Published : 21 Sep 2024, 07:10 PM
প্রথিতযশা লেখক-সাংবাদিক-কলামিস্ট নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।’ কথাটা বাংলাদেশে বহুল চর্চিত। কথাটার অন্তর্হিত নির্যাসও বরাবরই প্রাসঙ্গিক। যখনই বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে, তখনই কথাটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। বিশেষত, যখন সড়ক দুর্ঘটনা, ভবনধ্বস, অগ্নিকাণ্ড কিংবা গণপিটুনি বা গণধোলাইয়ের মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে, তখন।
অবশ্য প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ডের মতো ‘ক্যাপিটেল পানিশমেন্টে’র সাপেক্ষে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ একটু নড়বড়ে হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রস্বীকৃত বিচারিক মৃত্যুদণ্ডও স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। কিন্তু নির্মল সেনের প্রবাদতুল্য দাবির ভিত্তিতে আমরা বিচারিক মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে ফয়সালা তো দুরস্ত, প্রপঞ্চটিকে প্রশ্নবিদ্ধও করতে পারিনি কখনই। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ডের মতো ‘অস্বাভাবিক মৃত্যুর’ প্রক্রিয়া থাকবে কি না, মানবাধিকারের প্রশ্নে সে কথা তোলা যেতেই পারে। বিশেষত যখন কি না অভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশে সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখনের আলোচনা শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে, বাকি সবগুলো দুর্ঘটনার সঙ্গে গণপিটুনিতে আঘাতপ্রাপ্তি বা মৃত্যুকে একই বন্ধনীতে আবদ্ধ করা যাবে কি না, সেটা নিয়ে বাহাস হওয়া প্রয়োজন। গণপিটুনিকে ‘মব জাস্টিস’ হিসেবে স্বতঃসিদ্ধ করার চেষ্টা থাকে। অথচ, বিক্ষুব্ধ জনতা অসাংগঠনিক কিন্তু সংঘবদ্ধভাবে যখন কাউকে আক্রমণ করে তখন সেটিকে ‘জাস্টিস’ বলাটাই সমস্যাজনক।
সাহিত্যে ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ বলে একটা প্রপঞ্চ আছে। যার বহুবিধ ব্যাখ্যা হাজির করা যাবে। মোটা দাগে বললে সেটি এমন অদ্ভুতুড়ে বিচার, যা আসলে অন্যায়ের শাপমোচন করে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করে। মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডির বয়ান বিবেচনায় এই বিচারের সঙ্গে ন্যায় ও নীতির সম্পর্ক আছে। কিন্তু, ‘মব জাস্টিস’ কি ‘পোয়েটিক জাস্টিস’? যার ‘বিচার’ হয়, তার প্রতি অদ্ভুতুড়ে বিচারই কি তার কর্মফল? নাকি কেন এ ধরনের সংক্ষুব্ধ হত্যাকাণ্ড নয়, সে তর্কও হওয়া প্রয়োজন।
‘জাস্টিস’ মানে বিচার এবং ‘মব’ মানে গণ হলে, মবজাস্টিস অর্থ দাঁড়ায় ‘গণবিচার’। তার মানে গণপিটুনি বা গণধোলাইয়ের সমার্থক হলো গণবিচার! কী ভয়ঙ্কর! মবের আরও কিছু ভয়ানক সমার্থক শব্দও আছে— হামলার উদ্দেশ্যে সমবেত উচ্ছৃঙ্খল জনতা; গুণ্ডাদল; মাস্তান; দাঙ্গাবাজ ইত্যাদি। এই অর্থগুলো থেকেও বোঝা যায়, গণপিটুনি আসলে মাস্তানি-গুন্ডামি বৈ অন্য কিছু নয়।
অথচ, গণপিটুনির সমার্থক হয়েছে গণবিচার! মানে, জনতা বিচারক হয়ে উঠবেন! সংবিধানস্বীকৃত সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ বলে, জনগণ বিচারকও হয়ে উঠবেন? প্রচলিত আইন-কানুন ও বিচারব্যবস্থাকে এতোটা পরিহাসপূর্ণ বানিয়ে ফেলা যায়!
