Published : 26 May 2025, 04:38 PM
অদৃশ্য হলেও চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা। এই ব্যথা শুধু যে কষ্টদায়ক তাই নয়- চিকিৎসা, ওষুধপত্র, কাজের অক্ষমতা মিলিয়ে খরচ হয় প্রচুর অর্থ।
তবুও চিকিৎসা বিজ্ঞানের বহু চেষ্টার পরও এই ব্যথার নির্দিষ্ট কোনো কারণ কিংবা নিশ্চিত সমাধান মেলেনি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিশেষজ্ঞ ও লেখক নিকোল স্যাকস সিএনএন’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা কোনো কল্পনা নয়। এই ব্যথা সত্যি। তবে মূল উৎস শরীর নয়, বরং মন।”
তার মতে, “নির্দিষ্ট ওষুধ কিংবা ফিজিওথেরাপি নয়, বরং মস্তিষ্ক কেন্দ্রিক একটি কৌশল ব্যবহার করলেই মিলতে পারে উপশম।”
ব্যথা, যার উৎস মনের গভীরে
নিকোল স্যাকস তার নতুন বই ‘মাইন্ড ইয়োর বডি: অ্যা রেভলিউশনারি প্রোগ্রাম টু রিলিজ ক্রনিক পেইন অ্যান্ড অ্যাংজাইটি’-তে ব্যথা ও উদ্বেগ কমাতে মস্তিষ্কভিত্তিক এক পদ্ধতির কথা তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন, “এই পদ্ধতিতে শুধু দীর্ঘমেয়াদি ব্যথাই নয়, বরং কোভিড-পরবর্তী জটিলতা, মাইগ্রেইন, আইবিএস, ফাইব্রোমায়ালজিয়া ও ক্রনিক ফাটিগ সিনড্রোম-এর মতো সমস্যারও সমাধান হতে পারে।”
এই সমস্যাগুলোর পেছনে রয়েছে স্নায়ুতন্ত্রের অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া।
নিকোল বলেন, “শরীরে কোনো ক্ষত বা রোগ ছাড়াও স্নায়ুতন্ত্র যখন অতিরিক্ত চাপে পড়ে তখন নিজেকে রক্ষার কৌশল হিসেবে ব্যথার সংকেত পাঠায়।”
মন-দেহ চিকিৎসা: কীভাবে কাজ করে?
নিকোলের মতে, “এই ব্যথা ‘টেনশন মায়োনিউরাল সিনড্রোম (টিএমএস) বা চাপজনিত পেশি ও স্নায়ুর উপসর্গের সমষ্টি’ নামে পরিচিত।”
এই তত্ত্বের জনক আরেক মার্কিন চিকিৎসক ডা. জন সারনো। তার গবেষণা অনুযায়ী, কিছু শারীরিক সমস্যা আসলে দৈহিক সমস্যার কারণে নয় বরং চাপ ও মানসিক যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ।
ব্যথার উৎস হল ‘ইমোশনাল রিজার্ভয়ার’— মন ও স্নায়ুতন্ত্রে জমে থাকা দুঃখ, রাগ, ভয়, লজ্জা, শোক ইত্যাদি অনুভূতি।
এই আবেগগুলো অনেক সময় এতটাই তীব্র হয় যে তা প্রকাশ পেলে জীবনযাত্রা ভেঙে পড়তে পারে।
তাই মস্তিষ্ক এগুলো চাপা দিয়ে রাখে। তবে এক সময় এই জমে থাকা আবেগ ‘উপচে পড়ে’, তখন মস্তিষ্ক সেগুলোকে দমিয়ে রাখার জন্য ব্যথার সংকেত পাঠায়।
ব্যথা: প্রতিরক্ষার এক অদ্ভুত কৌশল
নিকোল বলেন, “মস্তিষ্ক আমাদের সুরক্ষার জন্য ব্যথার সংকেত পাঠায়, যেন আমরা বিশ্রাম নিই, কাজ থামিয়ে দেই, সহানুভূতি চাইতে পারি।”
যেমন ধরুন- কারও পিঠে ব্যথা শুরু হলে সে শুয়ে পড়ে, পরিকল্পনা বাতিল করে, নিজের প্রতি যত্নশীল হয়। এতে মস্তিষ্কের একটা নিয়ন্ত্রণবোধ তৈরি হয়, যদিও এই ‘নিয়ন্ত্রণ’ এক ধরনের প্রতিরক্ষা কৌশল মাত্র।
সমাধান কী?
