Published : 19 May 2025, 02:20 PM
শেখ হাসিনার গত দেড় দশকের শাসনামলে বিনোদন জগতের মানুষেরা ‘ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠিকে সহযোগিতা করেছে’ বলে অভিযোগ করেছেন ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী।
এছাড়া জুলাই আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনা ‘হত্যা করার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন’, সেই কাজে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যে কোনো স্থান থেকে ‘সহযোগিতা করেছে’ বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।
ঢাকার মহানগর হাকিম সারাহ্ ফারজানা হকের আদালতে হত্যাচেষ্টা মামলায় নুসরাত ফারিয়ার জামিন শুনানিতে সোমবার এ কথা বলেছেন আইনজীবী ফারুকী।
দেশে যাতে আর কোনো ফ্যাসিস্টের ‘জন্ম না হতে পারে’ এ জন্য সেই গোষ্ঠীকে আইনের আওতায় আনারও তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
শুনানিতে চিত্রনায়ক ও ঢাকা-১০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফেরদৌস আহমেদকেও ‘খোঁজা হচ্ছে’ বলে আদালতকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী জানিয়েছেন।
আইনজীবী ফারুকী বলেন, “নাট্যকার, অভিনেতা, অভিনেত্রী এরা সবাই একটা গোষ্ঠী হয়ে গত ১৫ বছর সহযোগিতা করেছে। নাটক, গান, নাচের মাধ্যমে তারা ফ্যাসিস্টকে সহযোগিতা করেছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যেন আর কেউ ফ্যাসিস্টের জন্ম দিতে না পারে।"
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিনোদন জগতের মানুষের ভূমিকা তুলে ধরে শুনানিতে তিনি বলেন, “শাহবাগের আন্দোলনকারীদের ওপর এরা গরম পানি নিক্ষেপ করতে উদ্ধুদ্ব করে। দেশে-বিদেশে থেকে প্ররোচণা দিয়েছে। ফ্যাসিস্টের অন্যতম সহযোগী তারা। তারা তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে ফ্যাসিস্টকে সহযোগিতা করেছে।
“আন্দোলন দমাতে, হত্যা করতে হাসিনা যে নির্দেশ দিয়েছিল, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যেকোনো স্থান থেকে সহযোগিতা করেছে। তাদের মধ্য নুসরাত ফারিয়া একজন। তিনি হামলার সাথে সম্পৃক্ত। তাকে গ্রেপ্তার করতে খুঁজছিল পুলিশ।"
এদিন আদালতে ভাটারা থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এসআই জাকির হোসেন জানিয়েছেনর, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নায়িকাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই বিল্লাল ভূঁইয়া। এ বিষয়ে শুনানি শেষে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় আদালত।
সকাল ৯টার দিকে ফারিয়াকে ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। শুনানির আগে সকাল ১০ টার দিকে পুলিশ প্রহরায় তাকে হাজতখানা থেকে বের করা হয়। এ সময় তার মুখে সাদা মাস্ক, মাথায় হেলমেট ও গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরা ছিল।
ফারিয়াকে সিএমএম আদালতের দোতলায় নেওয়া হয়। এরপর ১০টায় ফারিয়ার হেলমেট খুলে তাকে আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয়।
তখন সাদা মাস্ক মুখ থেকে একটু নামিয়ে তিনি হাঁপাতে থাকেন। নারী পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে পানির বোতল নিয়ে পানি পান করেন ৷ এরপর উল্টো দিকে ফিরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ফারিয়াকে। ১০টা ৫ মিনিটে বিচারক এজলাসে উঠলে ফারিয়া ফিরে তাকান৷
এসময় সামনে ঘুরে কাঠগড়ার রেলিংয়ে দুই হাত রাখেন। শুনানির শুরুতেই এক আইনজীবী নুসরাত ফারিয়ার ওকালতনামায় স্বাক্ষর নিতে আদালতের অনুমতি চান। তখন নুসরাত ফারিয়া আরেক আইনজীবীকে দেখান। পরে আইনজীবী ফারহান মোহাম্মদ আরাভ ওকালতনামা দিলে তিনি স্বাক্ষর দেন। এরপর ১০টা ৮ মিনিটে তার জামিন শুনানি শুরু হয়। এসময় বিচারক সবাইকে নিশ্চুপ থাকতে বলেন।
নুসরাত ফারিয়ার পক্ষে তার আইনজীবী ফারহান মোহাম্মদ আরাভ, মোর্শেদ আলম শাহিন জামিন চেয়ে আবেদন করেন।
শুনানিতে ফারহান মোহাম্মদ আরাভ বলেন, ”তিনি (নুসরাত ফারিয়া) একজন স্বনামধন্য অভিনেত্রী। আন্দোলনের আগে ৯ জুলাই শুটিং করতে কানাডায় যান। সেখান থেকে তিনি ১৪ অগাস্টে দেশে ফিরে আসেন। সেই কাগজপত্র আমরা জমা দিয়েছি৷ তিনি আন্দোলনের স্বপক্ষে ছিলেন, পোস্টও দিয়েছিলেন। এ ঘটনার সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা নেই। তিনি আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত নেই। তার জামিনের প্রার্থনা করছি।"
