Published : 07 Jun 2025, 08:38 AM
ত্যাগের আহ্বান আর আনন্দের বার্তা নিয়ে এসেছে আরেকটি উৎসবের দিন, ঈদগাহ আর মসজিদে মসজিদে ঈদুল আজহার নামাজে অংশ নিয়েছেন সকল শ্রেণি, পেশা আর বয়সের লাখো মুসলমান।
শনিবার সকাল সাড়ে ৭টায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে এবারের কোরবানির ঈদের প্রধান জামাত হয়। সেখানে ইমামতি করেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মুফতি মোহাম্মদ আবদুল মালেক।
নামাজ শেষে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনার পাশাপাশি বিশ্ববাসীর শান্তি প্রার্থনায় দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।
আল্লাহর কাছে হাত তুলে মুফতি মোহাম্মদ আবদুল মালেক বলেন, “মানুষকে শান্তি দেন। জালিমের জুলুম থেকে বাঁচান।”
মোনাজাতে তিনি বলেন, “হে আল্লাহ, আমাদের কোরবানি কবুল করে নেন। আমাদের সকলকে ক্ষমা করে দেন। গুনাহ কে মাফ করেন।”
অসুস্থদের জন্য সুস্থতা চেয়ে তিনি বলেন, “সবার মনোকামনা পূরন করে দেন। সকলের বালা মুসিবত দূর করে দেন।”
অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের সুস্বাস্থ্য কামনা করে তিনি বলেন, “মুরব্বিরা দেশের জন্য কাজ করছেন, তাদের কল্যাণ কাজ কবুল করেন। তাদের নিরাপদ রাখেন।"
ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মানুষের মুক্তি কামনায় তিনি বলেন, “জালিমের জুলুম থেকে বাঁচান। জুলুম করা থেকে বাঁচান। সবাইকে হেফাজত করেন।”
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আলী ইমাম মজুমদার, অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার হাজারো মানুষ জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে ঈদুল আজহার প্রধান জামাতে অংশ নেন।
নামাজ ও মোনাজাত শেষে রেওয়াজ মাফিক বুকে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি আর কুশল বিনিময় করেন সবাই।
প্রধান জামাত শেষে সবার কাছে দোয়া চান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনূস।
এ জামাতে অংশ নিতে ভোর থেকেই ঈদগাহর মূল ফটকের বাইরে লাইন শুরু হয়। পায়জামা পাঞ্জাবি, টুপি পড়ে ও নানা ধরনের আতর সুগন্ধি মেখে সবাই জড়ো হন ঈদগাহ মাঠে। জামাত শুরুর সময়ের আগেই ঈদগাহ পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
শিশু-কিশোরেরা আসে তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে। হাতে হাত ধরে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা মাঠে প্রবেশ করে। অনেকেই ঈদগাহে আসেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। এজন্য বড় বিছানার চাদর ও ম্যাট নিয়ে আসেন কেউ কেউ।
ঈদগাহে এবারো প্রবেশ করতে হয়েছে সারিবদ্ধভাবে। প্রধান ফটকে বসানো আর্চওয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে নিরাপত্তা বিধি পালন করে। পুলিশ আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, জায়নামাজ ছাড়া অন্য কিছু সঙ্গে আনা যাবে না।
প্রধান ফটকে প্রবেশের লাইন লম্বা হয়ে চলে যায় পল্টন মোড় পর্যন্ত। উত্তরে লাইন ঠেকে মৎস্য ভবন মোড় ও দক্ষিণে বঙ্গবাজার পর্যন্ত।
ঈদগাহ ময়দানে সহজে প্রবেশ ও বের হতে মৎস্য ভবন, বঙ্গবাজর, পল্টন, জিপিও মোড় ঘিরে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী।
এবার একসঙ্গে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। নারীদের জন্য ছিল আলাদা ব্যবস্থা।
প্রধান ঈদ জামাত ঘিরে নিরাপত্তার বন্দোবস্তুও ছিল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে ঈদগাহ এলাকায়।
প্রতিবছরের মত এবারও ঈদুল আজহার দিনে পাঁচটি জামাত হবে ঢাকায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে। সকাল ৭টায় সেখানে প্রথম জামাতে ইমামতি করেন তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ খলিলুর রহমান মাদানী।