‘মব জাস্টিস’ বিচার নয়, অবিচার; ‘মব ইনজাস্টিস’। ফলে, এই তথাকথিত গণবিচারকে শেষ পর্যন্ত বিচার বহির্ভূত হামলা কিংবা হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যে সংঘটিত হামলা হিসেবেই আমাদের পাঠ করতে হবে, যা মানবাধিকারের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন। কেউ যদি অপরাধ করেও থাকেন, প্রচলিত আইনি প্রথা ও প্রক্রিয়ায় বিচার পাওয়ার অধিকার তার আছে—এই সাদামাটা বিষয়টিকে যারা সরল কাণ্ডজ্ঞান দিয়েও বুঝতে পারেন বা চান না, তারা প্রত্যেকেই সম্ভাবনাময় বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রশ্রয় ও মদদদাতা।
বিগত ১৫ বছর ধরে যারা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরব, তাদের সমস্ত বয়ান-বাক্য ‘নতুন বাংলাদেশে’ এসে খারিজ হয়ে যাচ্ছে। কেননা, আশা করা হয়েছিল এই বাংলাদেশে আর বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটবে না। অথচ, অভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই নির্বিচারে বিচারের আগে বিচার শুরু হয়ে গেছে। জনতাই হয়ে উঠেছেন বিচারক!
আদালতে নেওয়ার সময় গ্রেফতারকৃত আসামিদের ওপর হামলা হয়েছে। সেনাবাহিনী-পুলিশের কাস্টডিতে থাকা ধর্ষণের অভিযোগ করে অভিযুক্তকে থানা থেকে জোরজবস্তি উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও আমরা ভাইরাল হতে দেখেছি অভ্যুত্থানের পরপরই। আশ্চর্যজনকভাবে, যারা এই কাজটা করছিলেন, তারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীই ছিলেন। বুঝে হোক বা না-বুঝে, অভিযুক্তকে ক্রাউডে নিয়ে যাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা, সেটাও যে বিচার বহির্ভূত অবস্থানকে উস্কে দেয় এবং অপরাধীর মানবাধিকার পাওয়ার সুযোগকে সীমিত করে ফেলে, ফ্যাসিবাদী সরকারকে উৎখাতে ভূমিকা পালনকারীরাও সেটা বুঝেননি!
আর গত কয়েকদিনে তো সেই বোঝাপড়ার সীমাবদ্ধতাকে চূড়ান্তরকম প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছেন দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, যারা নানাভাবেই গণ-অবিচার ও গণহিংস্রতার সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং মানুষ হিসেবে আরেকটি মানুষের মানবাধিকারকে ধ্বংস করেছেন।
২.
