Published : 21 May 2025, 11:37 PM
যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতিতে ‘করিডোর’ তৈরির কোনো প্রয়োজনীয়তা না থাকার কথা তুলে ধরে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, সেখানে শুধু ত্রাণ পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
বুধবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন খলিলুর, যিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সংকট ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়ক সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের দায়িত্বেও রয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমি জানি, মিয়ানমারে জাতিসংঘের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশের একটা করিডোর দেওয়ার যে গুজবটা উঠেছে, আমি দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলে দিচ্ছি, করিডোর নিয়ে আমাদের সঙ্গে কারোর কোনো কথা হয় নাই। এবং তাদের সঙ্গে কথা হবে না।
“করিডোরের ব্যাপারটি বুঝতে হবে। করিডোর হচ্ছে, একটা জরুরি সময়ে দুর্যোগপূর্ণ জায়গা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা। আমরা এখানে কাউকে সরাচ্ছি না।”
দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে থাকা রাখাইনের অধিবাসীদের জন্য মানবিক সহযোগিতা পাঠানোর ব্যবস্থা করতে জাতিসংঘ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যেহেতু আরাকানে কোনো সাহায্য সহযোগিতা, ত্রাণ উপকরণ, অন্যান্য সরবরাহের পথ দিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে জাতিসংঘ সেটার একটা প্রস্তাব দিয়েছে।
“তারা বলল, এর কিছুটা যদি সীমান্ত পেরুতে আপনারা এটাতে আমাদেরকে সাহায্য করবেন, যাতে আমরা ত্রাণ নিয়ে যেতে পারি। জাতিসংঘ তার বিভিন্ন সহযোগীদের মাধ্যমে রাখাইনের ভেতরে যে চ্যানেলগুলো আছে, সেটার মধ্য দিয়ে তারা এই মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেবেন, রাখাইনের জনগণের জন্য।”
সরকার কোন অবস্থান থেকে রাজি হয়েছে, তা তুলে ধরে খলিলুর বলেন, “আমি আবারও বলছি, দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে বলছি এবং আপনারা সেটা গ্রহণ করুন, রসদ পাবেন, যোগাযোগ করলেই পাবেন, জাতিসংঘকে জিজ্ঞেস করেন, জাতিসংঘের স্ব স্ব রাষ্ট্রকে জিজ্ঞেস করেন– আমরা করিডোর নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলি নাই এবং আমরা বলব না।”
তিনি বলেন, “আরাকানের যে অবস্থা, তাতে করিডোরের কোনো প্রয়োজন নাই। আমরা কোনো করিডোর সৃষ্টি করে সেখানে কোনো ধরনের লোকজনের যাতায়াতের ব্যবস্থা, সেটা করার এখন কোনো প্রয়োজনীয়তা নাই। যেই প্রয়োজনীয়তা আছে, সেটা হচ্ছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া।”
মিয়ানমার ও রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রক আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আলোচনা এগোনোর কথা তুলে ধরে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, সবাই একমত হয়েছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান। প্রথমবারের মত মিয়ানমার সরকার ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন যোগ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। এখন প্রত্যাবাসন কোন প্রক্রিয়ায় হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারলে, পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হবে- এমন ধারণা করার কথা তুলে ধরে হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ বলেন, “এবং আমরা সেই অবস্থাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করতে পারব।
“আরাকানের অবস্থা যতদিন অস্থিতিশীল থাকবে, ততদিন আমরা প্রত্যাবাসনের কথা বলতেই পারব না। আর প্রত্যাবাসনের কথা যদি না-ই বলতে পারি, তাহলেতো প্রত্যাবাসন কৌশল নিয়েও কোনো কথা বলতে পারব না। সুতরাং, প্রত্যাবাসন কৌশলের যে পূর্বশর্ত আমরা সেখানে আসি নাই।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘করিডোরের’ মত জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে যে সমালোচনা হচ্ছে, তার জবাবও দেন খলিলুর রহমান।
তিনি বলেন, “অনেকে বলেছেন, করিডোর নিয়ে আপনারা কথা বলছেন, সবার সঙ্গে আলাপ করেন নাই। অস্তিত্ববিহীন জিনিস নিয়ে আমরা কি করে আলাপ করব? যেটার অস্তিত্ব নেই, সেটা নিয়ে আলাপ কি করে হয়?
