Published : 09 Jan 2024, 12:52 PM
এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজার কোষাগার ভরা অর্থ, গ্যারেজ ভরা ল্যাম্বারগিনি, অডি, মার্সিডিজ, এলিয়ন, প্রিমিও, হোন্ডা-টয়োটাসহ নানান ব্র্যান্ডের নানান রঙের দামি দামি গাড়ি। কি বিশাল প্রাসাদ রাজার! পুরো প্রাসাদ ঘুরতে পা ব্যথা হয়ে যাওয়ার অবস্থা।
এত বিশাল প্রাসাদে থাকেন মাত্র পাঁচজন। রাজা রানি আর তাদের তিন ছেলে। রানি সারাদিন সাজগোজ আর পার্টি নিয়ে ব্যস্ত। আর ছেলেরা? তাদের কথা কী আর বলব। তারা তো সারাদিন ব্যস্ত মোবাইল ট্যাব আর কম্পিউটার নিয়ে। তারা স্কুলে পড়ে বটে, কিন্তু রাজা কোনদিন তাদের হাতে বই দেখেনি। রাজার মনে তাই শান্তি নেই।
রাজার রাজ্যের কাজ করতেও তাই আর ভালো লাগে না। সারাক্ষণ রাজার চিন্তা হয়- তিনি যখন থাকবেন না কীভাবে তার উত্তরাধিকারীরা রাজ্যের হাল ধরবে? তাদের তো বাস্তব জ্ঞানবুদ্ধি নেই তাহলে কী হবে? তার সাজানো রাজ্যটা নষ্ট হয়ে যাবে? ভেবে ভেবে রাজা হয়রান।
রাজার প্রাসাদের সামনে বিশাল সুইমিং পুল। বিকেলবেলা রাজা সেখানে বসে হাজার পদের খাবার খাচ্ছেন। খেতে খেতে রাজা ভাবেন- ইশ, আমার যদি তিন ছেলে না থেকে তিন মেয়ে থাকত, তাহলে বেশ হতো। আজকাল তো ছেলেদের চাইতে মেয়েরাই বেশি ভালো করছে। পড়াশোনা কাজকর্ম খেলাধুলা সবকিছুতেই এখন মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে।
তাহলে কী করা যায়? রাজা ভাবল- আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা দরকার। যেই ভাবা সেই কাজ। রাজার ডাকমাত্র মন্ত্রী এসে হাজির। রাজা মন্ত্রীকে বললেন, আমার উত্তরাধিকারীদের ওপর আমি পরবর্তীতে রাজ্যভার ছাড়ব এ ভরসা করতে পারছি না। আপনাদেরও বয়স হচ্ছে। আমরা যখন থাকবো না তখন রাজ্যটা যেন সুশৃঙ্খলভাবে চলতে পারে তার জন্য কী করা যায়, বলুন তো মন্ত্রীসাহেব? আবার বিবাহ করব কি?
মন্ত্রী হেসে বললেন- রাজা মশাই, এ যুগে মেয়ে সন্তানের জন্য আপনার দ্বিতীয় বিবাহ করা দৃষ্টিকটু হবে। তবে এই রাজ্যকে আরো উন্নত করার জন্য আমরা আমাদের রাজ্যের মেয়েদের নানারকম ফ্যাসিলেটিজ দিতে পারি। রাজা বললেন- মেয়েদের ফ্যাসিলেটিজ বাড়িয়ে দিলে রাজ্যের লাভ কী? মন্ত্রী জানালেন- রাজামশাই, মেয়েরা ধৈর্যশীল। তারা কথা শোনে। তারা মমতাময়ী। তারা নিষ্পাপ, সম্পদের নয়ছয় করে না। তবে এজন্য তাদের আরো পড়ালেখা শিখিয়ে শিক্ষিত করতে হবে।
রাজা বলেন- তবে কি আমি এতদিন তাদের যথেষ্ট সুযোগসুবিধা দিইনি? মন্ত্রী বলেন- জি, জাহাপনা, দেয়া হয়েছে। তবে কিছু মনে করবেন না। তাদের দেশ পরিচালনা তথা বড় দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সেসব সুবিধা যথেষ্ট নয়। রাজা বলেন- তবে তাদের আরো কী কী সুবিধা দিতে হবে, বলুন? মন্ত্রী বলেন- জাহাপনা, তাদের শিক্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনার খরচ ফ্রি করে দিতে হবে। তাদের স্কলারশিপ দিয়ে বিদেশ থেকে নানা বিষয় পড়িয়ে আনতে হবে। তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের আইটি নলেজ দিতে হবে। তাদের নানান ভাষা শেখাতে হবে।