গত ১৫ জুলাই রাতে বাংলাদেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পরিকল্পিতভাবে হামলা করে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও বহিরাগত সন্ত্রাসীরা। বিশ্ববিদ্যালয় দুটির নাম ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। নির্ঘুম সে রাতে ফেইসবুকে লিখেছিলাম, ‘ক্যাম্পাসগুলোকে ২৫ মার্চের রাতের মতো ভয়াল বানাবেন না।’ বিগত রেজিম-সমর্থক অনেকেই সেটির প্রতিবাদ করেছিলেন। আজ প্রায় দুই মাস পরে আমি আবারও দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, শুধু বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডই নয়, যেকোনো বিচার বহির্ভূত হামলাই যে কারও জীবনে একেকটা ‘২৫ মার্চ রাত’! ওই রাতের ট্রমা এতোটাই ভয়ানক যে, কোনো মানুষ বা গোষ্ঠীর ওপর যখন নির্বিচারে হামলা চলে, তখন সেই মানুষটিও সমট্রমার ভুক্তভোগী হয়ে ওঠেন। নিশ্চয়ই মনোবিজ্ঞানীরা এর যথার্থ ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।
কৌতূহলী যে কেউ ১৫ জুলাই রাতের হামলায় আক্রান্তদের জিজ্ঞেস করতে পারেন, অভ্যুত্থানের পথে মর্মান্তিকভাবে আহত হওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞেস করতে পারেন, আয়নাঘরের বন্দিদের জিজ্ঞেস করতে পারেন, পাহাড়ে দাউদাউ আগুনে নিজের শেষ আশ্রয়স্থল ঘরবাড়ি পুড়তে দেখা পাহাড়িয়া বাসিন্দাদের জিজ্ঞেস করতে পারেন, রাজনৈতিক গণহিংস্রতার শিকার ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের জিজ্ঞেস করতে পারেন। সবার গল্পই এক একটা না-দেখা সেই ২৫ মার্চের অমানিশাকে ফিরিয়ে আনবে। মুক্তিযুদ্ধের অহংকার ও অমানিশা দ্বৈতভাবে এ জাতিরাষ্ট্রের জীবনে আজও কত প্রাসঙ্গিক, তা আপনি মুক্তিযুদ্ধের লড়াইকে অনুভব না করলে বুঝতেই পারবেন না।
কৌতূহলী আপনি বিশ্বজিৎ-জুবায়ের-তনু-মুনিয়া-ত্বকী-আবরারকে জিজ্ঞেস করতে পারতেন, যদি তারা বেঁচে থাকতেন। জিজ্ঞেস করতে পারতেন অভ্যুত্থানের পথে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে শহিদ হওয়া বীরদের, যারা রাজপথে জীবন দিয়েছেন বিপুল পরাক্রমশালী বন্দুকধারীদের গুলিতে। চব্বিশের অভ্যুত্থানোত্তর ‘নতুন বাংলাদেশে’র যাত্রা শুরু হতে না হতেই তথাকথিত ‘গণপিটুনি’র শিকার হয়ে মরে যাওয়ার আগে কেমন ছিল ট্রমা, তা আপনি জিজ্ঞেস করতে পারতেন মাসুদ-তফাজ্জল-শামীমকে। হায়, তারা মরে গেছেন! না, মরেননি, মেরে ফেলা হয়েছে। গণপিটুনির নামে যেগুলোকে সাংস্কৃতিকভাবে জায়েজ করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু, চেষ্টা করে লাভ নেই। আমরা ফয়সালা করে ফেলেছি, গণপিটুনি কোনো বিচার নয়, অবিচার। এই অবিচারের নাম হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এগুলোকে হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বলার যথেষ্ট আইনি ভিত্তি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনে আছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতা হাত-পায়ে পঙ্গুত্ব বরণ করা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের ‘বহিরাগত’ তোফাজ্জল হোসেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লাসহ আরও অনেকেই পরিষ্কার বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কিন্তু, আমরা দেখতে পাচ্ছি, যারা বিগত দিনে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, অন্তবর্তী সরকারে গিয়ে তারা ব্যবস্থাই নিচ্ছেন না। আমরা এমন অভ্যুত্থানোত্তর রাষ্ট্র চাইনি।
৩.
