Published : 09 Jun 2025, 06:41 PM
ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি, সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণের প্রশ্নে তিনটি সালের কথা উল্লেখ করেছেন—১৯৭২, ২০১৮ ও ২০২২ সাল। কিন্তু, এই কথার মধ্যেও বিশেষ ফাঁক আছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সূত্রে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, বাহাত্তর থেকে ২০২৫ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বদলানো হয়েছে ১২ বার। এর মধ্যে শুধু সংজ্ঞাই বদল হলো ছয় বার। এছাড়া, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা পরিমার্জন হয়েছে সাত বার। পরিসংখ্যানটা অদ্ভুত শোনালেও, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক রাজনীতির এই হলো সুরতহাল!
সংজ্ঞায়নের জটিল আইনি পরিক্রমা
জামুকা অধ্যাদেশ নিয়ে প্রধান বিতর্কের জায়গা হলো এর মধ্যে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ টার্মটি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা বলেছেন, তারা অধ্যাদেশটির মাধ্যমে বাহাত্তরের আদি সংজ্ঞায় ফিরে গেছেন।
বাহাত্তরে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বিবিসি (৫ জুন, ২০২৫) লিখেছে, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা তৈরি করা হয়। সেই সংজ্ঞায় সশস্ত্র যুদ্ধে যারা অংশ গ্রহণ করেছেন, তাদের পাশাপাশি মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব এবং এমএনএ ও এমপিএ সদস্যদেরও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ছিল।’
এই সংজ্ঞায়নকে ভিত্তি ধরলে বলা যায় যে, ‘মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব’কে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, সর্বশেষ অধ্যাদেশটিতে শুধু ‘মুজিবনগর সরকার’ লেখা হয়েছে, ‘নেতৃত্ব’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে, বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে সূত্র উল্লেখ না করায়, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তাদের এই তথ্যের উৎস কী।
মূলত বাহাত্তর সালে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়নের প্রধান উৎস ‘দ্য বাংলাদেশ (ফ্রিডম ফাইটারস) ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’ সংক্রান্ত ১৯৭২ সালের ৭ অগাস্টের প্রেসিডেন্ট’স অর্ডার (১৯৭২ সালের ৯৪ নম্বর অর্ডার)। পরে, সেই অর্ডারটি সংশোধন করে ‘ফাউন্ডেশনে’র স্থলাভিষিক্ত হয় ‘ট্রাস্ট’ শব্দটি (১৯৭২ সালের ১৫৯ নম্বর অর্ডার)। এটাই ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট’ নামে পরিচিত।
এই দুটি অর্ডারে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণেও কিছু তারতম্য রয়েছে। তবে, সেটি যুক্তকরণের ক্ষেত্রে নয়, বিযুক্তকরণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মানে, আগের অর্ডারের তুলনায় পরের অর্ডার আরও সুনির্দিষ্ট করে বলেছে যে, কারা কারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন না। ফাউন্ডেশন ও ট্রাস্ট, উভয়ের অর্ডারেই বলা হচ্ছে, ‘মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যে কোনো বাহিনীর সদস্য হিসেবে যুদ্ধ করা ব্যক্তি হলেন মুক্তিযোদ্ধা।’
ফাউন্ডেশনের অর্ডারে কারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন না, তার পরিধি ছিল শুধু ‘প্রতিরক্ষা বাহিনী, পুলিশ বা বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য’ পর্যন্ত; এমনকি এখানে ‘চাকুরিরত’ শব্দটিও উল্লেখ ছিল না। তবে, ট্রাস্টের অর্ডারে সেই পরিধি আরও বিস্তৃত: ‘প্রতিরক্ষা বাহিনী, পুলিশ বা বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীতে চাকুরিরত সদস্য, বা সরকারি পেনশনভুক্ত ব্যক্তি, বা নিয়মিত আয়ের উৎস আছে এমন যেকোনো ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা নন।’
যাই হোক, বাহাত্তরের একটা সংজ্ঞা পাওয়া যাচ্ছে ঠিক। সেটা ছিল সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু, এই সংজ্ঞা আসলে পরিপূর্ণ চিত্রও তুলে ধরে না। বরং, এটা কিছুটা সাংঘর্ষিকও বটে। প্রথমে বলা হচ্ছে যে কোনো বাহিনীর সদস্য হিসেবে যুদ্ধকারীরা মুক্তিযোদ্ধা। আবার পরে বলা হচ্ছে, বিভিন্ন বাহিনীর চাকুরিরতরা মুক্তিযোদ্ধা নন। তাহলে, এ সংজ্ঞা থেকে আমরা কী উপসংহারে পৌঁছাব? যদিও, সংজ্ঞাটি থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, সরকার তখন আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিতে চায়নি। রাষ্ট্রই তখন ভঙ্গুর, কতজনকে অর্থ সহায়তা দেবে সরকার!
