প্রেস বক্স থেকে
Published : 02 Nov 2024, 02:52 PM
মোটরবাইকের ব্রেক কষে প্রোজ্জ্বল ওলি দা বললেন, “চলে এসেছি। নামুন।” বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া করে জিজ্ঞেস করি, “এখানে! এটা পুলিশ স্টেশন?” তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, “হ্যাঁ, এটাই পুলিশ স্টেশন।”
উইমেন’স সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ কাভার করতে গিয়ে তিনটি ভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প আজ বলব। যে গল্পের শুরু পুলিশ স্টেশন থেকে।
বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে হারিয়ে ফেলেছি মোবাইল। দামি নয়। ব্যবহারও করেছিল বছর ছয়েক। কিন্তু ওই মোবাইলের ভেতরে ছিল অফিসের দুটা সিম। একটা কথা বলার, আরেকটা ইন্টারনেট সংযোগের। সিম দিয়ে যেন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু না ঘটে, তাই সতর্কতা এবং থানায় যাওয়া।
কাঠমাণ্ডুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ রেঞ্জে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। বাইরে-ভেতরের রাস্তা, সিঁড়ি, লবি সবই ঝকঝকে, তকতকে, কোথাও এক টুকরো ময়লা পড়ে নেই, মানুষের আনাগোনাও বেশি নয়। চলে গেলাম ১০২ নম্বর রুমে, যেখানে মোবাইল হারানোর অভিযোগ নেওয়া হয়।
দায়িত্বরত পুলিশ দুটি প্রশ্ন করলেন, “চুরি গেছে নাকি হারিয়ে ফেলেছেন?” আন্দাজে কথা বলতে নেই, তাই বললাম, “আমি নিশ্চিত নই, কোনটি হয়েছে, আপনি হারিয়ে গেছে ধরে নিন।”
এবার বললেন, “আইএমইআই নাম্বার আছে?” বললাম, “অনেক আগে কেনা, নাম্বার সেভ রেখেছি কিনা, নিশ্চিত নই।” তিনি বললেন, “তাহলে হারিয়ে গেছে, এভাবে নোট নিচ্ছি। যদি দেশে ফিরে আইএমইআই নাম্বার পান, তাহলে আমাদের মেইল করবেন, আমরা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করব।”
পুলিশ স্টেশনে এই আলাপচারিতা কত অল্প সময়ের তা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়। উনি লিখিত অভিযোগ জমা নিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে অভিযোগের কপি দিলেন, স্টেডিয়ামে আসার আগে মেইলও পেলাম! দেশের বাইরে গিয়ে পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এমন হতে পারে, তা ধারণাও ছিল না।
নেপালের স্পোর্টস জার্নালিস্ট ফোরামের (এনএসজেএফ) অনুষ্ঠানের একটা গল্প বলি। বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিক যারা উইমেন’স সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ কাভার করতে নেপালে গিয়েছিলেন, তাদের নিয়ে এনএসজেএফ গেট-টুগেদারের আয়োজন করেছিল। সংগঠনটির সভাপতি দেবেন্দ্র সুবেদী দাদা আন্তরিকতার সঙ্গে সঙ্গ দিলেন। ‘নেপাল টেন্ডুলকার’ খ্যাত পরশ খাড়কার সাক্ষাৎকার নেওয়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি।
ওই অনুষ্ঠানেই দেখা সঞ্জীব শিল্পাকারের সঙ্গে। উনি নেপালের ভীষণ জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার, সাফের ফাইনালেও পুরস্কার বিতরণী থেকে সব ম্যাচেই ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে পরিচয় দুই বছর আগের আসরে। এবারের দেখায় আন্তরিকতা বাড়ল।
এত নামি মানুষ, কিন্তু কি বিনয়ী! সৌহার্দ্যের স্মারক হিসেবে কী উপহার দিবেন, তা ভেবে অস্থির হয়ে উঠলেন। হাতে থাকা রুদ্রাক্ষ মালা খুলে পরিয়ে দিলেন। আমিও একটি রূপোর আংটি মোটাসোটা সঞ্জীব দা’র মোটা কনিষ্ঠ আঙুলে পরিয়ে দিলাম। কি খুশি তিনি!
ফাইনাল শেষ করে সঞ্জীব দেখা করতে এলেন মিডিয়া সেন্টারে। বাংলাদেশের জয়ে অভিনন্দন জানালেন। আমরাও সহানুভূতি জানালাম, নেপালের জন্য পরের আসরের শুভকামনা জানালাম। চলে যাওয়ার সময় উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে আংটিটি দেখিয়ে মজা করে বললেন, “তোমার এই আংটির কারণে আমি আজ জিততে পারিনি!”
এবার শোনা যাক, রাজু কারকি নামের আরেক ভদ্রলোকের কথা। ম্যাচ শেষ হলে সবাই যখন পাততাড়ি গুছিয়ে ঘরে ফিরে যেত, আলোগুলো নিভে কাঠমাণ্ডুর দশরথ স্টেডিয়াম হয়ে পড়ত ঘুটঘুটে অন্ধকার, চারদিক সুনসান নীরব, তখন আমরা লিখে যেতাম বাংলাদেশের জয়ের গল্প। বেচারা রাজু একা একা ঠাঁই বসে থাকতেন, আমাদের লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত।
যেদিন নেপালকে হারিয়ে বাংলাদেশ সাফের শিরোপা জিতল, আমাদের সঙ্গে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন রাজুও। পানি, হালকা খাবারও এনে দিলেন, নিজের দল নেপালের হারের কষ্ট ভুলে!
এই তিনটি ঘটনা আমাকে কী শেখালো? পুলিশ স্টেশন থেকে শিখলাম, চাইলেই আমরা চারদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি। সঞ্জীব দা শেখালেন, কীভাবে বিনয়ী হতে পারি। রাজু কারকি দা শিখিয়ে দিলেন, নিজের কষ্ট ভুলে অন্যের জয় দেখে কীভাবে খুশি হওয়া যায়।
সাফের সাত আসরের মধ্যে ছয়বার ফাইনাল খেলেছে নেপাল; মাঝে ২০১৬ সালের শিলিগুড়ির আসরেই কেবল ফাইনাল খেলতে পারেনি তারা।
নেপালি ফুটবলপ্রেমীদের জন্য সবচেয়ে হতাশার বিষয়, এই ছয়বারের একবারও তারা পারেনি ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে। চারবার তারা হারে ভারতের কাছে, টানা দুইবার বাংলাদেশের বিপক্ষে। কিন্তু মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে কোনোদিন সম্ভবত হারেনি বিনয় দেখাতে।
লেখক: সিনিয়র ফুটবল করেসপন্ডেন্ট, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম