Published : 03 Jul 2024, 01:59 PM
আগামীকাল অনুষ্ঠেয় যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে সম্ভবত ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ বা টোরি পার্টি নিশ্চিত পরাজয়ের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অবস্থা এমনই বেগতিক যে, কনজারভেটিভ দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এখন যেন অন্তত বিরোধী দলে থাকতে পারেন, ভোটারদের কাছে সেই আবেদন জানাচ্ছেন।
নানা কারণে গত এক বছর ধরে ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা ক্রমেই কমছিল। সম্ভাব্য পরাজয়ের ঝুঁকি এড়াতে আগাম নির্বাচন ঘোষণা করেছিল ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি। এই দলের নেতারা আশা করছেন, হঠাৎ করে নির্বাচন আহ্বান করায় লেবার পার্টির পরিকল্পনাগুলোও মাঠে মারা যাবে। বর্তমানে কমে আসা মুদ্রাস্ফীতিকেও ক্ষমতাসীনরা নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করেছিলেন। সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি আকাশছোঁয়া হলে সরকারকেই দোষারোপ করা হয়ে থাকে। বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার কমের দিকে। কিন্তু এসব কৌশল তাতে খুব একটা কাজ করেনি। জনমত ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল বর্তমান ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি। নিয়মমাফিক পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। অনেকে অক্টোবরে নির্বাচন হতে পারে, এমন অনুমান করলেও বাস্তবে তা হয়নি।
যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে মূলত ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভদের সঙ্গে বিরোধী দলে থাকা লেবার পার্টির মধ্যে। টগবগে সুদর্শন যুবক ৪৪ বছরের ঋষি সুনাক কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০২২ সালে যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তার বয়স ছিল ৪২। আধুনিক সময়ে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে কম বয়সের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। শুধু তাই নয়, তার হাত ধরেই এ-ই প্রথমবার কোনো ব্রিটিশ-ভারতীয় ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
অন্যদিকে লেবার পার্টির নেতৃত্বে রয়েছেন স্যার কিয়ের স্টারমার। তার বয়স ৬১ বছর। ২০২০ সালে জেরেমি করবিনের পর দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হন তিনি। এর আগে 'ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিস'-এর প্রধান ছিলেন স্টারমার। পাবলিক প্রসিকিউশনের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
ভোট পূর্ববর্তী জনমত-জরিপ বলছে ঋষি সুনাকের কনজারভেটিভ দল পার্লামেন্টের ৬৫০টি আসনের মধ্যে স্রেফ ৫৩টি আসন পাবে। ৭২ শতাংশ জনতা কনজারভেটিভ বা বর্তমান শাসক দল বিরোধী মনোভাব পোষণ করছেন। পূর্বাভাস সত্য হলে ৪ জুলাই অনুষ্ঠেয় যুক্তরাজ্যের সংসদ নির্বাচনে বড় হার দেখতে যাচ্ছে ২০১০ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা রক্ষণশীলরা। সেই সঙ্গে প্রায় দেড় যুগ পর ক্ষমতায় ফিরছে লেবাররা।
ঋষি সুনাক যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে উথাল-পাথাল অবস্থা চলছিল। ছয় বছরে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী বদল হয়েছে। ঋষি সুনাক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হবার পর থেকেই নানা চ্যালেঞ্জে সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি সবচেয়ে বড় জুয়াটি খেলেছেন আগাম নির্বাচন ডেকে। কিন্তু তেমন কোনো লাভ হয়নি। অথচ লেবার নেতা স্টারমারকে তেমন কোনো ক্যারিশমা এবং তারকাগুণ ছাড়াই বিপুল জয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা ঋষি সুনাক যে দেশ পরিচালনায় খুব খারাপ ছিলেন, তা বলা যাবে না। শিক্ষার মান, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও মূলধন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কর ছাড়সহ নানা বিষয়ে দলটি ভালো করেছে। ৪৫ দিনের টোরি প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের চেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক যথেষ্ট ভালো। ইউক্রেইন যুদ্ধ ইস্যুসহ নানা বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে এই দল। কিন্তু দলীয় কোন্দল এখন দলটিকে খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে।
