Published : 08 May 2025, 08:22 AM
জমিদারপুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ছিলেন চৌদ্দ ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। ফলে, তাকে আমরা আলালের ঘরের দুলালই ঠাওর করেছি। তবে, এক্ষেত্রে একটি টীকা দেওয়া দরকার। জমিদারপুত্র ও আলালের ঘরের দুলাল হলেই, কেউ রবীন্দ্র-সমসর হতে পারবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। নইলে, রবীন্দ্রনাথের বয়োজ্যেষ্ঠ তেরো ভাইবোনের নাম আমজনতার ঠোঁটস্থ-মুখস্থ থাকত!
সামান্য এই টীকার অভিসন্ধি এটা নয় যে, রবীন্দ্রনাথের অগ্রজবৃন্দ অতি সামান্য ছিলেন। বরং, কোনো তুলনা ছাড়াই বলতে চাইছি, রবীন্দ্রনাথ হওয়া সহজ নয়। অভিজাত হলেও নয়।
আবার, অভিজাত হয়েও, জীবন-সংগ্রাম তো থাকে অনেকেরই। যেমন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাবা প্রভাবশালী আইনজীবী ছিলেন বটে, কিন্তু, ধর্মান্তরিত হওয়ার ‘অপরাধে’ পারিবারিক অর্থানুকূল্য পাননি। জীবন কষ্টক্লেশেই কেটেছে। কিন্তু, তাতে তার প্রতিভা ও প্রথাবিরোধী অবস্থান দুমড়েমুচড়ে যায়নি। নিজ গুণেই তিনি দিকপাল হয়েছেন। যেমনটা তার পরে হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা জীবনানন্দ।
২.
অভিজাত পরিবারের সমগ্র সুবিধা পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিভার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছে, এই দাবিটি অবান্তর ও কুতর্ক মাত্র। বরং, পরিবারের তরফে তার প্রতি যে পরিমাণ নিষেধাজ্ঞা ছিল বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে মেশবার, সেগুলো তাকে দমবন্ধ করে ফেলেছিল বলেই তার নানান লেখায় প্রতিভাত হয়েছে।
তিনি সর্বৈবভাবে প্রাণ ও প্রকৃতির মুক্তিতে নিজের ও সর্বপ্রাণের মুক্তি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন বলেই একদম কৈশোরোর্ত্তীর্ণ বয়সে ‘গুহার আঁধার’ থেকে বহুদূরান্তের ‘মহাসাগরের গান’ শুনতে পেয়েছিলেন। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাকে তিনি এজন্যই প্রাপ্ত বয়সে এসে বলেছিলেন তাঁর সমগ্র সাহিত্য জীবনের নির্যাস। এই সেই কবিতা যেখানে রবীন্দ্র-প্রতিভার প্রথম আলোড়ন ঘটেছিল।
এ কথা সমালোচক মাত্রই স্বীকার করেন যে, প্রতিভা না থাকলে রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না। যে কারও প্রসঙ্গেই চিন্তাগত দ্বন্দ্ব ও পাঠ-পুনর্পাঠ থাকবেই। কিন্তু, চাইলেই তাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া সম্ভব নয় বাঙালির জাতীয় জীবন থেকে। এমনকি তার কঠোর সমালোচকও (নিন্দুক অর্থে নয়) এই খারিজি লাইনে যেতে পারেননি।
