Published : 05 Jul 2025, 12:05 AM
“জ্যোৎস্নায়, শীতে কাহারে সে চাহিয়াছে? কত দূর চেয়েছে উড়িতে?” এই জীবনানন্দীয় পঙক্তির মতোই ছিল নভেরা আহমেদের দৃষ্টিভঙ্গি—নিঃসঙ্গ, গভীর, মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় পরিপূর্ণ। তিনি ছিলেন নীরব, যেমন নীরব থাকে এক ফাঁকা জলাধার বা গহিন বন।
কিন্তু তার শিল্প ছিল ভাষাহীন চিৎকার, প্রবল অনুভব। সময়, সীমা আর পরিচয়ের বাইরে গিয়ে স্পর্শ করে চিরন্তন ব্যথা আর সৌন্দর্যের রহস্য। নভেরা ছিলেন সেই শিল্পী, যিনি বিমূর্ত ভাবনাকে ধরেছেন দৃশ্যমান রূপে। তিনি প্রথম বাঙালি নারী, যিনি ভাস্কর্যকে বিশ্বদরবারে বাঙালির হয়ে তুলে ধরেছেন। তার হাতে তৈরি শিল্পকর্ম শুধু মাটির কিংবা সিমেন্টের কাঠামো নয়, তা যেন ছিল এক একটি আত্মপ্রকাশ, এক একটি চেতনার ভাষ্য।
পাসপোর্টে তার জন্ম ১৯৩৯ সালে বলা হলেও অনেকেই মনে করেন তার প্রকৃত জন্ম ১৯৩০ সালে। এই দাবিকে আরও জোরালো করে তার ছোট ভাই শাহরিয়ারের জন্ম ১৯৩৩ সালের ঘটনা। কলকাতা থেকে মেট্রিক পাস করে নভেরা ১৯৫০ সালে যান লন্ডনে উচ্চশিক্ষার জন্য। দেশভাগের পর তাদের পরিবার চলে আসে পূর্ব পাকিস্তানে, এবং তিনি ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে।
চট্টগ্রামের এক শিক্ষিত ও শিল্পানুরাগী পরিবারে জন্ম নেওয়া নভেরার শৈশবেই সৃজনশীলতার বীজ রোপিত হয়। তার মা মাটির পুতুল বানাতেন। তাতেই তিনি প্রথম দেখেন, কীভাবে সাধারণ কিছু জিনিস দিয়েও তৈরি হতে পারে অসাধারণ কিছু। সেই বিস্ময়ই তাকে নিয়ে যায় শিল্পের পথে, ত্রিমাত্রিক রূপের প্রেমে।
নভেরার শিল্পজীবনকে অনেক সময় তার ব্যতিক্রমী জীবনাচরণ দিয়ে ছাপিয়ে দেখানো হয়েছে। কিন্তু তার সৃষ্টির গুণ এতই গভীর ও বিশুদ্ধ যে, তা এসব ছাঁদকে ছাড়িয়ে নিজেই নিজের পরিচয় হয়ে উঠেছে। তার গড়া ভাস্কর্যগুলোতে এমন এক মুগ্ধতা আছে, যা দর্শককে কেবল দৃষ্টির নয়, অনুভবেরও এক অন্য জগতে নিয়ে যায়।
লন্ডনের ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টসে তিনি ১৯৫১ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ভাস্কর্যচর্চা করেন, বিশ্বখ্যাত চেক ভাস্কর ডক্টর কারেল ভোগেলের কাছে। এখানেই তিনি অর্জন করেন ‘ন্যাশনাল ডিপ্লোমা ইন ডিজাইন’। পরে তিনি যান ইতালির ফ্লোরেন্স নগরীতে, ভেনচুরিনো ভেনচুরির কাছে আরও শিখতে, যা তার শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করে।
নভেরা ছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যচর্চার পথিকৃৎ। ঢাকার চারুকলায় তখনও ভাস্কর্য শেখানো শুরু হয়নি, ঠিক তখনই তিনি তৈরি করলেন দেশের প্রথম ফ্রিজ (দেয়ালে খোদাই শিল্প) ১৯৫৭ সালে, ঢাকা কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারে। পরের বছর ১৯৫৮ সালে তিনি তৈরি করলেন দেশের প্রথম উন্মুক্ত ভাস্কর্য ‘কাউ উইথ টু ফিগারস’, যা ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা।