সমালোচকদের মতে, টোরি পার্টির এই ভালো পৃষ্ঠা উল্টালে যা দেখা যায়, তার তালিকা খুবই দীর্ঘ ও নিষ্প্রভ— জনপরিসর সংকুচিত হয়েছে; কারাগার ভর্তি হয়ে আছে; স্থানীয় সরকারের কাছে পর্যাপ্ত তহবিল নেই। এছাড়া জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা খাত সরকারের জন্য আর্থিকভাবে ইতিবাচক হলেও সেবা পাওয়াই দুষ্কর। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রতি টোরি সরকার খুবই কঠোর ও এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় অক্ষম। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার মতো ইস্যুতে এই সরকার খুব বেশি ইতিবাচক আচরণ করতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা, অবকাঠামো নির্মাণ খাতেও টোরি সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্রয়োজনীয় আবাসন সরবরাহে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ সঞ্চালনে জাতীয় গ্রিডের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিয়েছে।
টোরি সরকারই সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে ব্রিটেন। ব্রেক্সিটের ফলাফল ইতিবাচক হলেও এর ফলে দলটিতে বিভাজন দেখা দিয়েছে। যে কারণে, ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ের প্রধানমন্ত্রীরা তার আগের প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে হয় বাতিল, নয় সংশোধন করেছেন। ব্রিটেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ভোটারদের উপেক্ষা করেছে টোরি। সব মিলিয়ে টোরিদের সাফল্যের বিপরীতে ব্যর্থতার পাল্লা নেহাত কম নয়। তাই মানুষ পরিবর্তন চাইছে।
প্রতিপক্ষের প্রজ্ঞার কাছেও ঋষি সুনাক মার খেয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, গোটা নির্বাচনি প্রচার ঋষি সুনাক কতটা অযোগ্য সেটাকে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে। কনজারভেটিভ দলের প্রতি বিদ্বেষের ঝড় তোলা হয়েছে। গত ১৪ বছর ধরে এই দলের একের পর এক নেতিবাচক ভূমিকা এই বিদ্বেষের মূলে রয়েছে। আর ঋষি সুনাক সেই বিষোদ্গারের প্রাপকে পরিণত হয়েছেন। মানুষ এখন স্রেফ বদল চাইছেন, বদলের ভাল-মন্দ সম্পর্কে কারোর বিশেষ আগ্রহ নেই।
ব্রেক্সিট ভোটের সময় থেকেই টালমাটাল চলছে ব্রিটেনে। ইউরোজোনের আর্থিক মন্দা ব্রিটেনের বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসেও দেখা যায় সেই মন্দার ঢেউ থেকে বাঁচবার পরিপক্ক উপায় নেই ব্রিটেনের কাছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগ করে জানান ব্রেক্সিট তিনি সামলাতে পারবেন না। ব্রেক্সিট সামলানোর দায়িত্ব পড়ে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের কাঁধে। অর্থনৈতিকভাবে সফল ও কৌশলগত ব্রেক্সিট নিয়মাবলি কার্যকরী করতে ব্যর্থ হন মে। আসরে নামেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। সাধারণ নির্বাচনে বিরোধী লেবার দলের থেকে ৮০ টি আসন সেবার বেশি পেয়েছিল জনসনের কনজারভেটিভ। সেই সরকারে বাঁধ সাধলো কোভিড। কোভিডকালে নিয়ম লঙ্ঘন করে বাসভবন ও সংসদ চত্বরে মোচ্ছব করার স্ক্যান্ডালে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন জনসন। তার ক্যাবিনেটে অর্থসচিব বা চ্যান্সেলর সুনাক কিন্তু কোভিডকালে অর্থনৈতিক ছাড় ও ব্যবসায়িক সুবিধার মাধ্যমে ব্রিটিশ ইকোনমির চাকা সচল রাখেন। জনসন পরবর্তী সময় সর্বকালের