এর পর, লম্বা বিরতির পর এলো জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন। জামুকা প্রতিষ্ঠাকল্পে এই আইন সর্বপ্রথম গৃহীত হয়েছিল ২০০২ সালে (৮ নং আইন), বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে। সে সময় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণের কোনো প্রয়োজন সরকার অনুভব করেনি এবং বলা চলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার প্রথাগত ‘সরল ব্যাখ্যা’কে গণ্য করেই সে আইনটি বিতর্কহীনভাবে পাস হয়েছিল। ব্যক্তি বা দলীয় আদর্শের কিছুই সে আইনে ছিল না বলে, বিতর্ক থাকার প্রশ্নও ছিল না।
সর্বশেষ দুবার আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার পুনর্সংজ্ঞায়ন করে। ২০১৮ সালে তারা ১৯৭২ সালের ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট’ অর্ডারটি ‘রহিতক্রমে পরিমার্জনপূর্বক যুগোপযোগী’ করে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট’ আইন (২০১৮ সালের ৫১ নং আইন) প্রণয়ন করে। এরপর, ২০২২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০২ সালে সৃষ্ট ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন’টি রহিত করে নতুন আইন প্রণয়ন করে।
ট্রাস্টের আইন (২০১৮) ও জামুকার আইন (২০২২) উভয়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় তেমন কোনো গুরুতর তারতম্যই নেই। গুরুতর পার্থক্য শুধু দেখা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পক্ষ চিহ্নায়নের ক্ষেত্রে, ২০১৮-তে কম ছিল, ২০২২-এ তা আরও বিস্তারিত হয়েছে।
পাঠকের সুবিধার জন্য নিচের তিনটি ছবিতে শুধু পার্থক্যগুলোর ক্ষেত্রে একই রং ব্যবহার করে হাইলাইট করে দেওয়া হলো:
এছাড়া, আলোচিত দুটি আইনের মধ্যে বড় পার্থক্য সূচিত হয়েছে আইনের ‘প্রস্তাবনা’য়।
২০১৮ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইনে লেখা হয়েছে:
“যেহেতু মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধার কল্যাণ সাধনকল্পে Bangladesh (Freedom Fighters) Welfare Trust Order, 1972 (Presidesnt's Order No. 94 of 1972) এর অধীন গঠিত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কর্মের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে এবং অন্যান্য সকল বীর মুক্তিযোদ্ধার কল্যাণ সাধনকল্পে উক্ত Bangladesh (Freedom Fighters) Welfare Trust Order, 1972 রহিতক্রমে পরিমার্জনপূর্বক যুগোপযোগী করিয়া উহা নূতনভাবে প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়;”
তবে, ২০২২ সালের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইনে আওয়ামী লীগের ‘বোধোদয়’ হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর নাম ২০১৮-তে ছাড়া পড়েছে, ফলে এখানে না থাকলেই নয়! যদি তা-ই না হয়, তাহলে দুটি আইনে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়নে এত এত নৈকট্য (নাকি কপি-পেস্ট?) থাকলেও, প্রস্তাবনায় এত পার্থক্য হয় কী করে! এই আইনের ‘প্রস্তাবনা’টি এমন:
“যেহেতু জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখিবার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করিবার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গঠন করিবার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে বিধান করা প্রয়োজন; এবং যেহেতু জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০০২ (২০০২ সনের ৮ নং আইন) রহিতক্রমে পরিমার্জনপূর্বক যুগোপযোগী করিয়া উহা নূতনভাবে প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়;”
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়ন সংক্রান্ত এই জটিল আইনি পরিক্রমা ও পটভূমিতে ভ্রমণ শেষে এখন আমরা হালের সংশোধিত জামুকা অধ্যাদেশ-২০২৫ বোঝার চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু একটি প্রশ্নসূচক নোক্তা দিয়ে এ অংশটি শেষ করতে চাই: ২০১৮ সালের আইনটি সংশোধন না করে অন্তর্বর্তী সরকার ২০২২ সালের আইনটি সংশোধন করতে গেল কেন?