মিজোরাম থেকে ত্রাণ দেওয়ার প্রস্তাব জাতিসংঘ ভারতকে দিয়েছিল কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “মিজোরাম দিয়ে যদি দিতে পারত, তাহলে কালাদান প্রজেক্টের কী দরকার হত, আমাকে তাই বলেন? এটাতো উল্টো যাচ্ছে। কলকাতা থেকে সিতওয়েতে আসছে, সিতওয়ে থেকে মিজোরামে যাচ্ছে। উল্টোটা যদি সম্ভব হত, তাহলে কালাদানেরই প্রয়োজন ছিল না।
“জাতিসংঘ কোন দেশের সঙ্গে কী আলোচনা করেছে, আমরা কী করে বলব। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি যে, অন্য কোনো চ্যানেল নাই। এখন দেব কি, দেব না- এটা আমাদের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত।”
জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয় ইতোমধ্যে বলেছে, আন্তঃসীমান্ত ত্রাণ পাঠানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুদেশের সম্মতি নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে জাতিসংঘের।
ত্রাণ পাঠানোর এই প্রক্রিয়া মিয়ানমার সরকার অনুমোদন করেছে কি না, এমন প্রশ্নে খলিলুর বলেন, “সবকিছু কিন্তু পাবলিক ডিপ্লোমেসির ব্যাপার নয়। কোনো রাষ্ট্রই সবকিছু আলোচনা করবে না।
“আপনারা যদি দেখেন, আপনারা যদি দেখেন সাহায্য সেখানে যাচ্ছে, ধরে নেবেন সেখানে দুপক্ষের সম্মতি আছে। হলে ধরে নেবেন। এছাড়া আমরাও দেব না, ওরাও নেবে না, জাতিসংঘও এর মধ্যে যাবে না- এটা মনে রাখবেন।”
তিনি বলেন, “জাতিসংঘ হচ্ছে, ১৯০টির বেশি দেশের সংস্থা, তারা এ সমস্ত অ্যাডভেঞ্চারে যায় না। আপনি কোথাও দেখাতে পারবেন না।”
ত্রাণের নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে থাকবে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “পুরো কন্ট্রোল জাতিসংঘ করবে, পুরোটার দায়িত্ব। এমনকি ওপারে গিয়ে যে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, সেটাও তাদের দায়িত্ব। এটা আন্তঃসীমান্ত, আমরা চেষ্টা করব, সীমান্তটা নিয়ন্ত্রণ করতে, যাতে তারা জিনিসটাকে নিয়ে যেতে পারে নিরাপদে।
“এবং আমাদেরকে দেখতে হবে, এই প্রক্রিয়াকে কোনো মাদক যাওয়া-আসা করছে কি না, অস্ত্রশস্ত্র যাওয়া-আসা করছে কি না, সেই নিরাপত্তার বিষয়গুলো আমাদেরকে দেখতেই হবে।”
দক্ষিণ সুদানের মত মিয়ানমারের সংঘাতে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “জাতিসংঘ এ ধরনের ঘটনায় নিরাপত্তা পরিষদের সম্মতি ছাড়া কিছু করতে পারে না।
“এখন আপনি আমাকে বলেন, যদি মিয়ানমারকে কেটে আরাকান বের করে নিতে হয়, চীন ও রাশিয়া কি ভোট দেবে? তাদেরতো দুইটা ভিটো আছে। নিরাপত্তা পরিষদে এ বিষয়ে প্রস্তাব পাসের চেষ্টা বেশ কিছু কাল ধরে বেশ কিছু দেশ করছিল। কিন্তু চীন-রাশিয়া এটাতে একেবারেই সম্মত না।”
তিনি বলেন, “আমি বলছি না, রাখাইনকে কেটে দাও। আমি বলছি, রাখাইনের যে মানবিক অবস্থা, সেটা নিয়ে একটা প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল বিভিন্ন দেশ। কিন্তু সেটার সমর্থন চীন ও রাশিয়া দেয় নাই।”
রাখাইনে মানবিক সহায়তা ‘চ্যানেল’ দেওয়ার বিষয়ে আমেরিকার চাপ অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর থাকার আলোচনা নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমেরিকা কেন, আমরা কারও চাপের মুখে নাই। কেউ আমাদেরকে কোনো চাপ-টাপ দিচ্ছে না। আমরা সবার সঙ্গে কথা বলেছি, আমেরিকা, চীন- তারা আছেন সেখানে অংশীদার, তাদের সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। আমাদের উপরে কোনো চাপ নাই। যেটা নাই, সেটার কোনো চাপ আমরা অনুভব করতে পারি না।”
রাখাইনের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ত করার শর্ত দেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আরাকান আর্মি যদি জাতিগত নিধন চালিয়ে যায়, একটা বর্ণবাদী রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রয়াস করে, আমরা যদি তার ইঙ্গিত দেখি, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নাই। ভাই, হিসাব সোজা।”