কাকতালীয়ই হয়তো, ১৫ জুলাই রাতে যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিকল্পিতভাবে রাতের অন্ধকারে হামলা চালানো হয়েছিল, গত ১৯ সেপ্টেম্বর সেই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েই দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটল। একটি তোফাজ্জলের, একটি শামীমের।
তোফাজ্জলকে ঠাণ্ডামাথায় খুন করা হয়েছে। মারা হয়েছে, ভাত খাওয়ানো হয়েছে, তারপর আবার মেরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। অথচ, তোফাজ্জল হোসেন ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন। মাত্র আট বছরের ব্যবধানে বাবা-মা-বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে তিনি কেন গিয়েছিলেন, জানা যায়নি। অথচ, তাকে মারা হয়েছে মোবাইল চুরির অপরাধে।
তার পেটে ক্ষুধা থাকলে লোকের কাছে চেয়ে খাওয়ার কথা জানা গেছে, জানিয়েছেন তার মামাতো বোন। তিনি এও জানিয়েছেন যে, ৩৫ হাজার টাকার বিনিময়ে তোফাজ্জলকে ছেড়ে দেয়া হবে, নইলে আরও মারা হবে। তোফাজ্জলের ভাবির কাছে চাওয়া হয়েছে ২ লাখ টাকা। হয় চাঁদা, নয় মৃত্যু— আমল বদলের পরও এসব দেখতে হবে আমাদের!
তোফাজ্জল হয়তো ওই হলে খেতেই গিয়েছিলেন। তার মৃত্যু নিশ্চিত করার আগে তাকে পেট পুড়ে খাওয়ানোও হয়েছে। তার খাওয়া ও খাওয়া-পরবর্তী প্রহারের অবর্ণনীয় ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। বীভৎস!
তোফাজ্জলকে মারার খবর ভাইরাল হওয়ার আগেই নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয় শামীম মোল্লার ঘটনাটি। শামীম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম আবর্তনের ইতিহাস বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৫ জুলাইয়ের রাতের ঘটনাতেও তার সম্পৃক্ততার খবর জানা যায়। কিন্তু, যেভাবে তাকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গিয়ে দফায় দফায় পেটানো হয়েছে, এমনকি প্রক্টরের অফিসেও তাকে নিরাপদে রাখা যায়নি, তা আমাদের নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গঠনের জন্য ভীষণরকম অন্তরায়। এমনকি আশ্চর্য হতে হয়, আহত একজনকে ক্যাম্পাসের অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে না পাঠিয়ে, আগে পুলিশে সোপর্দ করে তারপর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে পুলিশের গাড়িতে!
বিগত রেজিমে যারা সহায়ক হিসেবে বিভিন্ন এলাকা ও ক্যাম্পাসে পেশিশক্তি দেখিয়েছেন, শামীম সে দলেরই অংশ। শামীম জাহাঙ্গীরনগরের স্থানীয়ও বটে। শৈশব থেকে যৌবন সবই কেটেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বা তার আশেপাশে। ক্যাম্পাসের ভাষায় বললে, তিনি ছিলেন ‘লোকাল’ ও ‘পোষ্য’। কিন্তু, শামীমের ব্যাপারে দলমত নির্বিশেষে সবাই বলছেন, শামীম অন্তত ক্যাম্পাসের কারও সঙ্গে এমন কোনো আচরণ করেননি, যা দিয়ে প্রকাশ পায় তিনি দলীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদের ক্ষতিসাধন করেছেন।
এই সাক্ষ্য আমিও দিতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে আমিও তাকে চিনি-জানি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শামীম যে হলে থাকতেন, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে আমিও ছিলাম। তার দুই ক্লাস উপরে পড়তাম। আমরা যখন বের হয়ে আসি, তখন শামীম বড় কোনো নেতা নন। কিন্তু, হলে এক ধরনের প্রভাববলয় তার ছিল। যদিও, মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকলেও শামীম ক্যাম্পাস, হল ও অনুষদের একজন সিনিয়র কিংবা প্রতিপক্ষীয় এক ছাত্রসংগঠনের নেতার সঙ্গে যে আচরণ করা উচিত, ঠিক তেমন আচরণই করেছেন। বহুদিন ক্যাম্পাসে, চায়ের দোকানে এমনকি শামীমদের কক্ষে আড্ডাও হয়েছে আমাদের। আমার বা আমাদের প্রতি তার শ্রদ্ধা-ভালোবাসার কমতি ছিল না।
