Published : 01 Jul 2025, 01:38 AM
“এই শহরে পাখিদের ঘুম ভাঙ্গে গুলির শব্দে এই শহরে ছাত্র পড়ে থাকে মগজ ভর্তি বারুদের গন্ধে।”
কারফিউয়ের মধ্যে আতঙ্কিত ঢাকার হাসপাতাল মর্গে উপচেপড়া লাশ আর আহতের ভিড়। বারুদের গন্ধভরা সেই জুলাইকে এভাবেই বয়ান করেছিলেন ‘ঋষি কাব্য’ নামে পরিচিতি পাওয়া কাজী আশরাফ আহমেদ রিয়াজ।
২৯ জুলাই ফেইসবুকে কবিতাটি পোস্ট করার দুদিনের মাথায় মোহাম্মদপুরের বসিলার ভাড়া বাসায় তার লাশ পাওয়া যায়। কীভাবে ঋষি কাব্যর মৃত্যু হল, সেই রহস্য এখনো অজানা।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে এসে সারা বাংলাদেশ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়া কোটা সংস্কারের আন্দোলনটি বলতে গেলে এক দশকের বেশি সময় ধরে চলে আসছিল। তবে ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন গতি পায়।
এ বিষয়ে হাই কোর্টে একটি মামলা ঘিরে ২০২৪ সালের জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়, জুলাইয়ে তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে দেশের অন্যান্য স্থানে।
মাঝ জুলাইয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক মন্তব্য আন্দোলনকে আরও উসকে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন একটা পর্যায়ে টেনে নিয়ে যায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা।
ছাত্রদের লক্ষ্য করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলির মুখে এই আন্দোলনে যুক্ত হন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক, এমনকি চাকরিজীবীরাও। আন্দোলন রূপ নেয় এক দফায়– শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ।
সংঘাত আর রক্তপাতের মধ্যে জুলাই পেরিয়ে আন্দোলন প্রবেশ করে অগাস্টে। তবে আন্দোলনকারীরা বলে ওঠেন, তাদের লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জুলাই মাস শেষ হবে না। তারা গুনতে থাকেন ৩১ জুলাই, ৩২ জুলাই…।
হাজারখানেক ছাত্র-জনতার প্রাণ ঝরে যায়। আহত হন আরও কয়েক হাজার মানুষ। অবশেষে জুলাই মাস শেষ হয় ‘৩৬ দিনে’।
১৫ বছর ধরে বাংলদেশের শাসন ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা ৫ অগাস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। শুরু হয় শেখ হাসিনাবিহীন এক নতুন বাংলাদেশের যাত্রা।
কোটা না মেধা?
শেখ হাসিনার আমলেই সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে অন্তত তিন দফা আন্দোলনে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। সংঘাতও হয়েছে বিস্তর। পুলিশ আর ছাত্রলীগের যৌথবাহিনীর হাতে বেদম মার খেয়েছে আন্দোলনকারীরা। মামলাও হয়েছে অনেকের নামে।
কোটা আন্দোলনের যে পথ ধরে ২০২৪ সালে ইতিহাসের বাঁকবদল ঘটে গেছে, তারও ১১ বছর ২০১৩ সালের জুলাইতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মিছিলে প্রথমবার হামলার ঘটনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
ওই বছরের ১১ জুলাই ৩৪তম বিসিএস’র প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলাফল ও কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমে হামলার মুখে পড়ে শিক্ষার্থীরা। সেদিন তারা শাহবাগও অবরোধ করেছিলেন। পুলিশের পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও। সেদিন উপাচার্যের বাসভবন, প্রক্টরের কার্যালয়সহ বেশ কিছু স্থাপনা ও যানবাহনে ভাঙচুর চালান আন্দোলনকারীরা।
এর মাঝে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে মামলা হয়েছে, ছোট-খাট বিক্ষোভ হয়েছে। তবে বড় সংঘাতের ঘটনাটি ঘটে ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল। ওই সংঘাতের মধ্য দিয়েই সামনে আসে নুরুল হক নূরের ‘ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ এর নাম।
সেদিন সরকারি চাকরির কোটা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের রাতভর সংঘাত চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এরমধ্যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে ঢুকে ব্যপক ভাঙচুর চালায়।
সারা রাতের সংঘাতে আহত হয়ে দেড়শর বেশি আন্দোলনকারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ছাত্রলীগ গুলি ছোড়ে বলেও অভিযোগ ওঠে।
২০১৮ সালের এপ্রিলের পর থেকে নিয়মিত বিরতিতে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে কোটা সংস্কারের বিষয়টি। সেই পথ ধরেই পরে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন নুরুল হক নূর। কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরেক নেতা আখতার হোসেন তখন ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক হয়েছিলেন।