রবীন্দ্র-প্রতিভা এতটা যশস্বী যে, মধ্যযুগে জন্মালে বা চৈতন্য-সমসাময়িক হলে, তার খেতাব সম্ভবত অবতারতুল্য হয়ে যেত। তাতে যথেষ্ট ক্ষতি হত শিল্পের। ঊনিশ-বিশ শতকে উন্মেষ ও বিকাশ বলে, রবীন্দ্রনাথ মানুষই রয়েছেন। তাকে অলৌকিকতা-পৌত্তলিকতার পাকেচক্রে পড়তে হয়নি।
এ যুগের বাস্তবতা হলো, অবতারের সমালোচনা করলে ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে। আনন্দের সংবাদ তাই এই যে, মানুষ রবীন্দ্রনাথকে আমরা সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু তাতে ধর্মানুভূতির আলগা সংস্কৃতি নেই।
সমস্যাটা হয় তখন, যখন সমালোচনার এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করা হয়। রবীন্দ্র-পাঠ ছাড়াই রবীন্দ্রনাথের মতো একজনের নিন্দার্থেও সমালোচনা করা কঠিন। কিন্তু, এ এমন যুগ, যখন যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রাধান্য আবার পুনর্জাগরিত হয়েছে। ‘দ্য এইজ অব রিজন’ থেকে এখন সন্তর্পণে আমরা ‘দ্য এইজ অব ফ্যান্টাসি’তে প্রত্যাবর্তন করতে শুরু করেছি। যে কারণে রবীন্দ্রনাথের ক্রিটিক্যাল পাঠও নির্বাসিত হয়ে গেছে—একদল রবীন্দ্র-অন্ধ, আরেক দল রবীন্দ্র-বন্ধ আদর্শে নিমজ্জিত। এ থেকে যেন বাঙালির সবচেয়ে মহাকায় সাংস্কৃতিক আইকনের মুক্তি নেই!
৩.
শ্রেণির বিচারে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই উচ্চবর্গেরই সদস্য। যদিও, জমিদারি তার ভালো লাগত না। বাধ্য হয়ে পিতার আদেশ পালন করেছিলেন এবং একটা পর্যায়ে সে কাজ তার দ্বারা সম্ভব নয় বলে ক্ষান্তও দিয়েছেন। প্রমথনাথ চৌধুরীকে লেখা তার ‘রায়তের কথা’য় তিনি জমিদারি আভিজাত্যের যে সমালোচনা হাজির করেছিলেন, তা আত্মসমালোচনার পাঠ হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লিখেছিলেন: “আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারি। এই কারণেই জমিদারির জমি আঁকড়ে থাকতে আমার অন্তরের প্রবৃত্তি নেই। এই জিনিসটার ’পরে আমার শ্রদ্ধার একান্ত অভাব। আমি জানি জমিদার জমির জোঁক; সে প্যারাসাইট, পরাশ্রিত জীব। আমরা পরিশ্রম না ক’রে, উপার্জন না ক’রে, কোনো যথার্থ দায়িত্ব গ্রহণ না ক’রে ঐশ্বর্য ভোগের দ্বারা দেহকে অপটু ও চিত্তকে অলস করে তুলি। যারা বীর্যের দ্বারা বিলাসের অধিকার লাভ করে আমরা সে জাতির মানুষ নই।”