শামীম আমরা বের হওয়ার অনেক পড়ে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা হয়েছেন। সেই শামীম কেমন ছিলেন, তা আমি জানি না। যদিও আন্দাজ করলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কর্তৃত্ববাদী চেহারাই হয়তো ফুটে উঠবে। কিন্তু, যে শামীমকে আমি চিনতাম, তার মধ্যে যে সারল্য ছিল, সেটিই এখন আমার চোখের সামনে ভাসছে।
শামীমের আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ রাজনৈতিক কারণে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন এই বঙ্গবন্ধু হলেরই আরেক ছাত্রলীগ কর্মী ইংরেজি বিভাগের জুবায়ের আহমেদ। তৎকালীন ‘ভিসিলীগ’ খ্যাত সন্ত্রাসীদের হাতে জুবায়ের প্রহৃত হন ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি, ৯ জানুয়ারি ভোরে তিনি মারা যান। জুবায়ের আমার ব্যাচমেট, বন্ধু ও এক সময়ের রুমমেট ছিল। সেই সময়ের ক্যাম্পাস আমি দেখেছি। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগরে’র ব্যানারে সাড়া জাগানো এক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগরের সে সময়ের শিক্ষার্থীসমাজ। সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিলেন নিপীড়নবিরোধী, আধিপত্যবাদবিরোধী শিক্ষকরা।
জুবায়েরের আগে ছাত্রদলের কবীর ও ছাত্রলীগের আনন্দ হত্যাকাণ্ড ছিল জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে সবচেয়ে সাড়া জাগানো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, কিন্তু সেসবের বিরুদ্ধে সেভাবে আন্দোলন দানা বাঁধেনি, যদিও কিছু সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ক্যাম্পাসে অবশ্যই হয়েছিল। তবে, দুর্বার এক আন্দোলন দানা বেঁধেছিল ২০১২ সালে। সে সময় আন্দোলনকারীরা বলেছিলেন, ‘আর কোনো ফসল কীটে খেতে দিব না।’ সে এক দুর্দমনীয় জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস ছিল। দুর্দান্ত আধিপত্যবাদবিরোধী এক ক্যাম্পাসের জন্ম হয়েছিল অন্তত কিছুদিনের জন্য, এমনকি রাজনৈতিক চড়-থাপ্পরের বিরুদ্ধেও ক্যাম্পাসে মিছিল হয়েছে। সেই ক্যাম্পাসে আবারও কেউ খুন হবেন, তা অকল্পনীয়! ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না! তাই জুবায়েরের পথ ধরে, শামীমও খুন হন! আরও অনেকের সঙ্গে খুনে জড়িত থাকেন কি না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক! ভাবা যায়!
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে হত্যা করা হয়েছে একদম পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ হয়ে। মাসুদ এর আগে ২০১৪ সালে হামলার শিকার হয়ে হাত-পায়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছিলেন, কেটে ফেলা হয়েছিল তার একটি পা এবং আরেকটি পায়ের রগ। ১০ বছর পর তাকে এমনভাবে মারা হয়েছে যে, তিনি আর প্রাণেই বাঁচলেন না! মৃত্যুর আগে তিনি একটু পানি চেয়েছিলেন, সেটুকুও পাননি!
সেই হামলা মাসুদকে রাজনীতি থেকেই চিরতরে অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছিল, পরে তাকে মানবিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের স্টোর কিপারের চাকুরি দেয়া হয়। হত্যার শিকার হওয়ার চার দিন আগে তিনি এক কন্যা সন্তানের পিতা হন। সেই কন্যার জন্যই ওষুধ কিনতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন মাসুদ। ‘নতুন বাংলাদেশ’ মাসুদের মাসুম বাচ্চাকে কী জবাব, আমরা বলতে পারব কি?
৪.
