Published : 23 Oct 2024, 09:56 AM
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের পুনর্গঠন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারে নির্বাহী পরিষদ এবং সাধারণ সদস্যদেরকে নিয়ে যখন জরুরি সভার প্রস্তুতি নিচ্ছেন লাকী ইনামসহ একটি অংশ, তখন সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত অপর একটি অংশ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ফেডারেশনের সম্মেলন প্রস্তুতির একটি চিঠিকে ঘিরে নির্বাহী কমিটির অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছে মতবিরোধ।
তবে চিঠির বিষয়ে ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক চন্দন রেজা বলছেন, “এটি খসড়া চিঠি এবং নির্বাহী কমিটির অভ্যন্তরীন বিষয়।”
চিঠিটি বাইরে কেন প্রকাশ হলো তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
২০১৮ সালে ফেডারেশনের ২৩তম ত্রিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন লোকনাট্য দলের (সিদ্ধেশ্বরী) লিয়াকত আলী লাকী এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ঢাকা থিয়েটারের কামাল বায়েজিদ।
তিন বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও লাকী নির্বাচন না দিয়ে সাড়ে ছয় বছর ধরে পদ দখলে রাখেন। একই সাথে শিল্পকলার মহাপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
ফেডারেশনের মেয়াদত্তীর্ণ কমিটির ‘স্বেচ্ছাচারিতা, অগঠনতান্ত্রিক ও অবৈধ কার্যক্রমের অভিযোগ তুলে গত বছর 'সাধারণ নাট্যকর্মীবৃন্দ' নামে একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে লাকীর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনেও নামেন থিয়েটারকর্মীরা।
মামুনুর রশীদ, রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, আহমেদ ইকবাল হায়দার, মলয় ভৌমিকসহ দেশের অগ্রজ নাট্যজনেরা ফেডারেশনে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক ধারা ফেরানোর আহ্বান জানিয়ে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু লাকী তাতে কর্ণপাত না করে বরং অগ্রজ নাট্যজনদের নিয়েও নেতিবাচক মন্তব্য করেন।
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১২ অগাস্ট শিল্পকলার মহাপরিচালকের পদ ছাড়েন লাকী। তবে ফেডারেশন থেকে পদত্যাগ করেননি।
এই প্রেক্ষিতে ফেডারেশনে সংস্কারের ডাক দিয়ে আগামী ২৫ অক্টোবর দুপুরে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তনে ফেডারেশনের জরুরি সভা ডেকেছেন ফেডারেশনের জ্যেষ্ঠ প্রেসিডিয়াম সদস্য (কেন্দ্র) লাকী ইনাম। সেই সভায় ফেডারেশন পুনর্গঠন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়টি রাখা হয়েছে আলোচ্যসূচিতে।
এর মাঝেই লাকীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক চন্দন রেজার সই করা একটি চিঠি থেকে জানা যায়, আগামী মার্চে সম্মেলন দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্ববায়ক করা হয়েছে ঝুনা চৌধুরীকে। যুগ্ম আহ্ববায়ক হিসেবে আছেন শাহাদাত হোসেন খান, লাকী ইনাম, মমিন বাবু, সৈয়দ দুলাল, আখতারুজ্জামান। সদস্য-সচিব চন্দন রেজা এবং যুগ্ম সদস্য-সচিব মাসুদ পারভেজ মিজু।
সদস্য হিসেবে আছেন উত্তম কুমার সাহা, রাজ্জাক মুরাদ, মুসলেম উদ্দীন সিকদার লিটন, অনন্ত হিরাসহ বেশ কয়েকজন।
তবে ঝুনা চৌধুরীসহ সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির একাধিক সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, তাদেরকে না জানিয়ে প্রস্তুতি কমিটিতে নাম যুক্ত করা হয়েছে।
ঝুনা চৌধুরী বলেন, “ফেডারেশনে যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে, সেখানে ঐক্যের জায়গাটি তৈরি করতে আমরা কয়েকজন চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এই সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিতে থাকতে আমি ইচ্ছুক নই।”
আখাতারুজ্জামান এবং অনন্ত হিরাও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, এই সম্মেলনের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে তারা যুক্ত নন।
ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান বলেন, “সম্মেলন ঘোষণা করতে হলে তো সভা করতে হবে। সভায় সিদ্ধান্ত হবে। এরকম কিছুই করা হয়নি। আমি তাদের জানিয়েছি আমার নাম বাদ দিতে। কোনোভাবেই ফেডারেশনের বিভাজন চাই না, ঐক্য চাই।”
ফেডারেশনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অনন্ত হিরা বলেন, “লিয়াকত আলী লাকী এতদিন স্বেচ্ছাচারীভাবে তার অনুগতদের নিয়ে ফেডারেশন পরিচালনা করেছেন, এখনো তার অনুগতদের নিয়ে সম্মেলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি এর সঙ্গে যুক্ত নই।”
২৫ অক্টোবর লাকী ইনামের ডাকা সভায় আলোচনা করে ফেডারেশনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চান বলেও জানান অনন্ত হিরা।
এ বিষয়ে জানতে ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীর ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক চন্দন রেজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সম্মেলন দেওয়ার বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তুতি কমিটি করা হয়েছে। চিঠিটি ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্যদের দেখতে দেওয়া হয়েছিল, সেটি বাইরের লোকজন তো জানার কথা নয়। আমরা এই চিঠিটি চূড়ান্ত করে সবাইকে জানাব।”
