Published : 05 Jun 2025, 10:51 AM
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও পাস-ফেল নির্ভর এক গতানুগতিক কাঠামোর মধ্যেই আবদ্ধ। এ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘ভালো রেজাল্ট’, ‘খারাপ রেজাল্ট’ এবং ‘ফেল’ করার ভয়। এই ভয়ের সংস্কৃতি শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। ফলাফল মুখ্য হয়ে উঠেছে, শেখা নয়। এরই পরিণতিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই অটোপাসের দাবি উঠে আসে, যা সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে।
বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ শিক্ষার্থীরা এখন ‘পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই উত্তীর্ণ হওয়ার’ দাবিতে সোচ্চার। আন্দোলন, অনলাইন ক্যাম্পেইন, গণস্বাক্ষর—সব মিলিয়ে এটি যেন একটি নতুন প্রজন্মের ‘অধিকার চাওয়ার ভাষা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এটিকে আর নিছক দাবি বলা চলে না; বরং এটি একপ্রকার চাপ সৃষ্টি করে অন্যায্য সুবিধা আদায়ের প্রবণতা।
এ প্রবণতা হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে কোভিড-১৯ মহামারির সময় কিছু বিষয়ের পরীক্ষা না নিয়ে বিকল্প মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের পাস করানো হয়েছিল। ২০২৩ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে আন্দোলনের মুখে সরকার পরীক্ষার কিছু অংশ বাতিল করে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের বার্তা পৌঁছেছে, ‘চাপ দিলে মেলে, দাবি করলেই অটোপাস করা যায়’—এটি শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এক ভয়ঙ্কর মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কেত।
শিক্ষাবিদরা সতর্ক করে বলছেন, এতে শিক্ষার্থীদের ভেতরে এক ধরনের অলসতা, দায়িত্বহীনতা এবং শর্টকাটে চলার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। এটি কেবল পরীক্ষার মানহানিই নয়, বরং সার্বিকভাবে শিক্ষার গুণগত মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
অন্যদিকে অভিভাবকের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক অভিভাবক সন্তানের পরীক্ষার ফলকে জীবনের একমাত্র সাফল্য ধরে নিয়ে অসহনীয় চাপ প্রয়োগ করেন। ভালো রেজাল্ট না হলে সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট—এমন বিশ্বাসে তারা কখনো সন্তানকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলেন, আবার কখনো পরীক্ষার হলে নকল সরবরাহ কিংবা কক্ষ পরিদর্শকদের প্রভাবিত করার মতো অনৈতিক কাজেও জড়িয়ে পড়েন। সদ্য সমাপ্ত এসএসসি পরীক্ষায় এমন কিছু ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে যেখানে অভিভাবক, শিক্ষক এমনকি রাজনৈতিক নেতারাও জড়িত ছিলেন।
এসব কিছু মিলে ‘পরীক্ষা’ এখন একটি আতঙ্কের নাম। ছাত্রজীবনে এটি যেন একটি বাধা, যা পেরোতে পারলেই মুক্তি। তাই ‘সহজ উপায়’ হিসেবে অটোপাসকে গ্রহণযোগ্য সমাধান মনে করছে অনেকে। অথচ পরীক্ষার উদ্দেশ্য কখনোই কাউকে ভীতি প্রদর্শন করা নয়। পরীক্ষা একটি শেখার প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী নিজের অর্জিত জ্ঞান, বিশ্লেষণী ক্ষমতা এবং সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা যাচাই করে।
যেসব শিক্ষার্থী অটোপাসের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে, তারা মূলত পরীক্ষাকে শুধুই রেজাল্টের সিঁড়ি হিসেবে দেখছে। অথচ প্রকৃত শিক্ষা হলো জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়া—নিজেকে দক্ষ, সচেতন এবং সৃজনশীল করে গড়ে তোলা। অটোপাস পেলে হয়তো একবারের জন্য ফলাফল পাওয়া যায়, কিন্তু শেখার সেই অভিজ্ঞতা হারিয়ে যায়, যা ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে মারাত্মক ঘাটতির সৃষ্টি করে।
বিশেষ করে চাকরির বাজারে অটোপাস করা শিক্ষার্থীরা যখন প্রতিযোগিতায় নামে, তখন তাদের জ্ঞানের অভাব এবং আত্মবিশ্বাসের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে পড়ে। অনেকেই পরিহাস ও তাচ্ছিল্যের শিকার হয়। ফলে এক সময় সমাজেই তারা হয়ে পড়ে অবিশ্বাস্য এক 'ডিগ্রিধারী অদক্ষ জনগোষ্ঠী'।
শিক্ষকদেরও এখান থেকে দায়মুক্তি নেই। পরীক্ষাকে ভয়হীন, আনন্দদায়ক ও মূল্যবোধ-ভিত্তিক শেখার সুযোগ হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের ভূমিকা রাখতে হবে। একজন শিক্ষক যদি ছাত্রকে কেবল রেজাল্টের জন্য মুখস্থ করায় উৎসাহ দেন, তবে সেই ছাত্র কখনো আত্মমর্যাদাশীল, দক্ষ নাগরিক হয়ে উঠবে না। বরং তাদের শেখাতে হবে কীভাবে ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যেও দায়িত্ব নিয়ে পথ চলতে হয়।
আমাদের শিক্ষা এখন এমন একটি পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে কেবল রেজাল্ট তৈরি হচ্ছে, মানুষ নয়। যেন পুরো ব্যবস্থাটি একটি বাজার, যেখানে উৎপাদিত পণ্যের মতো শিক্ষার্থী বেরিয়ে আসছে, অথচ তাদের ভেতর নেই সৃজনশীলতা, দক্ষতা কিংবা উদ্ভাবনী শক্তি। এ কারণে প্রতিমাসে শিক্ষিত বেকার বাড়ছে, অথচ শিল্প ও প্রযুক্তি খাতে যোগ্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না।
শিক্ষা তখনই অটোপাসের ফাঁদ থেকে মুক্তি পাবে, যখন আমরা বুঝতে পারব—শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল পাশ করা নয়, বরং জ্ঞানার্জন করে নিজেকে ও দেশকে উন্নত করা। পরীক্ষাকে ভয় নয়, শেখার অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে পারলেই অটোপাসের মতো অপসংস্কৃতি দূর হবে।
পুরো শিক্ষাব্যবস্থা যদি একটি বাজারের ব্যাগ হয়, তাহলে সেখান থেকে কেবল বের হচ্ছে পরীক্ষায় রেজাল্ট করা অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। এর বাইরে আমরা কিছুই পাচ্ছি না। মাসে মাসে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। সময় এসেছে পরিবর্তনের। গভীরভাবে ভাববার। পরীক্ষানির্ভর ব্যবস্থার সংস্কার দরকার, বিকল্প মূল্যায়নের পথ খোঁজার প্রয়োজন আছে ঠিকই, কিন্তু সেটি কোনোভাবেই অটোপাস হতে পারে না। শিক্ষা যদি দক্ষতা ও মানবিকতা বিকাশের মাধ্যম না হয়, তাহলে পাস করে কী হবে?
পরীক্ষা মানেই কি আতঙ্ক আর পাস মানেই সাফল্য? ‘অটোপাস’ সংস্কৃতির পেছনে ছুটে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ভুলে যাচ্ছি আমরা। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক—তিন পক্ষেরই আত্মসমালোচনার আয়নায় মুখ দেখার সময় এসেছে।