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, এই যে ‘গণপিটুনি’ নামক ‘মব ইনজাস্টিস’ তৈরি হয়েছে, তার থেকে পরিত্রাণের আইনি সুযোগ রাষ্ট্র ও ভুক্তভোগীর আছে। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের জন্য আইনি সুবিধা পাবার অধিকার রেখেছে। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনামে বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ ৩৩ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘একজন ব্যক্তির অবশ্যই তার মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শ এবং নিজেকে সমর্থন করার অধিকার আছে।’ অর্থাৎ, অপরাধ করলেই হবে না, অপরাধীকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দিতে হবে। সেই সুযোগ নিশ্চয়ই মাসুদ-তোফাজ্জল-শামীমের খুনিরাও পাবেন। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না এবং অপরাধের জন্য যতটুকু শাস্তি প্রাপ্য তার চেয়ে বেশি বা ভিন্ন কোনো শাস্তি দেয়া যাবে না।’ আশা করি, খুনিরা এই অনুচ্ছেদের বলে সেই অধিকারও পাবেন।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারায় বলা হয়েছে, অপরাধী ধরা পড়লে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতেই হবে। এর ব্যতিক্রম করলে দণ্ডবিধির ১৮৭ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা হবে। কোনো ব্যক্তিকে আটক করে যদি সামান্য আঘাতও করা হয়, তাহলে ৩১৯ ধারায় উল্লিখিত আঘাতের অপরাধে অপরাধীকে ৩২৩ ধারার অধীনে এক বছরেরর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ১০০০ টাকা জরিমানা করা যাবে। পিটুনিতে কারাদণ্ড হবে অনূর্ধ্ব ৩ বছর ১ মাস এবং অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা। ৩২৫ ধারা অনুযায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত করা হলে সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড হবে। হামলার ফলে ব্যক্তির মৃত্যু হলে ৩০৪ ধারা অনুযায়ী দশ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হবে। আর ধৃত ব্যক্তিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মেরে ফেলার ঘটনাটি প্রমাণিত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব দশ বছর মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হবে। গণপিটুনিতে ব্যক্তি নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারী সবাই সমদোষী। (তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪)
বিবিসি বাংলা লিখেছে, “গণপিটুনিতে যারাই অংশ নিবেন সেটা আদালতে প্রমাণ করা গেলে সবারই শাস্তি নিশ্চিত করার সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে কেউ বড় ধরনের জখল করলেও যে শাস্তি পাবেন, একজন সামান্য ধাক্কা দিলেও একই শাস্তির আওতাভুক্ত হবেন।
এছাড়া গণপিটুনিতে যদি কেউ মারা যায আর সেটা যদি খুন হিসেবে আদালতে প্রমাণ করা যায় তাহলে দণ্ডবিধি-১৮৬০ এর ২৯৯ ধারায় উল্লিখিত খুনের অপরাধে অপরাধীকে ৩০২ ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানা দণ্ডেও দণ্ডিত করা যায়।”
মানবাধিকারের প্রশ্নেও যে কোনো ‘অপরাধী’র আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার আছে। ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার তিন নম্বর অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘এভরিওয়ান হ্যাজ দ্য রাইট টু লাইফ, লিবার্টি এন্ড সিকিউরিটি অব পারসন।’ আর অনুচ্ছেদ পাঁচ বলেছে, ‘নো ওয়ান শ্যাল বি সাবজেক্টেড টু টর্চার অর টু ক্রুয়েল, ইনহুম্যান অর ডিগার্ডিং ট্রিটমেন্ট অর পানিশমেন্ট।’ এছাড়া মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি সকল ব্যক্তিকেই আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকার দিয়েছে, এমনকি বিচার বহির্ভূত হামলা বা হত্যাকাণ্ডকে নাকচ বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে, শুধু বাংলাদেশের আইনই নয়, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইন এবং মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র অনুযায়ী গণপিটুনি আদতেই তথাকথিত ‘মব জাস্টিস’ বা ‘গণবিচার’ নয়, বরং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর সেই গণপিটুনি যদি আদালতে প্রমাণিত হয় তাহলে তার শাস্তি অন্ততপক্ষে ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’। অতএব, গণপিটুনিকে ‘মব জাস্টিস’ হিসেবে জায়েজ করার পাঁয়তারা একদমই গ্রহণযোগ্য না।
৫.