অধ্যাদেশের বিচ্যুতি ও সাংঘর্ষিক বিষয়সমূহ
এ কথা পরিষ্কার যে, আইন শুধু অন্তর্বর্তী সরকার একাই জটিল করেনি। একে জটিল অবস্থায় আনার পেছনে বিগত রাজনৈতিক সরকারগুলোরও ভূমিকা আছে। কিন্তু, আগের আইনসমূহের (অন্তত ২০১৮ ও ২০২২) সুবিধা হলো, ওগুলোতে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’র মতো কোনো জটিল টার্ম ছিল না। ফলে, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়ন প্রশ্নে একটা সাম্যাবস্থা ছিল।
আবার, এটাও বলতে হবে যে, ২০২২ সালের জামুকা আইনে মুক্তিযুদ্ধের স্বত্বাধিকার প্রশ্নে ব্যক্তিপূজা ও দলীয় আদর্শ ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। যদিও, এ সত্য এড়ানোরও সুযোগ নেই যে, মুক্তিযুদ্ধে মানুষ অনিবার্যভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়েই রণাঙ্গনে নেমেছিল। নতুন অধ্যাদেশে সেই সত্যটিকে ক্রিটিক্যালি ও একাডেমিকভাবে বোঝাপড়া না করে অগ্রাহ্য করার রাজনীতি বেশ ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। এখানে আমরা সে বিষয়েই বোঝাপড়া করতে চাই।
২০২৫ সালের সংশোধিত অধ্যাদেশের ধারা ২-এর উপধারা ১০ অনুযায়ী:
“যাহারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রামে-গঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করিয়াছেন এবং যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিলেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাহাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, [আলশামসের পরের ক্রমিকে থাকা মুজাহিদ বাহিনী বিলুপ্ত হয়েছে], তৎকালীন [আগেতৎকালীন ছিল না] মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছেন, এইরূপ সকল বেসামরিক নাগরিক উক্ত সময়ে যাঁহাদের সর্বনিম্ন বয়স সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে; এবং সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ বাহিনী, মুক্তি বাহিনী, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) ও উক্ত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনী, নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স, আনসার সদস্য এবং বাংলাদেশের নিম্নবর্ণিত নাগরিকগণও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হইবেন; যথা:—
(ক) হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাহাদের সহযোগী কর্তৃক নির্যাতিত সকল নারী (বীরাঙ্গনা); এবং
(খ) মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সকল ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা-সহকারী;”
অধ্যাদেশের এই সংশোধিত উপধারাটির শুরুতে ‘যাহারা’ ও ‘যেসব ব্যক্তি’ উল্লেখ করে মূলত সরকার নির্ধারিত বয়সসীমার মধ্যে থাকা বেসামরিক ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। এর পরে, বিভিন্ন বাহিনীর কথা উল্লেখ রয়েছে এবং ‘সদস্য’ শব্দটি থাকায় সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যবৃন্দ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন।
