Published : 13 Jun 2023, 04:44 PM
কানাডার যে কয়টি জায়গা পোস্টকার্ডে বা কানাডা বিষয়ক যে কোন বিজ্ঞাপনে জায়গা করে নেয় তার মাঝে মোরেইন লেইক ও লেইক লুইস অন্যতম। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত নায়াগ্রা ফলসের পরই কানাডার সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা মনে করা হয় এই হ্রদ দুটিকে।
কানাডার অ্যালবার্টা প্রদেশে অবস্থিত ব্যানফ ন্যাশনাল পার্কে লেইক মোরেইন ও লেইক লুইসের অবস্থান। নীলাভ সবুজ রঙের পানি, পেছনে সাদা পাহাড়ের পটভূমি এবং অন্যপাশে সবুজবনের এক অপূর্ব সৌন্দর্যের সম্মিলন।
অ্যালবার্টার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ক্যালগেরি থেকে ঘণ্টা দুয়েকের দূরত্বে ব্যানফ ন্যাশনাল পার্ক। আগে নিজস্ব গাড়িতে সরাসরি যাবার ব্যবস্থা থাকলেও বেশ কিছুদিন যাবত পার্কিং স্বল্পতার জন্য সেটি বন্ধ। তাই কিছুটা দূরে গাড়ি পার্কিং করে লেইক লুইস ও লেইক মোরেইনের জন্য বিশেষ বাসের ব্যবস্থা রয়েছে। বাসে করে সহজেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া যায়।
আমরা বেশ সকাল সকাল ক্যালগেরি থেকে রওনা দিলাম। আমরা রোড ট্রিপে উইনিপেগ থেকে সাস্কাচুয়ান হয়ে অ্যালবার্টা এসেছি ঘুরতে। আমাদের জন্য অ্যালবার্টা প্রথমবার হলেও পলাশ ভাই, স্নিগ্ধা আপু আর ছোট্ট রিদানের জন্য এটি তৃতীয়বার ভ্রমণ। কেন একই জায়গায় বারবার আসতে হবে তা আসলে নিজে না এসে উপলব্ধি করলে, বোঝানো যাবে না। এমনই মায়ার টান এই অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির!
আদিবাসীদের কাছে এ লেইকের নাম ‘হো-রান-নাম-নে’, যার অর্থ লেইক অফ লিটল ফিস।
রাতে আমাদের পাহাড়ের ঢালে এক বাসায় থাকার ব্যবস্থা ছিল। ক্যালগেরি শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেই রকি মাউন্টেইন রেঞ্জের ছোট বড় বিভিন্ন চূড়ার হাতছানি। দারুণ সুন্দর চকচকে রোদে কখনো সবুজ বন আবার কখনো ছোট বড় লেইকের পাশ দিয়ে হাইওয়ে এগিয়ে চলছে ব্যানফ ন্যাশনাল পার্কের দিকে। আমরা ব্যানফ ন্যাশনাল পার্কের কাউন্টারে ফ্যামিলি টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম। প্রথমেই আমরা লেইক লুইসের দিকে এগিয়ে গেলাম।
এখানে পার্কিং পেতে বেশি বেগ পেতে হলো না। যদিও বেশ কয়েক হাজার মানুষের সমাগম এখানে। বুকে ঝোলানো ক্যারিয়ারে ছয় মাসের ছোট্ট বাচ্চা থেকে আশি-নব্বই বছরের প্রবীণ সবাই উদগ্রীব প্রকৃতির এই অনাবিল সৌন্দর্য দেখার জন্য। গাড়ি পার্ক করে সামনে অল্প কিছুদূর এগিয়ে যেতেই লেইক লুইস।
গ্লেসিয়াল এই লেইকটির জন্ম হয়েছ কানাডিয়ান রকির লিফ্রে গ্লেসিয়ার থেকে। কুইন ভিক্টোরিয়ার দ্বিতীয় মেয়ে প্রিন্সেস লুইস ক্যারোলিনার নামানুসারে এই লেইকের নামকরণ করা হয়। যদিও এখানকার ফার্স্ট নেশন আদিবাসীদের কাছে এ লেইকের নাম ‘হো-রান-নাম-নে’, যার অর্থ লেইক অফ লিটল ফিস। নীলাভ সবুজ পানির এ লেইকে ছোট ছোট ক্যানু বা নৌকা চালানোর ব্যবস্থা রয়েছে। লেইকের পাশে ক্যানাডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ের বিশাল এক রিসোর্ট, যদিও ফেয়ারমন্ট কোম্পানির অধীনে এখন এ হোটেলটি।
বো রিভারের শাখা জনস্টন ক্রিককে ঘিরে পাহাড়ের পাশ দিয়ে কাঠের চমৎকার হাইকিং এর পথ রয়েছে এখানে। কোথাও আছে ছোট বড় জলপ্রপাত।