নামাজ শেষে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ, সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় মোনাজাত করা হয়।
আবহাওয়া অফিস বলেছিল, এবার ঈদের দিন বৃষ্টি হতে পারে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে বৃষ্টির আভাস কিছুটা বেশি। সকালে ঢাকার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও ঈদের নামাজ পড়তে আসা মানুষকে বৃষ্টির বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি।
ঈদ জামাত শেষে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন পশু কোরবানির তোড়জোড়ে। এবার ঢাকায় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পশু জবাই করার জন্য আলাদা স্থান বেঁধে দেওয়া হয়নি। বরাবরের মতই নগরজুড়ে রাস্তা ও অলিগলিতে পশু জবাইয়ের দৃশ্য দেখা গেছে।
ঢাকায় কোরবানি করা পশু এবং কোরবানির হাট মিলিয়ে ৪০ হাজার টনের বেশি বর্জ্য তৈরি হয়। সেভাবেই দ্রুততম সময়ে অপসারণের চ্যালেঞ্জ নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। দিনের বর্জ্য দিনে সাফ করাই তাদের লক্ষ্য।
মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে ঈদ জাতীয় উৎসবে রূপ নেয়। আগে ঈদে তিন দিন সরকারি ছুটি থাকলেও এবার স্মরণকালের সবচেয়ে লম্বা ছুটি মিলে গেছে। ঈদের আগে পড়ে মিলিয়ে টানা ১০ দিনের ছুটিতে ঢাকা থেকে প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ গ্রামে চলে গেছেন স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে।
ঈদ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে দারিদ্র্যপীড়িত ও সুবিধাবঞ্চিত অনেক মানুষের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
দেশবাসীসহ বিশ্বের সব মুসলিমকে শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানিয়ে তিনি বলেছেন, “আমাদের সমাজে দারিদ্র্যপীড়িত ও সুবিধাবঞ্চিত অনেক মানুষ রয়েছেন, যারা দুঃখ-দুর্দশা ও কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। ঈদুল আজহার সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সুমহান আদর্শকে ধারণ করে তাদের সাথেও ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে হবে। ত্যাগের শিক্ষা ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে প্রতিফলিত হোক-এটাই সকলের কাম্য।”
রাষ্ট্রপতি বলেছেন, “পবিত্র ঈদুল আজহায় পশু কোরবানির পাশাপাশি যাতে আমরা অন্তরের কলুষ, হিংসা, বিদ্বেষ পরিহার করতে পারি-মহান আল্লাহর দরবারে এ প্রার্থনা করছি। পবিত্র ঈদুল আজহা সবার জীবনে বয়ে আনুক কল্যাণ ও সমৃদ্ধি।”
ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানিয়ে দেওয়া বাণীতে ত্যাগের শিক্ষা ধারণ করে বৈষম্যমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
দেশের উত্তরোত্তর মঙ্গল কামনা করে তিনি বলেছেন, “আসুন, আমরা পবিত্র ঈদুল আজহার ত্যাগের শিক্ষা নিজেদের ভেতর ধারণ করি এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশকে একটি বৈষম্যমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলি।”
বাণীতে সরকারপ্রধান আরও বলেন, “ঈদুল আজহা মানুষকে শান্তি, ত্যাগ ও সাম্য শেখায়। মুসলমানরা কোরবানির পশুর গোস্ত গরিব আত্মীয়স্বজন ও দুঃস্থদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে সবাইকে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেন। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ত্যাগ, আত্মশুদ্ধি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি ছড়িয়ে পড়ুক- এই হোক ঈদের চাওয়া।”