কিন্তু, ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার’ বা ‘মুজিবনগর সরকার’ তো ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন। তাহলে, ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত সংজ্ঞার মধ্যে সংগঠনকে ঢুকিয়ে দেওয়ার ধোঁয়াশা কেন তৈরি করা হলো? এখানে গলদ নেই যারা ভাবছেন, তাদের জন্য একটা সহজ উদাহরণ দেই। ধরেন, নোবেল পুরস্কার যদি কোনো ব্যক্তি ও সংগঠন একই সঙ্গে পান, তাহলে আলাদা করেই ব্যক্তি ও সংগঠনের নাম উল্লেখ করা হয়। যেমন: ড. মুহম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক। যদি শুধু গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পেত, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি তার কর্তাব্যক্তিদের স্বীকৃতি হিসেবে গণ্য হতো না। এরকম অনেক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার নাম উল্লেখ করা যাবে, যারা নোবেল পেয়েছেন, কিন্তু সেই শিরোপা একান্তই তাদের, সংস্থার নেতৃত্বের না। এক্ষেত্রেও, তাই দাঁড়ায়— ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার’ বলতে প্রতিষ্ঠানকেই বোঝায়, তার নেতৃত্বকে না।
এটুকু যদি নরম ধোঁয়াশা হয়, তাহলে গরম ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়েছে উপধারা ১৫(গ) দ্বারা। যেটি আমাদের জানায় যে, উপধারা ১০-এ যা বলা হয়েছে, তা এই উপধারা দ্বারা নাকচ করে দেওয়া হলো! কেমন?
উপধারা ১৫(গ) মূলত সেই ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ সংক্রান্ত ধারা, যা এত এত বিতর্ক সৃষ্টি করল। এই উপধারার সংজ্ঞায় উল্লেখিত ব্যক্তিদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ বলা হচ্ছে: ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সহিত সম্পৃক্ত সকল এম. এন. এ (Member of National Assembly) বা এম. পি. এ. (Member of Provincial Assembly) যাঁহারা পরবর্তীকালে গণপরিষদের সদস্য (Memebr of Constituent Assembly) হিসাবে গণ্য হইয়াছিলেন।’
একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার একদম ধ্রুপদী সংজ্ঞা অনুযায়ী, আইনসভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সরকারেরই অংশ। কেননা, জনপ্রতিনিধি ব্যতিত প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। সে অর্থে, উল্লিখিত এমএনএ ও এমপিএবৃন্দও তাই। শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন আহমেদ কিংবা সে সময়ের নির্বাচিত সকলেরই একদম প্রথম পরিচয় তাঁরা এমএনএ বা এমপিএ। তার পর, তাঁদের কেউ কেউ সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কেউ রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, কেউ প্রধানমন্ত্রী, কেউ বা মন্ত্রী— তাঁদের সবার নাম ও ভূমিকা আমরা জানি।
এখন অধ্যাদেশ শুরুতে একবার বলে ফেলেছে, ‘প্রবাসী সরকার’ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবে। এর আগে উপধারা ১০-এর ব্যাখ্যায় আমরা দেখানোর চেষ্টা করেছি, ‘প্রবাসী সরকার’ টার্মটা কেন ব্যক্তি না; কেন সে সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন ক্যাটাগরিতে পড়ে। ব্যক্তি ক্যাটাগরিটা স্বতন্ত্রভাবে তৈরি হচ্ছে উপধারা ১৫(গ)-তে, যেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ‘সহযোগী’ বলা হয়েছে। তবুও, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে, প্রবাসী সরকার বলতে ব্যক্তিকে বোঝানো হচ্ছে, তাহলে তার অর্থ দাঁড়ায়, প্রবাসী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সকলেই (মূল রাজনৈতিক নেতৃত্ব, জনপ্রতিনিধিবৃন্দ এবং সাচিবিক কর্মকর্তাবৃন্দ) মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু, সেই অধ্যাদেশ যখন পরে এসে বলছে, এমএনএ ও এমপিএবৃন্দ ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হবে, তখন মুজিব-তাজউদ্দিনরাও তো ‘সহযোগী’ না হয়ে পারেন না!
