নির্বাহী চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুনের টেলিকম নীতিমালার খসড়া ঘোষণা করার কথা ছিল। তার ঘণ্টা দুয়েক আগে ‘জরুরি’ সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিএনপির আপত্তির কথা তুলে ধরেন দলটির মহাসচিব। এরপর আর সেই নীতিমালা ঘোষণা করা হয়নি।
বিএনপির উদ্বেগে সরকারের প্রতিক্রিয়া
বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে বৃহস্পতিবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের তরফে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবকে বার্তা দেওয়া হলে তিনি অডিও বার্তা পাঠিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন।
অডিও বার্তায় তৈয়্যব বলেন, “বিএনপি মহাসচিবের প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি। আমরা স্বাগত জানাই যে- রাজনৈতিক দলগুলোও পলিসির বিষয়ে সচেতন। প্রথমত আমি বলতে চাই, ওনারা পুরনো একটা খসড়া নিয়ে কথা বলেছেন; যেই খসড়াটা বিটিআরসি মন্ত্রণালয়কে পাঠিয়েছিল মন্ত্রণালয়ের ভেটিং এবং অনুমোদনের জন্য। আমরা মন্ত্রণালয় থেকে একটা কমিটি করেছি, সেই কমিটি নতুন আরেকটি খসড়া করেছে।”
নতুন নীতিমালার কারণে এসএমই খাত আর্থিক সংকটে পড়তে পারে বলে উদ্বেগ জানিয়ে বৃহস্পতিবার ফখরুল বলেছিলেন, “ডি-রেগুলেশনের (নিয়ন্ত্রণ শিথিল) পরে এসএমই, বিশেষ করে স্থানীয় আইএসপি বা ছোট টেলিকম অপারেটরদের সম্পদ ও দায়বদ্ধতা নিয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায় তারা বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়তে পারে।”
এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার আইসিটি বিষয়ক বিশেষ সহকারী বলেন, “নতুন খসড়ায় বিএনপি মহাসচিব বা অন্যরা যেসব প্রশ্ন তুলেছেন, সেগুলোর সুস্পষ্ট উত্তর রয়েছে। যেমন এসএমই’দের (ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা) প্রটেকশন করা, আইএসপিদের যথাসম্ভব ডিরেগুলেট করে লাইট টাচ লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
“আমরা তাদেরকে (আইএসপি) পুরোপুরি ডিরেগুলেট (নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে) চেয়েছিলাম, কিন্তু তারাই আবার এটা চাচ্ছে না। কারণ তারা লাইসেন্সের বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণের সুবিধাটা পেতে চায়। সেজন্য তারা পুরোপুরি ডিরেগুলেট হতে চায় না। তাদের অনুরোধেই আমরা একটা লাইট টাচ লাইসেন্সের আওতায় তাদের এনেছি। তার পরে ডেটা সেন্টার, ক্লাউড পলিসি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে আমরা ডিরেগুলেশনে গিয়েছি।”
বিদেশি বিনিয়োগ প্রসঙ্গ
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে ফখরুল বলেন, “বিদেশি মালিকানার সীমা নিয়ে অস্পষ্টতা আছে, যা বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে পারে এবং এ খাতের স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করতে পারে। ক্রস-ওনারশিপের ফাঁকফোকরে বড় কোম্পানিগুলো আরও বাজার দখল করে নিতে পারে।”
এ উদ্বেগের বিষয়ে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলছেন, “বিদেশিদের ব্যাপারে তিনি (মির্জা ফখরুল) বলেছেন, অনির্দিষ্ট শেয়ার…এই কথাটা সেভাবে সত্য না। আমরা বিদেশিদের মালিকানার ওপরে প্রতি স্তরেই একটা ক্যাপিং করেছি। সেজন্য বিডার কাছে তারা (বিদেশি বিনিয়োগকারীরা) অভিযোগ করেছে। তারা আমাদের কাছেও এটা নিয়ে অভিযোগ করেছে।
“আমরা সার্ভিস লেয়ারে, ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার লেয়ারে, ইন্টারন্যাশনাল লেয়ারে- সবখানেই তাদের বড় ধরনের ক্যাপিং করার চেষ্টা করেছি। যেমন ধরেন, ইন্টারন্যাশনাল লেয়ারে বলেছি তারা সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ মালিকানা রাখতে পারবে। ন্যাশনাল লেয়ারে বলেছি, তারা সর্বোচ্চ ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ মালিকানা রাখতে পারবে। এটা নেগোশিয়েবল এখনো।
“আমরা ৫৫ শতাংশ প্রস্তাব করেছি, বিদেশিরা আরও বাড়ানোর জন্য পুশ করছে। আপনারা জানেন দুটো অপারেটর হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিদেশি হওয়া সত্ত্বেও আমরা সেখানে বলেছি, ৮০ শতাংশের বেশি মালিকানা রাখতে পারবে না বিদেশিরা।
“সুতরাং ওনারা (বিএনপি) যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা পুরনো ভার্সনের উপরে। এই (নতুন) ভার্সনের ওপরে মন্ত্রণালয় কাজ করে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে এবং কনসার্নগুলোকে (আপত্তি) অ্যাড্রেস করা হয়েছে।”
লাইসেন্সিংয়ে বাদ পড়ছে যারা
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলছেন, বিদ্যমান লাইসেন্সিং কাঠামোর একটি স্তর নতুন লাইসেন্সিং কাঠামোতে বাদ পড়তে যাচ্ছে।
এই বাদ পড়তে যাওয়া স্তরে থাকা এনটিটিএন, আইসিএক্স, আইআইজি, আইজিডব্লিউ কোম্পানি গত কয়েকদিন ধরে তাদের উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে।
তাদের ভাষ্য, নতুন লাইসেন্সিং কাঠামোতে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সুরক্ষা দিয়ে দেশি বিনিয়োগ ‘ধ্বংসের’ আয়োজন করা হয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসা আওয়ামী লীগ সরকার টেলিযোগাযোগ খাতে এসব লাইসেন্স দিয়েছিল।
এখন সেবাখাতে মালিকানার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে বড় মোবাইল অপারেটররা একাধিক খাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে বলে মনে করছে বিএনপি।
দলটির মহাসচিব ফখরুল বলেছেন, “বড় মোবাইল কোম্পানিকে এন্টারপ্রাইজ ব্রডব্যান্ড বাজারে প্রবেশ করতে দিলে ছোট কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে এবং একচেটিয়া পরিবেশ তৈরি হবে, যা দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপরেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
“শুধু তাই নয়, নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বড় কোম্পানির সুবিধা বজায় রাখা হয়েছে, যা প্রতিযোগিতা নয়, বরং আধিপত্য বাড়বে।”
বিএনপি মহাসচিব এসএমই ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সম্ভাব্য ক্ষতি, কর্মসংস্থান হ্রাস এবং অর্থনীতির ওপর প্রভাব বিশ্লেষণ করে নতুন নীতিমালা চূড়ান্ত করার আহ্বান জানান।
বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যস্তরে থাকা দেশি কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “ডেটা স্ট্রাকচারের অনেকগুলো স্তরে সামান্য বিনিয়োগ করে যারা অনেকগুলো অর্থ নিয়ে নিচ্ছিল, তাদেরকে আমরা বাদ দিয়ে… অর্থাৎ যারা ভ্যালু অ্যাডিশন তেমন একটা করে না। সামান্য কিছু টাকার ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেপ্লয় করে যারা অনেক টাকা সরিয়ে নিচ্ছিল এই খাত থেকে, আমরা সেই লাইসেন্সগুলো যৌক্তিকভাবে রিমুভ করার চেষ্টা করেছি।
“বাংলাদেশে যে পলিসি আছে এ ধরনের পলিসি বিশ্বের কোথাও নেই। আইসিএক্স নামে যে লাইসেন্সগুলো আছে বা নিক্স নামে একটা লাইসেন্স আছে, এই ধরনের লাইসেন্স বিশ্বের কোথাও নেই। এগুলো হয়েছে ২০০৭-২০০৮ সময়ে বিটিআরসির মনিটরিংয়ের অক্ষমতা ছিল, সেই কারণে কোম্পানিগুলো চুরি-জালিয়াতি করেছে।
“সেগুলোকে অজুহাত করে কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি স্থাপন করে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। সে ধরনের স্তরগুলো যারা কোনো ভ্যালু অ্যাড করে না, তাদের সরিয়ে দিয়ে আমরা লাইসেন্সিং স্ট্রাকচারটা আধুনিক করছি। যেহেতু আগামী ১০ থেকে ১২ বছর এই লাইসেন্স পলিসিটা থেকে যাবে, সেজন্য আমরা মনে করি বিশ্বমানের একটা স্ট্রাকচার দরকার আছে।”
প্রস্তাবিত কাঠামোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আর ২০১৫ সাল থেকে আইটিইউ (আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন) এবং জিএসএমএ (মোবাইল অপারেটরদের আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম) একটা সহজ লাইসেন্সিং ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশের সরকারকে ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে চাপ দিচ্ছিল।
“কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সেটা করেনি। যেহেতু আমাদের সংস্কারের মন মানসিকতা আছে, সেজন্য আমরা বিষয়টাতে গুরুত্ব দিচ্ছি।”
আরও পড়ুন:
‘তড়িঘড়ি’ টেলিকম নেটওয়ার্ক নীতিমালা ঘোষণার সিদ্ধান্তে ‘উদ্বেগ’ বিএনপির