ফেডারেশনে ভাঙন যেভাবে প্রকাশ্যে
ফেডারেশনের অভ্যন্তরীন অস্থিরতা প্রকাশ্যে আসে ২০২২ সালে। ওই বছরের ২২ জানুয়ারি ফেডারেশনের সম্পাদক (প্রচার) মাসুদ আলম বাবুর স্বাক্ষরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও সাংগঠনিক স্বেচ্ছাচারিতার দায়ে’ সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদ ও অর্থ সম্পাদক রফিকুল্লাহ সেলিমকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয়টি জানানো হয়।
পরে সংবাদ সম্মেলন করে কামাল বায়েজীদ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এভাবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কাউকে অব্যাহতি দেওয়া ‘অগণতান্ত্রিক’।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে নাট্যকর্মীদের উদ্দেশে ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি খোলা চিঠি লেখেন ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রামেন্দু মজুমদার। নাট্যকর্মীদের কাছে লেখা চিঠিটি থিয়েটার বিষয়ক পত্রিকা ‘ক্ষ্যাপা’র ফেইসবুক পেজে প্রকাশ করেন তিনি।
চিঠিতে রামেন্দু মজুমদার বলেছিলেন, বর্তমানে ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিদের এই বিরোধ জনসমক্ষে নাট্যকর্মীদের ভাবমূর্তিকে চরমভাবে কালিমালিপ্ত করেছে। এর দায় নাট্যকর্মীরা কেন নেবেন তারা সুন্দর পরিবেশে নাটক করতে চান, নোংরা রাজনীতি চান না।
তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্যে ফেডারেশানের কর্মকাণ্ড স্থগিত এবং ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার পরামর্শও দেন।
এরপর রামেন্দু মজুমদারের চিঠিকে গুরুত্ব না দিয়ে ফেডারেশনে লিয়াকত আলী লাকীর অনুসারীরা রামেন্দু মজুমদারকেও হেয় করে নানা মন্তব্য করেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফেডারেশন জানায়, তারা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে।
২০২২ সালের ২৩ জুলাই রাজধানীর মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে ‘সাধারণ নাট্যকর্মীদের’ ব্যানারে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। অগ্রজ প্রায় সব নাট্যজন সেখানে বক্তব্য দিলেও লাকী সেখানে যাননি।
ওই সভায় বক্তব্য দিয়েছিলেন রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, মফিদুল হক, আসাদুজ্জামান নূর, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, আহমেদ ইকবাল হায়দার, মোহাম্মদ বারী, আজাদ আবুল কালাম, কামাল বায়েজীদ, রফিকুল্লাহ সেলিম প্রমুখ।
কামাল বায়েজীদকে বহিষ্কারের প্রতিক্রিয়ায় ২০২৩ সালের ২২ মার্চ ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীকে লেখা এক চিঠিতে ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ সংগঠন ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানান।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ তখন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “অগঠনতান্ত্রিকভাবে কামাল বায়েজীদকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রতিবাদে ফেডারেশন থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করেছে ঢাকা থিয়েটার।”
ঢাকা থিয়েটারের সংগঠন ছাড়ায় ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীকে চিঠি দেন দেশের শীর্ষ চার নাট্যসংগঠনের প্রধান, যারা বিভিন্ন মেয়াদে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। তাদের মধ্যে আছেন ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রামেন্দু মজুমদারও। এছাড়া ‘নাট্যচক্রের’ পক্ষে ম হামিদ, ‘আরণ্যকের’ পক্ষে মামুনুর রশীদ এবং ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের’ পক্ষে সারা যাকের চিঠিতে সই করেন।
এমন পরিস্থিতিতে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে অনাস্থা এবং সংগঠনের অচলাবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে থিয়েটার চর্চার সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়ে ৬৭ জন নাট্যকার, নির্দেশক ও সংগঠকও বিবৃতি দিয়েছিলেন।
কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেননি লাকী। পরে সাধারণ নাট্যকর্মীবৃন্দ নামে প্ল্যাটফর্ম থেকে লাকীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করে থিয়েটারকর্মীরা। তবুও ফেডারেশনের সভাপতির পদ ছাড়েননি লাকী।
পূর্বের খবর :
লাকী যুগের অবসানের পর প্রথম সভায় বসছে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন নিয়ে 'অস্থিরতা', কোন পথে নাট্যাঙ্গন?
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ছাড়ল ঢাকা থিয়েটার
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন: সংকট সমাধানে ৬৭ জনের বিবৃতি
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন: সাবেক ৪ সভাপতিকে ‘অগ্রাহ্য’ করায় নাট্যকর্মীরা ‘সংক্ষুব্ধ’
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন: পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে উত্তপ্ত নাট্যাঙ্গন
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন: অব্যাহতি পাওয়া কামাল বায়েজীদের পাল্টা অভিযোগ