কিন্তু, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এত বেশি বহুত্বের বিস্তার যে, পরক্ষণেই তিনি যা বলেন, তা নিন্দুকের হাতে চাবুক তুলে দেওয়ার মতো হলেও, সমালোচকের ক্রিটিক্যাল পাঠাভ্যাসে মতান্তরিত বিচারের আবেদন তৈরি করে। তার ভাষায়: “তুমি প্রমাণ করতে চাও যে, আমরা ইংরেজ-রাজসরকারের পুরুষানুক্রমিক গোমস্তা। আমরা এদিকে রাজার নিমক খাচ্ছি, রায়তদের বলছি ‘প্রজা’, তারা আমাদের বলছে ‘রাজা’— মস্ত একটা ফাঁকির মধ্যে আছি। এমন জমিদারি ছেড়ে দিলেই তো হয়। কিন্তু, কাকে ছেড়ে দেব। অন্য এক জমিদারকে? গোলাম-চোর খেলার গোলাম যাকেই গতিয়ে দেই, তার দ্বারা গোলাম-চোরকে ঠকানো হয় না। প্রজাকে ছেড়ে দেব? তখন দেখতে দেখতে এক বড় জমিদারের জায়গায় দশ ছোটো জমিদার গজিয়ে উঠবে। রক্তপিপাসায় বড়ো জোঁকের চেয়ে ছিনে জোঁকের প্রবৃত্তির কোনো পার্থক্য আছে তা বলতে পারি নে। তুমি বলেছে, জমি চাষ করে যে জমি তারই হওয়া উচিত। কেমন করে তা হবে।”
এ হলো আস্ত এক লিবারেল হিউম্যানিস্ট (উদার মানবতাবাদী) সমস্যা। রায়তের দুঃখ বোঝেন, মানবিক হন, জমিদারির সমস্যাও বোঝেন, কিন্তু স্বত্বত্যাগ করতে রাজি নন। সেজন্যই রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবী হয়ে উঠতে পারেন না। বুর্জোয়া মানবতাবাদী ঝোঁক দিয়ে পুঁজির প্রতি যে দায়বদ্ধতা, সেটির এজেন্ট হয়ে ওঠেন তিনি। রবীন্দ্রনাথকে তাই শ্রেণির প্রশ্নে ছাড় দেওয়ার সুযোগ কম।
এ বিবেচনায় নিন্দুক তাকে জমিদারিস্বত্বের ‘দালাল’ বানিয়ে ছাড়বেন এবং যেটুকু তার যুক্তিকে পাটাতনে দাঁড় করানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি করা প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই তুলে দেবেন নবীন পাঠকের কাছে। কিন্তু, উল্টো বক্তব্যটিকে আমলে নিবেন না। পাঠককে বিভ্রান্ত করার এই শিক্ষিত-শয়তানির বহু দৃষ্টান্ত আছে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ারও উপায় আছে। দিলখুলে রবীন্দ্রনাথকে পড়া—আংশিক নয়, পুরোটা।
পড়লে বুঝবেন, রবীন্দ্রনাথের তৈরি উপনিবেশবিরোধী গদ্য ও ভাষা ছাড়া আপনার মাতৃভাষার গত্যন্তর নেই। তার গান-কবিতার মধ্যে আপনি সর্বৈবভাবে মানবমুক্তি ও চিরমানবিক হয়ে ওঠারই অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবেন, পাবেন নারীমুক্তির প্রশ্নে আপসহীন এক ব্যক্তিত্বকে। দেখতে পাবেন তিনি কীভাবে বাউলসঙ্গীত ও লোকগানকে জনসমাজে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। বুঝতে পারবেন, তার শিক্ষাদর্শন কত কার্যকর এক জীবনবোধ গড়ে দিতে পারে আপনার সন্তানের। শুধু কানকথায় না ভড়কে, পড়ার জ্ঞান থাকলে পড়তে সমস্যা কোথায়?
৪.