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা মুখে বলেছেন, প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। কিন্তু, মুখে যা-ই বলুন না কেন, আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে আইনটাই মুখ্য। ভবিষ্যতে তার বক্তব্য রেফারেন্স হবে না, আইনটাই হবে। আইনের ভাষায় দ্ব্যর্থবোধকতা থাকলে, বরং সেটাকেই সংশোধন করতে হবে।
আবার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের যে দোহাই দেওয়া হয়েছে, সেখানে কিন্তু এমএনএ-এমপিএ সবাই মিলে স্বাক্ষর করেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। মুজিবনগর সরকার গঠনের আগেই এই ঘোষণাপত্র তৈরি হয়, যেখানে বলা হয়েছে: ‘আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদ গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করিলাম।’
তার মানে, ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা যারা করেছেন, তাদের শুধু অধ্যাদেশের বলে জোরজবরদস্তি অসম্মানিত করা হচ্ছে। সমস্যা আরও ঘনতর হবে, প্রবাসী সরকারের সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদকে বিবেচনায় নিলে, যে উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মণি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর ও মোজাফফর আহমেদ। তারা মুক্তিযোদ্ধা নাকি মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী?
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের এই ব্যাখ্যাকে ‘সঠিক নয়’ বলেছেন। কিন্তু, তিনি যে বাহাত্তরের সংজ্ঞার দোহাই দিয়েছেন, সেখানে কী অসম্পূর্ণতা আছে, সেই সরকারের সকলকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণায় কী আর্থিক সীমাবদ্ধতা ছিল, তা আমরা আলোচনা করেছি।
আবার, সেই সরকারের উদারতাকেও আমলে আনা প্রয়োজন। গণপরিষদের সদস্যরা নিজেরাই নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করেননি, প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও না। এটুকু কাণ্ডজ্ঞান বোধহয় তাদের ছিল। তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে পরবর্তীকালের একটি সরকার। তাতে যতই দলীয় উদ্দেশ্য থাকুক, কারও অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া মন্দ কিছু না।
বরং, যারা স্বীকৃতি দেননি কিংবা এখন স্বীকৃতি কেড়ে নিচ্ছেন, তাদের কাছে প্রশ্ন থাকবে: কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তারা আমাদের ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ ও দেশের জন্ম দেওয়া সে সময়ের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারীদের স্ট্যাটাস দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করেছিলেন বা করছেন?
বাহাত্তরের সংজ্ঞায়ন অপূর্ণ ও কিছু মাত্রায় দ্ব্যর্থবোধক। তাহলে, এই অধ্যাদেশ কী করে বাহাত্তরের সংজ্ঞায়নে প্রত্যাবর্তন করল? আওয়ামী লীগ সরকার একদা আমাদের ‘বাহাত্তরের সংবিধানে পুনর্বহালে’র কাঁচকলা খাইয়েছিল। নিজের ব্যাখ্যার ঢাল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টাকেও কি সে পথেই গেলেন!
লঘু সংঘর্ষ, কিন্তু গুরুতর সমস্যার বীজ
উপরে যা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি থাকার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এগুলোর ব্যাখ্যা ও আইনি অবস্থান সময়ে সময়ে বদলাতে পারে রাজনৈতিক সরকারের আমলে। কিন্তু, উপধারা ১০(খ) এবং উপধারা ১৫(খ)-এর একটি বাক্যাংশের মধ্যে যে গুবলেট পাকানো হয়েছে, তার কী ব্যাখ্যা দেবেন উপদেষ্টা?
এই দুটি পরস্পরের সঙ্গে আপাতভাবে মারাত্মক সাংঘর্ষিক। ১০(খ) বলছে, ‘মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সকল ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা-সহকারী’ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন। কিন্তু, ১৫(খ)-এর ব্যাকাংশ বলছে, ‘সরকার (মুজিবনগর সরকার) কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তার, নার্স বা অন্যান্য সহকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করিয়াছিলেন’ তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’র স্বীকৃতি পাবেন।
এখানে পার্থক্য শুধু দুটি জায়গায়। প্রথমটি ‘ফিল্ড হাসপাতালে’র কথা বলছে। দ্বিতীয়টি ‘সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত’র কথা বলছে। মানে, এর চেয়ে অদ্ভুত সাংঘর্ষিক ‘আইন’ কী হতে পারে! ফিল্ড হাসপাতালের যারা, তারা সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন না? কিংবা ফিল্ড হাসপাতালের অংশ যারা ছিলেন না, তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসাসেবা দেননি? কিংবা সরকার কর্তৃক অন্যান্য পেশাজীবীর নিয়োগ গ্রহণযোগ্য হলেও, চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিতদের নিয়োগ গ্রহণযোগ্য নয়? কিংবা যেখানে পুরো দেশটাই একটা রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছিল, সেখানে ফিল্ড হাসপাতাল মানে কি শুধুই একটা যুযুধান অকুস্থল?