সেই সময়ে হামলা-মামলার শিকার হয়েছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের অনেক নেতা-কর্মী।
২০১৮ সালের ২ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হাতুড়ি হামলার শিকার হয়েছিলেন ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তৎকালীন যুগ্ম-আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম। তার ডান পা ভেঙেছিল, মাথায় লেগেছিল ৯টি সেলাই।
তরিকুল এখনো ঠিকমত হাঁটতে পারেন না। যে সরকারি চাকরির জন্য আন্দোলন করেছিলেন, সেটাও পাননি। এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে শরীরের বাসা বাঁধা ব্যথা-বেদনা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে তার জীবন।
গত শুক্রবার তরিকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লাইফটা আসলে খুব বেশি ভালো যাচ্ছে না। ওই ঘটনার পর একদম অন্যরকম হয়ে গেছে জীবন। আস্তে আস্তে হাঁটতে পারি। জোরে পা ফেলতে পারি না। পায়ের ব্যথা এখনো যায়নি। শরীরেও ব্যথা হয়। ওষুধের ওপর থাকতে হয়।”
গণ অধিকার পরিষদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান সেই সময়ে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা হিসেবে নুরুল হকের সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। রাশেদ বলছেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে তারা যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেই সময় তারা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাননি।
তাদেরকে বিএনপি-জামায়াত ইত্যাদি নানা ‘ট্যাগ’ দিয়ে ইচ্ছেমতো নিপীড়ন করেছে হাসিনা সরকার। হামলা-মামলা মাথায় নিয়ে লড়ে যেতে হয়েছে তাদের। ফেইসবুকে ইভেন্ট খুলে জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করা অর্থ দিয়ে তরিকুলের মতো নিপীড়িত ও আহত সতীর্থদের চিকিৎসা করাতে হয়েছে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সে সময় অনেক কিছু করতে পারেননি তারা।
সে সময় যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, ২০২৪ এর কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারাই পরে আন্দোলনকে সরকার পতনের এক দফায় রূপ দেন। ২০২৪ সালের জুন মাসে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনটি জুলাই থেকে পরিচালিত হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’- এর ব্যানারে।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াসহ বেশ কয়েকজন এক সময় ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
আসিফ মাহমুদ তার লেখা ‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ বইটির প্রথম লাইনটি শুরু করেছেন ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের কথা দিয়ে। তিনি লিখেছেন, “ছাত্র রাজনীতিতে আমার যাত্রা শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে।”
ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রাক্তন সভাপতি আসিফ মাহমুদ অবশ্য তার বইয়ে ২০২৪ সালের আন্দোলনে তার সাবেক দলের নেতা নুরুল হক বা রাশেদ খানদের ভূমিকা নিয়ে কিছু লেখেননি।
তবে রাশেদ খান বলছেন, ২০২৪ সালের আন্দোলনে তারা ছাত্র সমন্বয়কারী এবং মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটি করেছেন।
“এই গণঅভ্যুত্থানে যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে তারাও তো আমাদের সঙ্গে ২০১৮ সালে ছিল। পরে ডাকসু নির্বাচন করেছে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত অধিকাংশই আমাদের সাথে রাজনীতি করেছে। যার কারণে তাদের সাথে আমাদের একটা ভালো সমন্বয় ছিল।
“দ্বিতীয়ত হল এদিকে বিএনপিসহ ৪৪টি রাজনৈতিক দল আমরা যুগপৎ আন্দোলন করেছি। যার কারণে আমরা ছাত্র নেতৃত্বে আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্রিজ হয়ে কাজ করতে পেরেছি।”
রাশেদ খান বলেন, “জুলাই আন্দোলনে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাটা শুরু হয় মূলত হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর। যখন অসংখ্য মায়ের বুক খালি হল, তখন এখানে রাজনৈতিক সম্পৃক্তটা অবধারিত হয়ে ওঠে। তখন হাসিনার পতনের আন্দোলনটা শুরু হয়। আমরা ২০১৮ এর আন্দোলনের সিনিয়র হওয়ার কারণে এদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার কাজটা আমাদের জন্য সহজ হয়েছে।”