শ্রেণির প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হলে তার সময়টাকে নিয়ে বোঝাপড়া করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী এক মহাশক্তিধর ঔপনিবেশিক কালের ঔরসে তার জন্ম। সেই কলোনিয়াল রিয়্যালিটিকে তার স্বভাবগত প্রকৃত বাস্তবতা মনে হয়েছিল। কিন্তু, যখন ভারতবর্ষের বাইরে যেতে পারলেন, তখন তার সম্বিৎ ফিরল। তিনি বুঝতে পারলেন উপনিবেশ কী ক্ষতি করে গিয়েছে ভারতবর্ষের। ‘সভ্যতার সংকট’ যে তার জীবনসায়াহ্নে এসে লেখার পরও একটা মাস্টারপিস হয়ে উঠেছিল, সেটির কারণ উপনিবেশ বিষয়ে তার সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির দীর্ঘ রেখাপাত এখানে বিধৃত হয়েছে। তিনি লিখেছেন: “যে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে ইংরেজ আপনার বিশ্বকর্তৃত্ব রক্ষা করে এসেছে তার যথোচিত চর্চা থেকে এই নিঃসহায় দেশ বঞ্চিত। অথচ চক্ষের সামনে দেখলুম জাপান যন্ত্রচালনার যোগে দেখতে দেখতে সর্বতোভাবে কিরকম সম্পদবান হয়ে উঠল।... আর দেখেছি রাশিয়ার মস্কাও নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের আরোগ্যবিস্তারের কী অসামান্য অকৃপণ অধ্যবসায়— সেই অধ্যবসায়ের প্রভাবে এই বৃহৎ সাম্রাজ্যের মূর্খতা ও দৈন্য ও আত্মাবমাননা অপসারিত হয়ে যাচ্ছে।... মস্কাও শহরে গিয়ে রাশিয়ার শাসনকার্যের একটি অসাধারণতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছিল— দেখেছিলেম, সেখানকার মুসলমানদের সঙ্গে রাষ্ট্র-অধিকারের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে অমুসলমানদের কোনো বিরোধ ঘটে না; তাদের উভয়ের মিলিত স্বার্থসম্বন্ধের ভিতরে রয়েছে শাসনব্যবস্থার যথার্থ সত্য ভূমিকা।”
এর সম্পূরক বয়ান হিসেবে ইংরেজ ও সোভিয়েত রাশিয়াকে দুটি বিজাতীয় রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে তুলনা করেও তিনি দেখাতে চেয়েছেন, কী করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিকতার চেয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন মুসলমান সমাজের প্রতি অধিকতর উদার। তিনি যুক্ত করেছেন: “সোভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রিক সম্বন্ধ আছে বহুসংখ্যক মরুচর মুসলমান জাতির। আমি নিজে সাক্ষ্য দিতে পারি, এই জাতিকে সকল দিকে শক্তিমান করে তোলবার জন্য তাদের অধ্যবসায় নিরন্তর।... সেখানকার শাসন বিদেশীয় শক্তির নিদারুণ নিষ্পেষণী যন্ত্রের শাসন নয়। সকল বিষয়ে তাদের সহযোগী ক’রে রাখবার জন্য সোভিয়েট গভর্নমেন্টের চেষ্টার প্রমাণ আমি দেখেছি এবং সে-সম্বন্ধে কিছু পড়েছি। এইরকম গভর্নমেন্টের প্রভাব কোনো অংশে অসম্মানকর নয় এবং তাতে মনুষ্যত্বের হানি করে না। সেখানকার শাসন বিদেশীয় শক্তির নিদারুণ নিষ্পেষণী যন্ত্রের শাসন নয়।”
ঔপনিবেশিকতামুক্ত হতে পারার চরম আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে তিনি পারস্য ও আফগানিস্তানের উদাহরণ টেনে বলেছেন: “দেখে এসেছি, পারস্যদেশ একদিন দুই য়ুরোপীয় জাতির জাঁতার চাপে যখন পিষ্ট হচ্ছিল তখন সেই নির্মম আক্রমণের য়ুরোপীয় দংষ্ট্রাঘাত থেকে আপনাকে মুক্ত করে কেমন করে এই নবজাগ্রত জাতি আত্মশক্তির পূর্ণতাসাধনে প্রবৃত্ত হয়েছে। দেখে এলেম, জরথুস্ট্রিয়ানদের সঙ্গে মুসলমানদের এক কালে যে সাংঘাতিক প্রতিযোগিতা ছিল তার সৌভাগ্যের প্রধান কারণ এই যে, সে য়ুরোপীয় জাতির চক্রান্তজাল থেকে মুক্ত হতে পেরেছিল। সর্বান্তঃকরণে আজ আমি এই পারস্যের কল্যাণ কামনা করি। আমাদের প্রতিবেশী আফগানিস্থানের মধ্যে শিক্ষা এবং সমাজনীতির সেই সার্বজনীন উৎকর্ষ যদিচ এখনো ঘটে নি কিন্তু তার সম্ভাবনা অক্ষুণ্ন রয়েছে, তার একমাত্র কারণ— সভ্যতাগর্বিত কোনো য়ুরোপীয় জাতি তাকে আজও অভিভূত করতে পারেনি।”
অবশ্য এমনও নয় যে, উপনিবেশ ও তার দাক্ষিণ্যে আসা ‘সভ্যতা’কে তিনি সেই ১৯৪১ সালে গিয়ে চিনেছিলেন। নইলে তিনি ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় ব্রিটিশের দান করা ‘নবসভ্যতা’কে তীব্রভাবে কুঠারাঘাত করতে পারতেন না ১৮৯৫-৯৬ সালে। মাত্র ৩১ বছর বয়সে, ঔপনিবেশিক শিক্ষার কদর্য দিককে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে পারতেন না ১৮৯২ সালে, যে শিক্ষা ভারতবর্ষের সমাজবদ্ধ হয়ে থাকার সদাচারের বিপরীতে শিখিয়েছিল ‘পৃথিবীতে কে কাহার’!