এই যদি হয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি সরকারের আইনি বোঝাপড়া, তাহলে তো গণমাধ্যমের ‘অতিরঞ্জন’ এক অর্থে অতিরঞ্জন কিংবা পূর্বানুমান কিংবা বায়াসড না, সাংবাদিকতার নীতি মেনেই বিশ্লেষণাত্মক ও মূলানুগামী। বরং, ভাষিক ও বাক্যিক প্যাঁচ তো স্পষ্টতই সরকার সৃষ্টি করেছে এবং যথারীতি তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিজেদের মনগড়া ফয়সালা দিয়েছে, যা সর্বমহলে একটা প্রবল প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’র শ্রেণি করা হয়েছে ৫টি। উপধারা ১৫(ক) থেকে উপধারা ১৫(ঙ) পর্যন্ত। আমরা ইতিমধ্যেই ১৫(গ) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। ১৫(খ)-এর একটি বাক্যাংশ নিয়েও বোঝাপড়া করলাম। ১৫(ক) বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠন করা বাংলাদেশিদের বিষয়ে; ১৫(ঘ) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীবৃন্দ ও দেশ-বিদেশে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশি সাংবাদিকদের বিষয়ে; এবং ১৫(ঙ) স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বিষয়ে বলা হয়েছে।
আর একদমই বিশেষভাবে চিহ্নিত করে বলার মতো যেটা, সেটা হলো ১৫(খ)-এর প্রথম বাক্যাংশটি, যেখানে বলা হয়েছে ‘যেসকল ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত… হিসেবে দায়িত্ব পালন করিয়াছিলেন’, তারা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হবেন।
প্রথমত, এই শ্রেণিকরণটি যারপরনাই অপমানজনক। কাউকে আপনি একটি স্বীকৃতি দিয়েছেন, কিন্তু কোনো অপরাধ প্রমাণিত হওয়া ছাড়াই তার স্বীকৃতি কেড়ে নিয়েছেন বা মর্যাদার অবনমন করেছেন, এটা চরম অবিমৃশ্যকারিতা।
দ্বিতীয়ত, এখানে অবনমিত ও অপমানিত হওয়া প্রত্যেকেরই ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত এবং নিশ্চিতভাবেই তাদের অবদানের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের দুটি সরকারই ওয়াকিবহাল ছিল। সরকারিভাবেই তাদের ভূমিকা ও নাম লিপিবদ্ধ থাকার কথা অর্থাৎ কে কোথায় কী করেছেন, তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই স্বীকৃত। ফলে, তারা উড়ে এসে জুড়ে বসেননি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। আর আগেই বলেছি, কোন পরিস্থিতিতে তখনকার সরকার তাদের স্বীকৃতি দেননি, সেটা সংজ্ঞায়ন থেকেই পরিষ্কার।
তৃতীয়ত, আজকের আমলারা নিজেদের স্বার্থে কথা বললেও, তাদের পেশাগত পূর্বসূরিসহ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনকারীদের এমন মর্যাদাহানি ঘটাতে সরকারের ‘সহযোগী’ হয়ে উঠলেন, এটাই আশ্চর্যের বিষয়!