নিকোল স্যাকসের মতে, “এই সমস্যার তিনটি ধাপে সমাধান সম্ভব।”
১. জ্ঞান অর্জন
প্রথমেই জানতে হবে, এই ব্যথা কীভাবে স্নায়ুতন্ত্র সৃষ্টি করে, এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী।
২. জার্নালস্পিক
প্রতিদিন ২০ মিনিটের একটি বিশেষ লেখার অভ্যাস, যেখানে মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা ভয়, রাগ, হতাশা ইত্যাদি সম্পূর্ণ খোলামেলা এবং অগোছালো হলেও লিখে ফেলতে হবে।
৩. আত্ম-সহানুভূতি
নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। ব্যথা যে মন থেকে সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা মেনে নিয়ে নিজেকে সময় ও ভালোবাসা দিতে হবে।
জার্নালস্পিক: অভিযোগ নয়, মুক্তির ভাষা
এই লেখার অভ্যাস অন্য যে কোনো ডায়েরি লেখার চেয়ে ভিন্ন। এটি কোনো বিশ্লেষণের জন্য নয়, বরং মনে জমে থাকা ‘অপরিষ্কার’ আবেগ বের করে দেওয়ার জন্য।
লেখার পর সেই লেখা পড়ে দেখা বা সংরক্ষণ করার প্রয়োজন নেই। চাইলে ছিঁড়ে ফেলা যেতে পারে।
নিকোল বলেন, “এটা যেন মনের ‘ভেন্টিলেইশন’—একটা বন্ধ অবস্থা থেকে চাপ বের করে দেওয়া।”
এই পদ্ধতি কাদের জন্য?
যেসব মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ব্যথায় ভুগছেন তবে চিকিৎসকরা কোনো নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাননি, যাদের ব্যথা বারবার স্থান বদলাচ্ছে বা মানসিক চাপে বেড়ে যায়। তাদের জন্য এটি কার্যকর হতে পারে।
তবে প্রথমেই চিকিৎসকের কাছে গিয়ে নিশ্চিত হতে হবে যে শরীরের কোনো রোগ নেই।
বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কতটা?
নিকোল স্যাকস বলেন, “আজকের উন্নত ‘ব্রেইন ইমেজিং’ প্রযুক্তিতে দেখা গেছে একজন মানুষ শারীরিক আঘাতে যেমনভাবে ব্যথা অনুভব করেন, মানসিক যন্ত্রণাতেও মস্তিষ্কের একই অংশ সক্রিয় হয়। অর্থাৎ, ব্যথা সব সময়ই সত্যিকারের, তবে তার উৎস হতে পারে আবেগ ও মানসিক চাপ।”
জীবন বদলাতে হবে কি?
নিকোলের পরামর্শ, “জীবন বদলাতে হবে না, শুধু জানতে হবে কেমন অনুভব করছেন।”
মানে- চাকরি ছাড়তে হবে না, সংসার ভাঙতে হবে না বরং নিজের আবেগের গভীরে গিয়ে সেগুলোকে স্বীকার করতে হবে।
যেভাবে শুরু করা যায়
নিজের প্রতি কৌতূহলী হওয়া। মনের সংকেত শুনে বুঝতে চেষ্টা করা। কেন শরীর এমন প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে।
এটা কোনো জাদু নয় বরং বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক চিকিৎসা পদ্ধতি যা মনে আস্থা আনে।
নিকোলের মতে, “শরীর নষ্ট হয়ে যায়নি। নিজেই নিজের সুস্থতার শক্তি ধারণ করছেন।”
আরও পড়ুন
শরীর ব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে ওঠার যত কারণ