আবার, সমস্যা হলো, রবীন্দ্রনাথ নিজেও তার গানে বলে বসবেন আপনার ডাক শুনে কেউ না এলে ‘একলা চলো রে’। এই তো হলো প্রকৃত মনুষ্যরূপ ভ্রান্তিপাশ। খুব আলগা করে বলবেন, মনে হবে অত্যন্ত নরমপন্থা এক। কিন্তু আমাদের তো দেখতে হবে শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে। অথচ, তিনি অতিমানব অবতারতুল্য হলে, তার এসব ভুল নজরেই আসত না হয়তো। নজরে এলেও বলতে বাধত। এই বাধত যাদের তারা হলেন রবীন্দ্র-অন্ধ, ভদ্রবিত্ত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি— সংগ্রামে নেই, সৌখিনতায় আছেন এবং রবীন্দ্রনাথকে আমজনতার নাগাল থেকে একদম দূরে নিয়ে গিয়ে আদর করে অভিজাত বানিয়ে রেখেছেন।
৫.
জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় অভিশাপ’ (ন্যাশনালিজম ইন ইন্ডিয়া)। সেই সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে নিরস্ত্র রাখতে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন বিশ্বমানব হয়ে ওঠার। ‘বিশ্বভারতী’ প্রপঞ্চকে তিনি লালন করতেন, পালনও করতেন। সমাজের প্রতি ছিল তার অগাধ আস্থা, তবে তিনি মার্কসীয় মতানুসারে মোটেও সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। অথচ, সমাজতন্ত্রের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ ছিল চোখে পড়ার মতো। এই আলাপই দেখা যাচ্ছে ‘সভ্যতার সংকটে’, তারও আগে ‘রাশিয়ার চিঠি’তে।
‘সভ্যতার সংকট’ লেখা হয়েছিল ১৯৪১ সালে, ‘রাশিয়ার চিঠি’ ১৯৩০ সালে। মানে, জীবনের শেষ দশকে। এসব লেখায় তিনি ১৯১৭ সালে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রসঙ্গে তার উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করেছেন। ‘রাশিয়ার চিঠি’ ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর তা নিষিদ্ধ করেছিল ব্রিটিশ সরকার— এ প্রসঙ্গটি প্রায় অনালোচিতই থাকে অধুনা বিদ্বৎসমাজে। কেন? সে এক বড় প্রশ্ন। রবীন্দ্রনাথ সমাজতন্ত্রের প্রশংসা করেছিলেন বলে? চরিত্র হিসেবে রবীন্দ্রনাথ এতই শক্তিশালী যে, তার বিশেষ এজেন্ডায় লেখা গ্রন্থ ঔপনিবেশিক সরকার নিষিদ্ধ করেছিল, তা বললে সমাজে এটির বিপুল প্রভাব তৈরি হতে পারে বলে?