৫ জুনের সেই রায় ও পূর্বাপর
২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫৬ শতাংশ পদে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত ছিল। ওই বছর জাতীয় নির্বাচনের আগে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। এরপর ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে টানা চতুর্থবার আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় বসার পর ওই রিট আবেদনের নড়াচড়া শুরু হয়। ২০২৪ সালের ৫ জুন সেই আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাই কোর্ট।
৫ জুনের ওই রায় নিয়ে আসিফ মাহমুদ তার বইয়ে লিখেছেন, “এটা ছিল আমাদের জন্য খুবই কষ্টকর অনুভূতি। কারণ, আমাদের দীর্ঘ লড়াইয়ের অর্জনগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে।… সে সময় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিল ছিল ছাত্রদের উল্লেখযোগ্য একটি অর্জন।”
ওই রায়কে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকারের ‘পরিকল্পনার অংশ’ মনে করা আসিফ মাহমুদ তার বইয়ে লিখেছেন, “মনে হচ্ছিল, ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি ডামি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ আরও শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে দলটির যে ক্ষতিগুলো হয়েছিল সেগুলোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে।”
২০২৪ সালের নির্বাচনের পরপর কোটা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের এই নড়াচড়াকে পুরোপুরি পরিকল্পিত মনে করেন রাশেদ খানও।
তিনি বলেন, “এটা ফিরিয়ে আনার পেছনে হাসিনার একটা জেদ ছিল, যে এটা ফিরিয়ে আনতেই হবে। সে বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করেছিল। কিন্তু যখন সে তার কথিত ‘স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে’ সরকারি চাকরিতে ঢোকাতে পারছে না তখন সে পরিকল্পিতভাবে ৫ জুনের রায়টা নিয়ে আসে। কিন্তু তাদের এই নষ্ট পরিকল্পনার ফাঁদে যে নিজেরাই পড়বে এটা তারা কল্পনায় রাখেনি।”
সেই রায় প্রত্যাখান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করেন নাহিদ-আসিফরা। পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ দেখান।
ওই বছরের ৯ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ঈদ ও রোজার কারণে আন্দোলন তেমন জমেনি। মূলত ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক বিক্ষোভ ও সমাবেশের মধ্যেই কর্মসূচি সীমাবদ্ধ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জুন মাসে আন্দোলন হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে। ১ জুলাই থেকে এই আন্দোলন শুরু হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে।
ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৫ জুন পরবর্তী ৬১ দিনের মধ্যে প্রথম ৪০ দিন দেশের নানা জায়গায় আন্দোলন হলেও জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে শিক্ষার্থীদের মিছিলে ছাত্রলীগের হামলা, পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে; শুরু হয় জ্বালাও-পোড়াও।
জুলাইয়ের ঘটনাপ্রবাহ
১ জুলাই: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। বিক্ষোভ হয় ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
৭ জুলাই: সারাদেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করা হয়। ব্যাপক বিক্ষোভ-অবরোধে অচল হয়ে যায় রাজধানী। পরের দিনও ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
৯ জুলাই: সারাদেশে সড়ক ও রেলপথের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সকাল-সন্ধ্যা ব্লকেড অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কোটা বহাল রেখে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে আইনজীবীর মাধ্যমে পক্ষভুক্ত হন দুই শিক্ষার্থী।
১০ জুলাই: কোটা পুনর্বহাল করে হাই কোর্টের আদেশের ওপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা, ৭ অগাস্ট পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ।
সেই সংবাদ সম্মেলন এবং অতঃপর
১৪ জুলাই: কোটা পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়ে হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ। ওইদিন গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য ক্ষোভ আরও উসকে দেয়। এক প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা (চাকরি) পাবে?”
