Published : 20 Apr 2025, 01:14 AM
সংবিধানে মূলনীতির প্রয়োজন আছে কি না, সে প্রশ্ন রেখে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বাহাত্তরের মূলনীতির পর সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে যেসব মূলনীতি ‘প্রবেশ করানো হয়েছে’ সেগুলোর বাতিল চেয়েছে।
মূলনীতির কাঠামোর বাইরে অন্য কোনো কাঠামো ভাবা যায় কি না সেই আলোচনাও করতে চেয়েছে নবগঠিত দলটি।
শনিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে নিজেদের এমন অবস্থান তুলে ধরেছে দলটি।
এদিন সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংসদের এলডি হলে শুরু হওয়া সংলাপ চলে প্রায় সাত ঘণ্টা।
বিকাল সোয়া ৫টার দিকে বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন জুলাই-অগাস্ট গণ অভ্যুত্থানের ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, “আলোচনায় আমরা তুলে ধরেছি ক্ষমতার ভারসাম্য, আমাদের সংবিধানে যে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক একটি কাঠামো- প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত, সেটা কীভাবে গণতন্ত্রয়াণ করা যায়, সেটা রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে গিয়ে এবং এক ব্যক্তির প্রভাবে বা প্রধান নির্বাহীর বাইরে গিয়ে।
“অর্থাৎ সাংবিধানিক যে নিয়োগ রয়েছে, প্রধান বিচারপতি ও অন্য যেসব নিয়োগ রয়েছে, সেসব নিয়োগ কীভাবে আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় আমরা কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম তৈরি করতে পারি, এছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা- মোটা দাগে এসব মৌলিক বিষয়ের ওপরে আমাদের আলোচনা ছিল।”
সংবিধানের মূলনীতির বিষয়ে নিজেদের প্রস্তাবের কথা জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন সময়ে সংবিধানে দলীয় মূলনীতির মাধ্যমে আসলে নিজেদের দলীয় রাজনৈতিক অবস্থানকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে আসলেই সংবিধানে মূলনীতির প্রয়োজন আছে কি না, সে প্রশ্ন আমরা রেখেছি।
”এই মূলনীতির কাঠামোর বাইরে আমরা অন্য কোনো কাঠামো ভাবতে পারি কি না এবং আমাদের সংবিধানে গণপ্রজাতন্ত্রী এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা বলা থাকে, মৌলিক অধিকারগুলোর কথাও বলা থাকে, সেক্ষেত্রে আলাদা করে মূলনীতির প্রয়োজন আছে কি না।
“তবে আমরা মূলনীতির ক্ষেত্রে বলেছি যে, আমাদের যে বাহাত্তরের মূলনীতি, এছাড়া পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংশোধনের মাধ্যমে যে দলীয় মূলনীতিগুলো প্রবেশ করানো হয়েছে, সেই মূলনীতিগুলো বাতিল করতে হবে, সে মূলনীতিগুলো আসতে পারবে না।”
তিনি বলেন, “সংবিধানে প্রত্যেক জাতিসত্তার স্বীকৃতি এবং প্রত্যেক জাতি ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর এবং এছাড়া বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর যেই স্বীকৃতি এবং অন্তর্ভুক্তি, সেটা নিশ্চিত করতে হবে সংবিধানে।”
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ ছাত্রনেতা বলেন, “একই ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না, এমন প্রস্তাব এনসিপি করেছে।”
একবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তিনি পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না- এমন প্রস্তাবও করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার নয়, বরং মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার, সেটার প্রস্তাব দিয়েছি। এছাড়া যে এনসিসির ধারণা দেওয়া হয়েছিল ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল, আমরা সেই জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের ফরমেশন নিয়ে আলোচনা করেছি।”
সংখ্যানুপাতিক হারে উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনের পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষের প্রার্থী ঘোষণা দেওয়ার পক্ষে মত এনসিপির। ১০০ নারী আসনে সরাসরি ভোটের পক্ষেও তারা।
তবে নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে আরও আলোচনার পক্ষে মত দিয়ে দলটির আহ্বায়ক বলেন, “ইলেক্টোরাল কলেজের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে। নিম্নকক্ষ, উচ্চকক্ষ, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি- এদের মাধ্যমে একটা ইলেক্টোরাল কলেজ করে সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।
“সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট করা লাগবে। উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের দুই তৃতীয়াংশ থাকলেও আমাদের গণভোটে যেতে হবে সংবিধান সংশোধনের জন্য।”
বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে আলাদা সচিবালয় করা, বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা দেওয়া এবং বিভাগীয় বেঞ্চ তৈরি করা, জেষ্ঠতার ভিত্তিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতি-প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা এবং সেক্ষেত্রে উচ্চপক্ষের মতামত নেওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন বলে তুলে ধরেন নাহিদ ইসলাম।
নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি করে তিনি বলেন, “মৌলিক অধিকার আদালত দ্বারা বলবৎযোগ্য করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অধিকারগুলো ধারাবাহিকভাবে নিশ্চিত করা হবে।”
স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে নতুন করে সংসদীয় সীমানাপুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়ার কথা তুলে ধরে নাহিদ ইসলাম বলেন, “সংসদীয় যে সীমানা রয়েছে সেটা আমরা বলেছি যে, স্বাধীন কমিশন করে এটা নতুন করে, আগের কোনো সীমানায় আমরা যেতে চাই না, বরং নতুন করে এটা নির্ধারণ করতে হবে।”
সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিমত দেখা যাচ্ছে, এর সমাধান কী- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আসলে আমরা এই যে সমঝোতা, রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়টা, এটা আসলে আমরা মনে করি না যে কোনো দলীয় অবস্থান থেকে হওয়া উচিত।
“বরং আমরা যদি আমাদের নীতিগত অবস্থানটা ঠিক করতে পারি; আমাদের আকাঙ্ক্ষা, জনকাঙ্ক্ষার জায়গাটা ঠিক করতে পারি যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে আমরা একটা নতুন বাংলাদেশের কথা বলতেছি এবং আমরা বলতেছি যে যেই ব্যবস্থার ফলে একটা স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদ তৈরি হয়েছিল, আমরা তো অবশ্যই চাই যে সেই ব্যবস্থাটি থাকবে না; সামনের বাংলাদেশে।”
বিএনপির সঙ্গে এনসিপির আলোচনার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “সব দল পক্ষগোষ্ঠী ও জনগণের কাছে আহ্বান থাকবে, আপনাদের সামনে সকল কিছু উন্মুক্ত, আপনাদের সামনেই জনতার আদালতের সংস্কার কার্যক্রমের বিচার হবে এবং সংস্কার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সামনে বাংলাদেশটা এগিয়ে যাবে।
রাষ্ট্র কাঠামোর 'গুণগত পরিবর্তনের' পথ তৈরির আহ্বান এনসিপির
সরকার কোনোভাবেই 'কাজ' ছাড়া সময় পেতে পারে না: আখতার
“তবে তরুণরা বাংলাদেশের এবং বড় অংশে যারা উইমেন সোসাইটি রয়েছে, তারা ঐক্যবদ্ধ, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এই জায়গায়- বাংলাদেশকে একটি নতুন জায়গায় নিয়ে যাবে। তা আমরা আশা করি পক্ষগোষ্ঠী রাজনৈতিক দলগুলো এ বোঝাপড়াটায় আসবে।”
তিনি বলেন, “এটা আমাদের কাছে বোঝাপড়া না, এটার কন্টাক্ট পয়েন্টটা হল জনগণ। জনগণের কাছে কমিটমেন্ট। যেহেতু জনগণ চেয়েছে নতুন একটি ব্যবস্থা, নতুন একটি সংস্কার, নতুন একটি পরিবর্তন। ফলে তো সকলকে জনগণের কাছে যেহেতু আমরা ভোটের জন্য যেতে হবে, জনগণের কাছে সে দায়িত্ববোধ তাদের থাকবে। কন্টাক্ট পয়েন্ট নট পলিটিক্যাল পার্টি। কন্টাক্ট পয়েন্ট হল আমাদের কাছে জনগণ।
“ওই কমিটমেন্টের জায়গা থেকে আমরা কাজ করছি এবং আমাদের কোন দলীয় এজেন্ডা বা দলকে কীভাবে ক্ষমতা নেওয়া, কীভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার বা অপচর্চা দুর্বৃত্তায়নকে কীভাবে সংসদে নিয়ে আসা, এগুলো পরিহার করে কীভাবে জনগণের মূল রাইট যেটা রয়েছে, সেটাকে আমরা সংসদে প্রতিষ্ঠা করা, ওই জায়গা নিয়ে আমরা কাজ করছি।”
দলের বিপক্ষে এমপিদের ভোট দেওয়ার প্রসঙ্গে দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার বলেন, “কমিশন প্রস্তাব করেছে যে অর্থ বিল ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া যাবে, সংসদ সদস্যরা দিতে পারবে। আমরা মনে করি, সংসদ সদস্যরা অবশ্যই দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন, এই অধিকার তাদের থাকা উচিত- এটাই কার্যকর সংসদের একটা শর্ত।”
শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার হস্তান্তরের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশের সবচাইতে বড় সংকট হচ্ছে যখন নির্বাচনের সময় আসে, তখন কীভাবে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে পারে, সেটা নিয়ে নানা ধরনের মতপার্থক্য তৈরি হয়। ক্ষমতাসীন দলে যারা থাকেন, তারা কীভাবে আবার ক্ষমতায় আসতে পারেন, সে ধরনের মেকানিজমের মধ্যে তারা ঢুকতে চান।”
এ বিষয়ে দলের প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা কীভাবে হবে, অন্য উপদেষ্টা কীভাবে হবে, সে নিয়ে আমাদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলছে। আমরাও কিছু প্রস্তাব দিয়েছি।
”যারা এনসিসির (জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল) মেম্বার আছেন, তাদের মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় যিনি নেতা আছেন এবং রাষ্ট্রপতি তেনারা ছাড়া অন্যরা যারা আছেন, তাদেরকে কীভাবে নিয়ে আসা যায় বা অন্য ব্যক্তিদের কীভাবে এখানে ইনক্লুড করা যায়, সে ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমরা বিস্তারিত কথা বলেছি। আমরা এটা নিয়ে আরো আলোচনার সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি।”