স্বল্প মেয়াদকালের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস ব্রিটেনের হাল ধরেন। দেখা যায় ফ্রিজে রাখা লেটুস পাতা সরকারের চেয়ে বেশিদিন টিকে গেছে। ঠিক এই কারণেই ব্রিটেনের সাংবাদিক মহলে ঋষি সুনাককে পরিত্রাতা ও পরিস্থিতির শিকার বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রসঙ্গত, ব্রিটেনের ভোটে বাংলাদেশিদের আলাদা আগ্রহ রয়েছে। যুক্তরাজ্যের ভোটের রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর হচ্ছে বাংলাদেশি কমিউনিটির ভোট৷ এখানে অন্তত ১৬ লাখ বাংলাদেশি মানুষ বসবাস করেন। এর মধ্যে সম্প্রতি কেয়ার ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিটে আরো অন্তত কয়েক হাজার বাংলাদেশি ব্রিটেনে পাড়ি জমিয়েছেন। তারা এবারের নির্বাচনে ঋষি সুনাকের প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার পার্টিকেই এগিয়ে রাখবেন। তা ছাড়া একটি দল যখন টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকে তখন পরিবর্তনের প্রত্যাশা অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। এছাড়া নির্বাচনে ইমিগ্রান্টদের নিয়ে কনজার্ভেটিভ পার্টি বা লেবার পার্টির বেনিফিট বা অন্যান্য পলিসির মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। অনেকটাই হুবহু। তাই পরিবর্তনের লক্ষ্যে লেবার পার্টিকে অনেকে বেছে নিয়েছেন। নির্বাচনে বিভিন্ন দলের মনোনয়নে প্রার্থী হয়েছেন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। লেবার পার্টি থেকে ৮ জন, কনজারভেটিভ থেকে ২ জন, ওয়ার্কার্স পার্টি অব ব্রিটেন থেকে ৩ জন, গ্রিন পার্টি থেকে ৬ জন, রিফর্ম পার্টি থেকে ১ জন, লিবারেল ডেমোক্র্যাটস থেকে ১ জন, সোশ্যালিস্ট পার্টি থেকে ১ জন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ১১ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
সবচেয়ে অবাক হওয়ার মতো ঘটনা হলো, দলের দুর্দিনে টোরি বা কনজারভেটিভ পার্টির নামজাদা খেলোয়াড়রা কেউ সামনে আসছে না। ডেভিড ক্যামেরন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়ে ফিরে এসেছেন। আপাতত তার একমাত্র অ্যাচিভমেন্ট তিনি লর্ড উপাধি পেয়েছেন। বরিস জনসন পত্রিকার কলাম লেখক। লিজ ট্রাস আমেরিকার ইনফোটেনমেন্টে মন দিয়েছেন। টেরেসা মে মাঝেমধ্যে টিভিতে মন্তব্য করেন। কেউই কিন্তু দলকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেননি। ঋষি সুনাক নিজের কেন্দ্র নর্থ ইয়র্কশায়ার থেকেই হয়তো হেরে যাবেন। কারণ একমাস আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম দিন ডি–ডে উদযাপনে তিনি নরম্যান্ডি না গিয়ে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। ব্রিটিশ অহংয়ের সূক্ষ্ম জায়গা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়। আর সুনাকের কেন্দ্রতে বেশিরভাগ পরিবার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত। যাদের এক বা দুই প্রজন্ম যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। সেখানে ডি–ডে উদযাপন মিস করা আর বসে নিজের ডাল কাটা একই জিনিস। তেমনই অক্টোবর-নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচন ঘোষিত হলে মূল্যবৃদ্ধি কিছুটা হ্রাসের দিকে থাকত। সে ক্ষেত্রে পাবলিক সেন্টিমেন্ট কিছুটা হলেও সরকারের দিকে যেত। কিন্তু তা না করে সুনাক হঠাৎ করেই জুলাইয়ে নির্বাচন ঘোষণা করলেন। কানাঘুষো খবর, ইংলিশ চ্যানেলের তীরে এতো অভিবাসী বোঝাই নৌকা ভিড়ছিল যে অভিবাসী ইস্যুতে সুনাক আর ঝুঁকি নিতে চাননি। এরপর নির্বাচনের দিনকে কেন্দ্র করে জুয়া ও বাজি ধরার অভিযোগ ওঠে টোরি এমপিদের উপর। এবং তা প্রমাণিত। কাজেই বিশেষজ্ঞদের মতে, দলের অন্দরেই অন্তর্ঘাতের স্পষ্ট ছাপ। তাই ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ঋষি সুনাক পড়েছেন চক্রব্যূহে এবং এই চক্রব্যূহ ভেদ করে বেরিয়ে আসবেন– এমনটা এখন দুরাশায় পরিণত হয়েছে।