তিনি সাফ জানিয়ে দেন, কোটার সমাধান দেবে আদালত, অশান্তি হলে আইন চলবে নিজের গতিতে।
ওইদিন গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে মিছিল বের হয়। ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান উঠলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে।
১৫ জুলাই: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগসহ সরকার সমর্থকরা। নিরীহ ছাত্রীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলার ছবি আর ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় সাধারণ মানুষ। দেয়ালে দেয়ালে স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান দিয়ে গ্রাফিতি আঁকা শুরু হয়।
১৬ জুলাই: আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল দায়ের। সড়ক অবরোধ, সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে এবং অন্তত ছয়জনের প্রাণহানি হয়।
তাদের মধ্যে একজন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদ প্রাণ হারান ‘পুলিশের গুলিতে’। দুই হাত প্রসারিত করে রাখা আবু সাঈদকে গুলি করার ছবি ও ভিডিও মানুষের মনে ক্ষোভ সঞ্চার করে।
পরে সারাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধের ঘোষণা আসে। ওই রাতেই ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের বের করে দিয়ে কক্ষ ভাঙচুর করা হয়।
১৭ জুলাই: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজা করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়।
সেদিন বিক্ষোভের কেন্দ্র ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; উচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান তিনি।
রাতে যাত্রাবাড়ী এলাকায় সংঘাতের সূত্রপাত হয়, পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়ে; নিহত হন এক সাংবাদিকসহ কয়েকজন। যাত্রাবাড়ীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ওই রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ফেইসবুক।
১৮ জুলাই: আন্দোলনে সহিংসতা অব্যাহত। মেরুল বাড্ডায় পুলিশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, পরে হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করা হয়। বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ চলে।
পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ কয়েকজন হতাহত হন। ৫৬ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ কোটার প্রস্তাব দেয় আওয়ামী লীগ।
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সরকার রাজি বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রাত ৯টা থেকে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৯ জুলাই: ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ, পরিস্থিতি থমথমে। মেট্রোরেল স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গ্রেপ্তার। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় সর্বক্ষেত্রে স্থবিরতা। রাত ১২টা থেকে কারফিউ জারি। সারা দেশে সংঘর্ষে অন্তত ৫৬ জন নিহত হন।
প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া’, দুই মন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবি দিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন আন্দোলনকারীদের তিন নেতা। সেখানে ৮ দফা দাবি তুলে ধরেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম।
বৈঠকে সরকারের তরফে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত উপস্থিত ছিলেন।
২০ জুলাই: কারফিউয়ের মধ্যেও ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘাত চলে। বহু বিক্ষোভকারী হতাহত হন।
আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়কারীর বৈঠক হয় এদিন। আন্দোলনকারীরা আট দফা দাবি পেশ করেন। এই বৈঠক নিয়ে সমন্বয়কদের মধ্যে মতভেদের খবর আসে। সহিংসতায় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে অন্তত ২৬ জন নিহত হন।
২১ জুলাই: আপিল বিভাগের শুনানির পর কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাই কোর্টের রায় বাতিল করা হয়। মেধা ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটা ১ শতাংশ করার আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। তবে সরকার চাইলে বদলানোর সুযোগ রাখা হয়।
রায়ের পরও পরিস্থিতি শান্ত না হওয়ায় কারফিউ অব্যাহত থাকে, সাধারণ ছুটির আওতায় স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-সহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পোশাক কারখানাসহ সব কলকারখানা বন্ধ রাখা হয়।
২২ জুলাই: কমপ্লিট শাটডাউন ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। এই সময়ের মধ্যে তারা চার দফা দাবির বাস্তবায়ন দেখার জন্য সরকারকে আলটিমেটাম দেন।
সাধারণ ছুটির মেয়াদ মঙ্গলবার পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা আসে। কারফিউও বাড়ানো হয় এদিন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতায় চার দিনে অন্তত ১৩১ জনের নিহত হওয়ার খবর আসে সংবাদমাধ্যমে। পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের খবর আসে।
২৩ জুলাই: রাতে অগ্রাধিকার বিবেচনা করে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা ফেরে। পরদিন রাতে সারা দেশে বাসাবাড়িতেও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা সচল হয়।
২৪ জুলাই: নির্বাহী আদেশে তিনদিন সাধারণ ছুটির পর অফিস খোলে। কারফিউ শিথিলের সময় বাড়ানোয় বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত অফিস কার্যক্রম চলে।
২৬ জুলাই: আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যান শেখ হাসিনা। মেট্রোরেল স্টেশন, বিটিভি ভবনে ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তার কান্না মানুষ ভালোভাবে নেয়নি।
পুলিশের গুলিতে শত শত মানুষের হতাহত হওয়া নিয়ে দুঃখ প্রকাশ না করে শেখ হাসিনা ওখানে গিয়ে কেঁদেছেন, তার এই ভূমিকাকে ‘নাটক’ আখ্যা দেন অনেকে। কান্নারত শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে বানানো মিম ছড়িয়ে পড়ে, যার ক্যাপশন ছিল ‘নাটক কম কর পিও’।
ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জ্মান খান কামাল বলেন, তাদের আটক করা হয়নি। নিরাপত্তার জন্য হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
২৭ জুলাই: প্রধানমন্ত্রী আহতদের দেখতে যাননি- এমন সমালোচনার মুখে আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান শেখ হাসিনা। বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করতে এই ধ্বংসযজ্ঞ।
২৮ জুলাই: কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ নিহতদের একটি অংশের পরিবারের সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ করেন শেখ হাসিনা। পরে জানা যায়, চাপের মুখে তাদের গণভবনে নিয়ে আসা হয়। আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে রাজারবাগের পুলিশ হাসপাতালেও যান সরকারপ্রধান।
আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় ১৪৭ মৃত্যুর তথ্য দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল। যদিও তখনকার সংবাদমাধ্যমের হিসাবে সংখ্যাটি দুই শতাধিক। ১০ দিন পর মোবাইল ইন্টারনেট ফেরে।
২৯ জুলাই: জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে ঐকমত্য হয় ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে। সেখানে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়।
৩০ জুলাই: কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে সারা দেশে শোক পালন করা হয়। সেই কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করে ফেইসবুক প্রোফাইল লাল করার এবং চোখে কালো কাপড় বেঁধে ছবি পোস্ট করার আহ্বান জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
৩১ জুলাই: আন্দোলনে হত্যার বিচার দাবিতে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচি ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত হয়। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে বিক্ষোভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদযাত্রা ঘিরে ধস্তাধস্তি হয়।
সুষ্ঠু তদন্তে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তথ্যানুসন্ধান দল পাঠানোর আগ্রহ দেখায় জাতিসংঘ।
১ অগাস্ট: ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্তি পান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ক। নিহতদের স্মরণে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ শিরোনামে কর্মসূচি পালন করা হয়। এর মধ্যেও কুমিল্লা, নারায়াণগঞ্জ ও বরিশালে সংঘাত আর রক্তপাত হয়।
কোটা আন্দোলনের মধ্যে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগ এনে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র শিবির এবং সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আওয়ামী লীগ সরকার।
২ অগাস্ট: গণমিছিলে হামলা সংঘর্ষ হয়, পুলিশসহ ২ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়।
৩ অগাস্ট: আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাদের জন্য গণভবনের দরজা খোলা। সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন আন্দোলনকারীরা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল জমায়েত থেকে সরকার পতনের এক দফা দাবি আসে।
ঢাকার পরিবেশ অনেকটা শান্তিপূর্ণ থাকলেও অন্তত ১১ জেলায় হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। অন্তত একজনের প্রাণহানি হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলে পদত্যাগ করবেন তিনি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আর ‘অরাজনৈতিক নেই’। হামলা হলে আত্মরক্ষায় তার ‘জবাব’ দেওয়া হবে।
৪ অগাস্ট: অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে মাঠে নামার ঘোষণা দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সারাদেশে ব্যাপক সংঘাতে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়। নিহতদের মধ্যে অন্তত ১৪ জন পুলিশ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের ১৯ নেতাকর্মী ছিলেন।
শাহবাগে ব্যাপক জমায়েতের মধ্যে পরদিন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবক সকলকে নিরাপদে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি হামলা হচ্ছে। জঙ্গি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
‘৩৬ জুলাই’
শেখ হাসিনার পতনের আগের দিনও চোটপাট দেখিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। দলটির নিচের পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ঘুণাক্ষরেও ধারণা পাননি যে তাদের পতন আসন্ন।
৫ অগাস্ট সকালেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমে পুলিশের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারী ওপর হামলা ও গুলি চালায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে সেদিন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে ঢাকামুখী হন হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। সকাল ১০টার পর থেকেই উত্তরা দিয়ে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করে সহস্র মানুষ।
দুপুর নাগাদ শেখ হাসিনার পতনের কথা শোনা যায়। পদত্যাগ করে সামরিক উড়োজাহাজে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। দেশ পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হবে বলে জানান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
ঢাকার পথে পথে সেদিন আনন্দ মিছিল চলে। জনতা গণভবনের দখল নেয়, সেখানে চলে লুটপাট। জাতীয় সংসদেও দেখা যায় একই চিত্র।
বিভিন্ন থানায় হামলা হয়, আক্রান্ত হয় বঙ্গবন্ধু ভবন, আওয়ামী লীগ কার্যালয় এবং বহু নেতার বাড়ি।
পথে পথে মানুষের উচ্ছ্বাস, আনন্দ মিছিল ছিল ঢাকা জুড়ে। সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। পরে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণে জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যত দ্রুত সম্ভব গঠন করা হবে।
ছাত্ররা বলেছিল, জুলাই মাসেই শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করবে তারা। ৩১ জুলাইয়ের পর থেকে তারা নতুনভাবে তারিখ গণনা শুরু করে; সেই হিসাবে ৫ অগাস্ট ছিল ‘৩৬ জুলাই’।