খলিলুর রহমান বলেন, “হিসাব আমাদের সহজ, সেটা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়া। এবং তারা গিয়ে যেন আবার ফেরত চলে না আসে। এটা টেকসই প্রত্যাবাসন হতে হবে। তারা যাবেন এবং সেখানে যাবেন। সেই কাজটি করতে হলে রাখাইনে যে প্রশাসন গড়ে উঠেছে, সিকিউরিটি ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে, তাতে যদি রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি না থাকে আনুপাতিক হারে, তাহলে তারা সেখানে যাবেন কেন? ভবিষ্যতে যে এটা আবার হবে না, সেটার গ্যারান্টি কে দেবে? কেউ তো দেবে না।”
তিনি বলেন, “আজকে যারা গেলেন, কালকে আবার জাতিগত নিধন করে ফেরত পাঠাল, সেভাবে হবে না রে ভাই। এটা হতে হবে টেকসই প্রত্যাবাসন। আমরা বারেবারে এই সমস্ত ফাজলামো সহ্য করতে পারব না।
“তাদেরকে সেখানে যেতে হবে এবং থাকতেও হবে। এবং সে ধরনের অবস্থা তৈরি করতে হবে। সেটা যদি তৈরি করা না হয় এবং সে অবস্থায় যদি বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠায়, তা হবে সাংঘাতিক রকমের দায়িত্বহীন কাজ।”
মিয়ানমার যদি রাজি থাকে, তাহলে অভ্যন্তরীণভাবে কিংবা সিতওয়ে বন্দর দিয়ে সহায়তা যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে না কেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমরা বিবেচনা করব। এর সঙ্গে আমাদের সব কিছু দেখতে হবে। আমাদের ভূখণ্ড ছাড়া অন্যভাবে যদি যাওয়া যায়, তাহলে সেভাবে যাবে।
“মিয়ানমার এ পর্যন্ত যুদ্ধের কারণে কোনো জায়গা খুলতে চায়নি। এটা তাদের জন্য একটা ট্যাকটিক্যাল বা স্ট্যাটেজিক সমস্যা হতে পারে। এবং তারা যদি খুলতে না চায়, আমরাতো জোর করে খোলাতে পারব না। তাই না?”
তিনি বলেন, “আমারতো স্বার্থ আছে। যদি দলে দলে লোক না খেয়ে থাকে, আমার ঘরে ঢুকে যায়, মুশকিলের কথা রে ভাই। তবুও আমরা বলেছি যে, এটা হবে আমাদের শর্তাবলীর আলোকে, আমাদের স্বার্থ রক্ষা করে।”
রাখাইনে মানবিক সহায়তা কোন রুট দিয়ে যাবে, কীভাবে যাবে, তা এখনও ঠিক হয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, “রোগীতো এখনো হাসপাতালেই যায়নি। চিকিৎসা কীভাবে হবে? এসব নিয়ে এখনো আলোচনাই শুরু হয়নি।”
জাতিসংঘের উদ্যোগের সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত দেওয়ার কথা তুলে ধরে নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, “প্রথম কথা হচ্ছে যে, যেটা জাতিসংঘের তরফ থেকে আরাকান আর্মিকে জানানো হয়েছে যে, এই সাহায্য বা সহযোগিতা এটার বিতরণের ব্যাপারে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।
“এটা বৈষম্যহীন হতে হবে, কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। ত্রাণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এটা কোনো যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করা যাবে না।”
তিনি বলেন, “আমাদের তরফ থেকে শঙ্কা হচ্ছে এই, আরাকানে নতুন যে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে, আমরা সেখানে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণের চিহ্ন দেখছি না।
“আমরা আরাকান আর্মিকে সরাসরি বলে দিয়েছি যে, এখন যে অবস্থায় আছে, যে ছবিটা আমরা দেখছি, আরাকান প্রশাসনের, সেটা হচ্ছে, জাতিগত হত্যা হয়ে গেলে যা হত। আমরা কোনো ধরনের জাতিগত হত্যা সহ্য করব না।
“তারা যদি শুধুমাত্র রাখাইনদের নিয়ে রাজ্য পরিচালনা করতে চান, তাহলে সেটা হবে একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র। সেটা আমরা মেনে নিতে পারি না। তাদেরকে কথাগুলো বলা হয়েছে, যে তারা সদুত্তর দেবে। আমরা এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে চাই।”