‘রাশিয়ার চিঠি’ থেকে বিপুল পরিমাণ উদাহরণ দেওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে থাকা মানবমুখী ও পরিবর্তনকামী প্রজ্ঞার। কিন্তু, এখানে আমরা শিক্ষা প্রসঙ্গে তার এক ক্ষুদ্র মতামত তুলে ধরতে চাইব। তিনি লিখেছেন: “আমাদের সকল সমস্যার সব চেয়ে বড়ো রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত—ভারতবর্ষ তো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত। এখানে [রাশিয়ায়] সেই শিক্ষা যে কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয়, তার সম্পূর্ণতায়, তার প্রবলতায়। কোনো মানুষই যাতে নিঃসহায় ও নিষ্কর্মা হয়ে না থাকে এ জন্যে কী প্রচুর আয়োজন ও কী বিপুল উদ্যম। শুধু শ্বেত-রাশিয়ার জন্যে নয়—মধ্য-এশিয়ার অর্ধসভ্য জাতের মধ্যেও এরা বন্যার মতো বেগে শিক্ষা বিস্তার করে চলেছে; সায়েন্সের শেষ-ফসল পর্যন্ত যাতে তারা পায় এইজন্যে প্রয়াসের অন্ত নেই।”
[লক্ষ্যণীয় হলো, রবীন্দ্রনাথ কাউকে ‘অর্ধসভ্য জাত’ বলছেন। যা বিস্ময়কর! তাহলে ‘সভ্যতার প্রতি’ কিংবা ‘সভ্যতার সংকটে’ তিনি যে ব্রিটিশরাজ প্রণীত খোদ ‘সভ্যতা’ প্রপঞ্চটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, সেটাকে কীভাবে সমালোচনার দর্পণে দেখা যাবে?]
শিক্ষা প্রসঙ্গে এর পর তিনি যা লিখেছেন, তা আদতে জীবনভর প্রতিপালন করা তার শিক্ষাদর্শন এবং ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার ধারাবাহিক সমালোচনারই সারবত্তা: “এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই তা বলি নে; গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে—কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না—সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিংবা কালের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।... স্বভাবতই পাঠবিভাগের চরম লক্ষ্য হয়েছে পরীক্ষায় পাস করা, আর সব-কিছুই উপলক্ষ; অর্থাৎ হলে ভালোই, না হলেও ক্ষতি নেই। আমাদের অলস মন জবরদস্ত দায়িত্বের বাইরে কাজ বাড়াতে অনিচ্ছুক। তা ছাড়া শিশুকাল থেকই আমরা পুঁথিমুখস্থ বিদ্যাতেই অভ্যস্ত।”
তাকে বোঝাপড়া করার ব্যাপারটা তাই এত সহজ নয়। অন্ধপন্থিদের জন্য তো নয়ই, বন্ধপন্থিদের জন্যও নয়। অন্ধপন্থিরা তাকে ক্রিটিক্যালি পাঠ করতে চাইবেন না, দেবতাজ্ঞান করবেন। বন্ধপন্থিরাও না, জাতশত্রু জ্ঞান করবেন। এই দ্বন্দ্বে ক্ষতিটা হয়েছে ঠাকুরেরই। ক্রিটিক্যাল পাঠ ছাড়াই তার ব্যাপারে আমাদের বন্ধপন্থি লাইনটা খারিজি হয়ে উঠেছে দিনের পর দিন। ঠাকুর আপনার কোন জীবনের শত্রু লাগেন, মহাত্মন? শ্রেণিশত্রু? তা তো বলতে পারছেন না, কেননা ওই শ্রেণিটির প্রতি আপনার বিশেষ দরদ আছে। তাহলে তাকে এত ডরান কেন আপনি?
৬.