১৯৬০ সালের অগাস্টে ঢাকায় তার প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয় ‘ইনার গেইজ’ শিরোনামে। এখানে তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে তৈরি ৭৫টির মতো ভাস্কর্য প্রদর্শন করেন, বেশিরভাগই সিমেন্টে নির্মিত। এই প্রদর্শনী শুধু তার শিল্পজীবনের নয়, বাংলাদেশের শিল্প ইতিহাসেও এক অনন্য মাইলফলক।
নভেরা আহমেদ ছিলেন এক সাহসী ও সৃজনশীল শিল্পী। তিনি বাংলার লোকজ উপাদান আর পাশ্চাত্যের আধুনিক রীতিকে মিলিয়ে গড়েছেন এক নতুন ভাষা। তার কাজ শুধু দর্শনীয় নয়, ভাবনীয়ও।
নভেরা আহমেদ যখন ভাস্কর্য নির্মাণে সিমেন্ট ব্যবহার শুরু করেন, তখন তা ছিল এক সাহসী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। কারণ, এই অঞ্চলে বড় পাথর বা শক্ত কাঠ সহজলভ্য ছিল না। অথচ সিমেন্ট দিয়ে মসৃণ, নিখুঁত ভাস্কর্য তৈরি করা ছিল প্রযুক্তিগতভাবে খুবই কঠিন। তার এই মাধ্যম নির্বাচন শুধু চিন্তার মৌলিকতা নয়, অসাধারণ কারিগরি দক্ষতারও পরিচায়ক।
পরবর্তীতে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর যেসব ধ্বংসাবশেষ পড়ে ছিল, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহিনীর ভেঙে পড়া যুদ্ধবিমানের লোহার অংশ, সেগুলো সংগ্রহ করে তিনি নতুন ভাস্কর্য তৈরিতে ব্যবহার করেন। ধ্বংসকে রূপ দেন শিল্পে। এই সাহসিকতা ও নতুন উপকরণ বেছে নেওয়ার মধ্যে ফুটে ওঠে তার গভীর শিল্পমনস্কতা।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে তার কাজ সংরক্ষণে তেমন মনোযোগ দেওয়া হয়নি। এমনকি এক সময় এমন ধারণা ছড়ায় যে ‘তিনি আর বেঁচে নেই’। পরে ১৯৯৮ সালের শেষদিকে, তার ১৯৬০ সালের একক প্রদর্শনীর একটি পুরোনো ব্রুশিওর খুঁজে পাওয়া গেলে আবারও আলোচনায় উঠে আসেন নভেরা আহমেদ। তখন শুরু হয় তার কাজ ও জীবনের নতুন করে পুনর্মূল্যায়ন।
নভেরা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন বাংলাদেশের লোকজ ঐতিহ্য ও বৌদ্ধ ভাবনায়। শহীদ মিনারের কংক্রিট কাঠামো নির্মাণেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। যদিও এ নিয়ে আজও বিতর্ক রয়েছে। নকশা কাদের ছিল, তা নিয়ে দ্বিধা আছে। তবু শিল্পবোদ্ধাদের অনেকেই বিশ্বাস করেন, শহীদ মিনারের মধ্যের উঁচু স্তম্ভটি একটি মাতৃমুখের প্রতিরূপ, আর পাশে থাকা স্তম্ভগুলো সন্তানদের প্রতীক। তবে শিল্পী নভেরা নিজে আনা ইসলামের এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তিনি বুদ্ধদেবের উপবিষ্ট ভঙ্গিমা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মিনারের কেন্দ্রীয় স্তম্ভ নির্মাণে হাত দেন। উঁচু করতল যেন শান্তির প্রতীক, এই ভাবনাটিই ফুটে উঠেছে সেই কাঠামোয়।