আরও কিছু চিন্তার সংঘর্ষ
আওয়ামী লীগ সরকার উপধারা ১১(ঙ)-তে ‘বীরাঙ্গনা’দের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশের উপধারা ১০(ক)-তে তাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বহাল রেখেছে। কেন ‘বীরাঙ্গনা’রা মুক্তিযোদ্ধা, আর কেন হানাদার ও তাদের দোসরদের ধর্ষণ বা যৌননিপীড়ন কোনো-না-কোনোভাবে এড়াতে পারা নারীরা কিংবা ধর্ষিত হওয়ার পরও সমাজের ভয়ে প্রকাশ করতে না পারা নারীরা বীরাঙ্গনা বা মুক্তিযোদ্ধা নন—এই প্রশ্ন উভয় সরকারকেই করলে, আগের আইন প্রণয়নকারী সরকার যুক্তি দিতে পারে, তারা তো বহু ক্যাটাগরিতেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই বীরাঙ্গনারাও মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু, সংশোধিত অধ্যাদেশ প্রণয়নকারী অন্তর্বর্তী সরকার কী যুক্তি দিবে, যেখানে তাদের মূল উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের খাণ্ডবদাহনের শিকার মানুষদের আইনিপথে বিভক্ত করা?
অধিকন্তু, মুক্তিযোদ্ধা-কেন্দ্রিক এই শ্রেণিকরণ একটা মারাত্মক জায়গা থেকে আমাদের চোখ সরিয়ে ফেলছে। সেটা হলো ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড। যদি, মুক্তিযোদ্ধার এমন শ্রেণিকরণই করা হবে, তাহলে ১৪ ডিসেম্বর যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্বীকৃতি কী হবে? তাদের অনেকেই যুদ্ধকালে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করেছেন। সে কারণেই হানাদার ও তাদের দোসররা এই বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
এরও আগের ইতিহাসের কথা বলি। ১৯৪৭ সালের ১৬ অগাস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত যারা তখনকার পূর্ব বাংলা কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে জীবন দিয়েছেন, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে তাদের অবস্থান কোথায়? তারাই বা কেন শহিদ হিসেবে ‘মুক্তিযোদ্ধা’র স্বীকৃতি পাবেন না? মুক্তিযুদ্ধকে আমরা ৯ মাসে বন্দি করে ফেলেছি, অথচ আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ২৪ বছরের।
রাষ্ট্র কখনও তাদের পরিবারের কথা কেন ভাবেনি? পূর্ববর্তী আইন বা হালের এই অধ্যাদেশের কোনো ধারা-উপধারা স্বাধীনতার আগের ২৪ বছরের শহিদদের ও ১৪ ডিসেম্বরের শহিদদের জন্য কোনো জায়গাই রাখেনি! কেন? তারা ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিয়া শহিদ’ হননি বলে? এটা হলো মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধের চরিত্র থেকে সরিয়ে ফেলার মস্তানি। এ কারণে শহিদ হওয়ার পরও তাদের বা তাদের পরিবারের কোনো জায়গাই নেই আগের আইনে কিংবা এখনকার অধ্যাদেশে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাণিজ্যিকীকরণ ও দলীয়করণে মত্ত থাকা আওয়ামী লীগের কাছে এসব খুব হালকা বিষয় হতে পারে এবং তাদের কাছে রেশিওন্যালিটি প্রত্যাশা করাই বৃথা। কিন্তু, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তুলতে ইতিহাসের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের স্বার্থেই তো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর থাকতে। আছে কি?
আমরা আপাতভাবে এগুলোকে লঘু সংঘর্ষ বলতে পারি, কিন্তু ঐতিহাসিকতার প্রশ্নে এগুলোর বালখিল্য ফয়সালার দরুণ বাংলাদেশ একদিন আবারও ফ্যাসাদে লিপ্ত হবে। নানামুখী সমস্যা সৃষ্টির বীজ হয়ে উঠবে এ ধরনের অবিমৃশ্যকর সিদ্ধান্ত। আমাদের বরং আরও সহজ সমাধানে পৌঁছানো দরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সমস্ত বাণিজ্যের পথ বন্ধ করা প্রয়োজন। (চলবে)
আগের পর্ব
একাত্তর, অমীমাংসা ও আইন-১: জামুকা অধ্যাদেশ কি সংস্কারেরই অংশ?