শুধু বিরুদ্ধবাদী রাজনীতি ও ভিন্ন মতাদর্শ ধারণ করার জন্য আর কত জীবন দিতে হবে বাংলাদেশকে? ‘৩৬ জুলাই’ পর্যন্ত আমরা জীবন দিয়েছি, প্রবল পরাক্রমশালীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে। জুলাই শেষ হয়েছে, কিন্তু আমাদের অগাস্ট-সেপ্টেম্বর তো শেষই হচ্ছে না! এর অন্ত কোথায়?
এসব হত্যাকাণ্ডে হতবিহ্বল নেটিজেনরা বলছেন, এ কেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী! এ কেমন বিশ্ববিদ্যালয়! কিন্তু, এটা খুবই বাজে প্রশ্ন। বিশ্ববিদ্যালয় কি সমাজ-রাষ্ট্রের বাইরের কোনো দ্বীপ? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে ক্ষমতাকাঠামোর অংশ হয়ে কি রাষ্ট্রের-সরকারের বড় বড় হর্তাকর্তারা মানুষ গুম-খুন থেকে শুরু করে দেশীয় অর্থপাচার করেননি? তখন আপনি বিশ্ববিদ্যালয়কে কাঠগোড়ায় দাঁড় করান না কেন? আপনি এমন সমাজ নির্মাণ করেছেন যে সমাজ আধিপত্যবাদী-অসহিষ্ণু এবং শক্তি-ক্ষমতা পেয়ে নির্দ্ধিধায় বিনা বিচারে হামলা বা হত্যার পক্ষে জনমত সৃষ্টিকারী। সেই সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আপনি শুদ্ধ হতে বলেন?
আরেকটা স্লোগান ঘুরে বেড়াচ্ছে স্যোশাল মিডিয়ায়, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’ মানে আগে কথা যদি না বলে থাকেন, তাহলে এখনও কথা বলবেন না। তার মানে, আগে যদি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড জায়েজ হয়ে থাকে, তাহলে এখনও জায়েজ! চমৎকার!
সমাজ ও তার আধিপত্যবাদী মনোবৃত্তি বদলাতে না পারলে, কিংবা এই দমন-পীড়নের সাংস্কৃতিক মাৎসান্যায়কে দুমড়েমুচড়ে ফেলার সংস্কৃতি দাঁড় না করাতে পারলে, কোনো বিপ্লবই আপনাকে নতুন মানুষ হিসেবে তৈরি হতে দিবে না। আপনি রাজনৈতিক প্রতিবিপ্লব ঠেকাতে পারবেন, কিন্তু এই যে সাংস্কৃতিক প্রতিবিপ্লব বাংলাদেশে ঘটে গেছে, তাকে ঠেকাবেন কোন পোস্টইডিওলজি দিয়ে, বাহাদুরে শাহেনশাহ!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মাস্টারপিস ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘এই কথা আজ বলে যাব, প্রবলপ্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারি প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে...।’ গত ৫ অগাস্ট বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ঠাকুরের এ বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নতুন বাংলাদেশে আবারও জেগে উঠবে কি না, সেই অনিবার্য প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের জনগণের সামনে। এর উত্তর আমরা জানি, থাকবে না। কিন্তু, বলা যত সহজ, করার জন্য যে সাংস্কৃতিক লড়াইটা প্রয়োজন সেটা হয়তো আমরা করে উঠতে পারিনি। তাই, হয়তো সমতল থেকে পাহাড়, সর্বত্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের জয়জয়কার। এমন ‘নতুন বাংলাদেশ’ আমরা চাই না!
তথ্যগত ঋণস্বীকার: বিডিনিউজ২৪, দৈনিক প্রথম আলো ও বিবিসি বাংলা।