হোটেলের রুম থেকে লেইক দেখতে নিশ্চয়ই ভীষণ সুন্দর লাগার কথা! লেইক লুইস অন্যসব লেইকের চেয়ে তুলনায় বেশ ছোট। লেইক উইনিপেগ বা লেইক ম্যানিটোবার মতো সাগরসম লেইকের তুলনায় এটি কুয়োর চেয়ে বড় কিছু নয়। তবে গ্লেসিয়াল লেইক তো বেশি বড় হবে না এটাও স্বাভাবিক। পাশ দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলেই বেশ কিছু ট্রেইল চোখে পড়বে। যদিও এবার ট্রেইলে হাইকিং এর সুযোগ হলো না, তবে পরেরবার অবশ্যই এটা মিস করা যাবে না।
তারপর আমাদের গন্তব্য পাশের লেইক মোরেইনে। এই লেইকটি কানাডার অন্যতম সুন্দর লেইক। মিনিট বিশেকের দূরত্বে অবস্থিত এ লেইকের পার্কিং পাওয়া ভাগ্যের বিষয়। আমাদের গাড়ি ও অন্যান্য অনেক গাড়িকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। আমরা কাছাকাছি জনস্টন ক্যানিয়ন গেলাম। মূলত বো রিভারের শাখা জনস্টন ক্রিককে ঘিরে পাহাড়ের পাশ দিয়ে কাঠের চমৎকার হাইকিং এর পথ রয়েছে এখানে। কোথাও আছে ছোট বড় জলপ্রপাত।
এখানে সবাই মিলে হাঁটার এক সময় হঠাৎ বৃষ্টি নামলো। কোনমতে দৌড়ে টিকিট কাউন্টারের পাশে আশ্রয় নিলাম। কিছুক্ষণের মাঝে বৃষ্টি থেমে গেল, আমরা আবার রওনা হলাম মোরেইন লেইকের উদ্দেশ্যে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই শিলাবৃষ্টি শুরু হলো। সে এক ভয়ানক অবস্থা, হাইওয়ে কোন রকমে ইমার্জেন্সি লাইট দিয়ে রাস্তার পাশে গাড়ি রাখা হলো। রাস্তায় সব গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কানাডায় এসে শিলাবৃষ্টি দেখতে পাবো স্বপ্নেও ভাবিনি। যেভাবে শিলা পড়ছিল আমরা বেশ ভয়ে ছিলাম গাড়ির গ্লাস আবার ভেঙ্গে যায় কিনা। কিছুক্ষণের মাঝে শিল পড়া বন্ধ হয়ে গেল, বৃষ্টি হালকা হয়ে এলো।
ভ্যালি অফ টেন পিকের পাদদেশে এ লেইকের আয়তন প্রায় ১২০ একর। বিকেলের নরম আলোয় মোরেইন লেইককে যেন এক অপার্থিব জগৎ মনে হচ্ছিল।
আমরা মোরেইনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম, আকাশ তখনো মেঘলা। মোরেইনে এবার পার্কিং পাওয়া গেলো। বোঝা যাচ্ছিল বৃষ্টির সময়ে অনেকেই চলে গিয়েছে। আমাদের দুপুরে তখনো খাওয়া হয়নি। আমরা পার্কিং এর পাশে লেইকের কাছাকাছি খাবারের ব্যবস্থা করলাম। স্নিগ্ধা আপুর রান্না করা বিরিয়ানি আমাদের আজকের লাঞ্চ। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখি আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। আমরা একটা হাইকিং ট্রেইল ধরে সামনে এগিয়ে যেতেই দারুণ একটা ভিউ পয়েন্ট পেলাম। পুরো মোরেইন লেইকের অনাবিল সৌন্দর্য যেন সামনে বিমুগ্ধ করে দিল মুহূর্তেই।
ফে গ্লেসিয়ারের বরফগলা পানিতে টারকুইশ ব্লু বা ফিরোজা নীল রঙের লেইকের পানিতে রোদের আলোয় চিকচিক করছে। ভ্যালি অফ টেন পিকের পাদদেশে এ লেইকের আয়তন প্রায় ১২০ একর। বিকেলের নরম আলোয় মোরেইন লেইককে যেন এক অপার্থিব জগৎ মনে হচ্ছিল। একপাশে পাহাড়ের সারি, অন্যপাশে সবুজ বনের মিশালীর অনন্য সম্মিলন।
বিভিন্ন দেশের অসংখ্য পর্যটকের ভিড়ে ছবি তোলার ভালো জায়গা পাওয়া বেশ সমস্যা। তার মাঝেও কায়দা করে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তোলা হলো। লেইকের একপাশে অনেকগুলো কায়াক বাঁধা। এ কায়াকে লেইকের পানিতে ঘুরে বেড়াতে এক দারুণ অভিজ্ঞতা হওয়ার কথা, কিন্তু বিকেল হয়ে যাওয়ায় আজকের মতো সে সুযোগ নেই। আরো কিছুক্ষণ ঘুরে আমরা সেদিনের মতো ফিরতি পথে পা বাড়ালাম। অ্যালবার্টার অনিন্দ্যসুন্দর এই দুই হ্রদের মায়ার বাঁধনে যারা পড়েছে, তারা বারবার ফিরে আসে এর অঙ্গিনায়।