নভেরার শিল্পভাণ্ডারে রয়েছে বহু কালজয়ী সৃষ্টি। তার উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যের মধ্যে আছে: ‘কাউ উইথ টু ফিগারস’ (১৯৫৮), ‘সার্পাঁ নোমে দেজির’ (১৯৭২), ‘লে জিন’ (১৯৭৩), ‘লে হেরঁ’ (১৯৮২) ও ‘লে বারোঁ ফু’ (২০০১)। এইসব ভাস্কর্য শুধু কোনো কাঠামো নয়, এগুলো তার ভেতরের দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক অবস্থান, নারীর অবস্থান, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং ইতিহাসচেতনার নিঃশব্দ ভাষা। নভেরা আহমেদ ছিলেন এক নীরব বিপ্লবী, যার শিল্পে ছিল গভীর প্রতিজ্ঞা আর সত্যের অনুসন্ধান।
ফ্রান্সে বসবাসের সময়ও তিনি শিল্পচর্চা থেকে দূরে যাননি। এক সড়ক দুর্ঘটনার পর তিনি হুইলচেয়ারে বন্দি হয়ে পড়েন। শরীর অবশ হলেও তার শিল্পের প্রতি ভালোবাসা অবসান হয়নি। বছরের পর বছর তিনি কাজ করে গেছেন সেই একই নিষ্ঠা নিয়ে। তবু বাংলাদেশে তার রেখে যাওয়া শিল্পকর্মগুলোর প্রতি যত্ন বা মূল্যায়ন তেমন হয়নি। বহু ভাস্কর্যের অবস্থান আজও অজানা। যেগুলো টিকে আছে, তারা মূলত কৃতজ্ঞ কিছু সংগ্রাহক ও ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকের যত্নেই বেঁচে আছে।
ফ্রান্সের লা রোশ-গুইওঁ অঞ্চলে তার স্বামীর উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘মিউজে নভেরা আহমেদ’, এক ছোট্ট জাদুঘর, যেখানে সংরক্ষিত আছে তার কিছু দুর্লভ সৃষ্টি ও ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্ন। বাংলাদেশে বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে তার মাত্র ৩৩টি ভাস্কর্য। আর যে দুর্লভ ফ্রিজটি তিনি ১৯৫৭ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরির প্রাচীরে নির্মাণ করেছিলেন, সেটি এখন অবহেলায় ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় পড়ে আছে।
এই অবক্ষয় ও বিস্মৃতি কেবল একজন শিল্পীর প্রতি অবহেলা নয়, এটি আমাদের সামষ্টিক স্মৃতির বিপর্যয়, আমাদের সাংস্কৃতিক মানসিকতার এক বেদনাদায়ক চিত্র। আমরা ভুলে যেতে থাকি, কীভাবে এক শিল্পী, একা, নিঃশব্দে দেশের জন্য এক নতুন শিল্পভাষা নির্মাণ করেছিলেন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক জটিলতা দেখা দেয় নভেরার। তিনি ২০১০ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ২০১৫ সালের ৬ মে, ফ্রান্সের প্যারিসে এক হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
নভেরার শিল্পভাষা গড়ে উঠেছিল পাশ্চাত্য আধুনিক শিক্ষার ভিতের ওপর। কিন্তু তাতে মিশে ছিল বাংলার লোকজ ঐতিহ্য, বৌদ্ধ ধ্যানধারা ও নারীর অভিজ্ঞতার ঘনীভূত অভিজ্ঞান। তার গড়া কাঠামোগুলোর মধ্যে যে নিখুঁত ভারসাম্য দেখা যায়, দৃঢ়তা ও কোমলতার মাঝে, তা হয়ে ওঠে হৃদয়ের গভীরে পৌঁছানোর এক মাধ্যম। তিনি গড়েছিলেন এমন এক শিল্পভুবন, যা কাল পেরিয়ে আজও আমাদের স্পর্শ করে।