নুসরাতের আরেক আইজীবী মোর্শেদ আলম শাহিন বলেন, ”ঘটনার সময় তিনি দেশে ছিলেন না, বিদেশে ছিলেন। তাকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো আইনের পরিপন্থি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তাদের কাজ হল ভুল ত্রুটি তুলে ধরা। সেটায় তিনি করেছেন। তাকে উদ্দেশ্যেপ্রণোদিতভাবে মামলায় জড়িত করা হয়েছে। আস্থার সর্বশেষ স্থল আদালত। যে কোনো শর্তে জামিনের প্রার্থনা করছি। তিনি শারীরিকভাবেও অসুস্থ।"
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী জামিনের বিরোধি তা করেন।
ফারুকী বলেন, “নুসরাত ফারিয়া একজন মডেল, নায়িকা। তিনি এজাহারনামীয় আসামি। তদন্তেপ্রাপ্ত না। থাইল্যান্ডে পালিয়ে যাওয়ার সময় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গেলে ইমিগ্রেশন পুলিশ নুসরাত ফারিয়াকে আটকে দেয়। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, তিনি জননন্দিত, স্বনামধন্য নায়িকা। আরেকজন স্বনামধন্য নায়ক আছেন ফেরদৌস। আমরা তাকেও খুঁজছি। তিনি ঢাকা-১০ আসন থেকে নির্বাচন করেছিলেন।"
ওমর ফারুক বলেন, “ফ্যাসিস্টরা কি করে। দেশের নায়ক, নায়িকা, ফুটবলারদের পিক আপ করে দলে নেয়। আর ফ্যাসিস্টদের লোভে পড়ে তারাও অনেকে চলে যায় আনুকূল্য পাওয়ার জন্য, উচ্চ পর্যায়ে যেতে। সেও পলককে অবলম্বন করেছে এবং সেখানে গিয়েছে।"
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নির্ভর ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ফারিয়া।
প্রয়াত ভারতীয় নির্মাতা শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় সিনেমাটি তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায়। ২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়া এ সিনেমায় ফারিয়া ছাড়াও আরিফিন শুভ, নুসরাত ইমরোজ তিশা, রিয়াজ আহমেদসহ আরও অনেকে অভিনয় করেছেন।
এই সিনেমার প্রসঙ্গে ফারুবী বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিকে হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করা ফারিয়ার জন্য দোষের নয়।
“নুসরাত ফারিয়া বলেছেন, প্রতিটা ঘরে একজন হাসিনা রয়েছে। মানে প্রতিটা ঘরে ফ্যাসিস্ট রয়েছে। প্রতিটা ঘরের মেয়েরা কি ফ্যাসিস্ট? এধরনের বক্তব্য উসকানিমূলক। হাসিনাকে খুশি করতে বক্তব্য রেখেছেন। ফ্যাসিস্টের পক্ষে কথা বলতে উদ্ধুদ্ধ করেছে। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী হতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।'
ফারিয়া ‘অনলাইনে জুয়া খেলেন’ জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, “ছাত্র সমাজ, যুব সমাজ অনলাইন জুয়ার কারণে নষ্ট হচ্ছে। অনলাইনে সে নিজেও জুয়া খেলে। আবার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। একটা গান দেখেছি 'সবাই মিলে খেলব, আনন্দ করে ফিরব। এধরনের জুয়ার অ্যাপসের কারণে যুব সমাজ নষ্ট হচ্ছে।'
বিনোদন জগতের মানুষদের এখনকার ভূমিকা নিয়ে ফারুকী বলেন, “তারা কিন্তু বসে নাই। দেশে অশান্তি সৃষ্টি করতে কাজ করতে। ফ্যাসিস্টকে ফিরিয়ে আনতে গুপ্ত মিছিল করে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। আসামি জামিন পেলে আবার ষড়যন্ত্র করবে, ফ্যাসিস্ট ফিরিয়ে আনতে কাজ করবে, মামলার তদন্তের ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। তার জামিনের বিরোধিতা করছি।"
ঘটনার সময় নুসরাত ফারিয়া দেশের বাইরে ছিলেন কি না, আন্দোলনের পক্ষে পোস্ট করেছেন কি না-এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন বিচারক। প্রতিবেদন পাওয়ার পর জামিনের বিষয়ে ২২ মে ফের শুনানি হবে।
থাইল্যান্ড যাওয়ার সময় রোববার সকালে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হন নুসরাত ফারিয়া।
এনামুল হক নামের এক ব্যক্তি গত মার্চ মাসে নায়িকা নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, নিপুণ আক্তার, আশনা হাবিব ভাবনা, নায়ক জায়েদ খানসহ ১৭ অভিনয়শিল্পীসহ ২৮৩ জনের নামে আদালতে মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে ভাটারা থানা গত ২৯ এপ্রিল তা এজাহার হিসেবে লিপিবদ্ধ করে।
মামলার বিবরণ অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯ জুলাই ভাটারা থানার সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। এসময় গুলি চালানো হলে তা এনামুলের পায়ে গুলি লাগে। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
আরও পড়ুন:
নায়িকা নুসরাত কারাগারে, জামিন শুনানি ২২ মে
আদালতে নুসরাত, কারাগারে আটক রাখার আবেদন