সময় অনেক গড়িয়েছে। রাজার বয়স হয়েছে। রাজা যে আর রাজ্য চালাতে পারেন না। রাজার অপদার্থ ছেলেরা- বুড়ো রাজাকে একপাশে ফেলে নিজেরাই রাজ্য চালানোর ভার নিল।
রাজা বললেন- বেশ, তাই করো। মন্ত্রী বলেন- রাজামশাই, যদি কিছু মনে না করেন- তাহলে বলি, রাজ্যের কোষাগারে তো অনেক টাকা। তাদের যদি আরো কিছু ফ্রি দেওয়া যায়, তাহলে ভাল ফলাফল পেতাম। রাজা বললেন- আরো ফ্রিতে সুবিধা দিতে চান তাদের? মন্ত্রী আমতা আমতা করে বলেন- রাজামশাই, নারীরা নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি তেমন সচেতন নন, কিন্তু ভাল স্বাস্থ্য না থাকলে তারা পড়াশোনা আর কাজ কীভাবে করবে? তাই যদি তাদের চিকিৎসা ফ্রি করে দিতেন...। রাজা বললেন- তবে তাই হোক।
তার পরদিনই রাজ্যে ঢাক পিটিয়ে ঘোষণা করা হলো- এই রাজ্যে মেয়েদের পড়ালেখা চিকিৎসাসহ সব সুবিধার কথা। রাজ্যের মানুষ রাজার জয়গান করল। রাজ্যে অবিরাম ঢাক বাজনা চলল। আতশবাজিতে আকাশ ছেয়ে গেল। রাজ্যের রাস্তায় রাস্তায় পুষ্পবৃষ্টি হল। সেই রাজ্যের মেয়েরা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে দিনরাত পড়াশোনায় মন দিল। হিসাব নিকাশ বুঝতে শিখল। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হলো। নিয়মিত হেলথ চেকআপ করে নিজেদের ফিট করল। তারা কারাতে শিখল। প্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করতে শিখল। তারা গাড়ি চালায়, প্লেন চালায়। সেই রাজ্যের মেয়েদের সঙ্গে পেরে ওঠা সাধ্য কার। চারপাশের রাজ্যগুলোও এই রাজ্যকে অনুসরণ করতে শুরু করল।
সময় অনেক গড়িয়েছে। রাজার বয়স হয়েছে। রাজা যে আর রাজ্য চালাতে পারেন না। রাজার অপদার্থ ছেলেরা- বুড়ো রাজাকে একপাশে ফেলে নিজেরাই রাজ্য চালানোর ভার নিল। বোকাবোকা সব ডিসিশন নিয়ে রাজ্যের যখন প্রায় বারোটা বাজা অবস্থা- তখন কী হলো? রাজ্যেও মানুষের মনে আর সুখ নেই। তাদের কাজ নেই। খাবার নেই। রাজ্যে মারামারি বেধে যাওয়ার জোগাড়।
হ্যাঁ- তখনই রাজ্যের সেইসব মেয়েরা যারা এতদিনে নিজেকে সবদিক থেকে যোগ্য করে তুলেছে তারা রাজার ছেলেদের বোকাবোকা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা শুরু করল। তারা রাজার ছেলেদের ভুল দেখিয়ে দিতে শুরু করল। তারা তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এক মুহূর্তও রাজার প্রাসাদের সামনে থেকে নড়ল না। ওমা- রাজার বোকা ছেলেগুলো কী আর তাদের সঙ্গে পেরে ওঠে তখন? তাদের না আছে পড়াশোনা। না আছে মানসিক শক্তি, না আছে ফিট শরীর। বড্ড বিপদ তাদের চারপাশে। তারা নিজেরা নিজেদের চুল ছেঁড়া শুরু করল। তারপর রাজার ছেলেরা মেধাবী, জেদি, বুদ্ধিমতী মেয়েদের ভয়ে প্রাসাদের পেছন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল। রাজ্যের সাধারণ জনগণের মুখে আবারো হাসি ফুটল।
বুড়ো রাজাও রাজ্যের মেধাবী প্রতিবাদমুখর মেয়েদের কাজ দেখে বুঝলেন- মন্ত্রীমশাই তাকে একদিন ভালো পরামর্শই দিয়েছিলেন। সব রাজ্যে মেয়েদের যদি যথাযথ শিক্ষা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় তবে প্রতিটি রাজ্যই তার রাজ্যের মতো উন্নত সমৃদ্ধ সুশৃঙ্খল হতে বাধ্য। রাজা, বলা যায় স্বস্তি নিয়েই চিরনিদ্রায় গেলেন। আমার গল্প ফুরালো, নটে গাছটি মুড়ালো।