কোন বাছবিচার ছাড়াই তৈরি হয়েছে পাইকারি দঙ্গল এবং কান-কথায় বিশ্বাসীদের সমাবেশ। বেড়েছে আবেগসর্বস্ব রবীন্দ্রবিরোধিতা। ধরাশায়ী হচ্ছেন তিনি নানা তরিকায়। তাকে উগ্রপন্থায় নিষিদ্ধ করার প্রাণান্ত চেষ্টাও চলছে মাঠের রাজনীতিতে।
পাকিস্তান আমলে শাসকরা তাকে নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগেছিলেন, তাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শবিরোধী সাব্যস্ত করেছিলেন। সেই পালে হাওয়া দিয়েছিল বাঙালিদেরই একটি রবীন্দ্রবিরোধী ক্ষুদ্রাংশ। নিষিদ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বেতারে ও সর্বত্র। পশ্চিম পাকিস্তানিরা রাষ্ট্র ক্ষমতার জোরে রবীন্দ্রনাথকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল। আজ রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই, শুধু সংখ্যাধিক্যের দঙ্গল তৈরি করতে পারলেই রবীন্দ্রনাথকে ভয় পাইয়ে দেওয়া যায়, তার লেখা জাতীয় সঙ্গীতকে বাজেয়াপ্ত করার স্লোগান তোলা যায়। তাকে নিয়ে হুমায়ুন আজাদের মতো কট্টোর সমালোচকের বক্তব্য এমন: “রবীন্দ্রনাথ— যাঁকে বাতিলের চেষ্টা করে আসছে নষ্টরা পবিত্র পাকিস্তানের কাল থেকে; পেরে ওঠে নি। এমনই প্রতিভা ঐ কবির, তাঁকে বেতার থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয় জুড়ে বাজেন; তাঁকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয়ের কাব্যগ্রন্থে মুদ্রিত হয়ে যান, তাঁকে বঙ্গভবন থেকে বাদ দেওয়া হলে তিনি সমগ্র বঙ্গদেশ দখল করেন; তাঁর একটি সঙ্গীত নিষিদ্ধ হলে তিনি জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠেন।
“প্রতিক্রিয়াশীল নষ্টরা অনেক লড়াই করেছে তাঁর সাথে, পেরে ওঠে নি; তাঁকে মাটি থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি আকাশ হয়ে ওঠেন; জীবন থেকে তাঁকে নির্বাসিত করা হলে তিনি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন জাতির স্বপ্নালোকে। নষ্টরা তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে আপ্রাণ। যদিও তিনি জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, তবুও তিনি জাতীয় কবি নন। তাঁর নামে ঢাকায় একটি রাস্তাও নেই; সংস্থা তো নেই। তাতে কিছু যায় আসে নি তাঁর; দশকে দশকে বহু একনায়ক মিশে যাবে মাটিতে। তিনি বেঁচে থাকবেন বাঙলায় ও বিশ্বে।”
আজাদের এই বয়ানকে আজ আবেগ হিসেবে পাঠ করার যথেষ্ট কারণ আছে এবং দেখা যাবে, যে প্রেক্ষাপটে তিনি এই কথা বলেছিলেন, তার থেকে অনেক দূরে এ জাতির মনস্তত্ত্ব। কেননা, পাকিস্তান আমলের সঙ্গে হাল আমলের বেশ তারতম্য ঘটে গেছে খোদ বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরই পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তা বহু বছর ধরেই। তখন পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্র-বিরোধীদের সংখ্যা রবীন্দ্রনাথকে রক্ষা করতে চাওয়াদের তুলনায় খুব বেশি ছিল না। তাছাড়া, পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক পার্থক্য ও তার আধিপত্য এতটা গভীরে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল যে, রবীন্দ্রনাথ খোদ হয়ে উঠেছিলেন আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনেরই লড়াইয়ের অনুষঙ্গ। আজ পাকিস্তান নেই, তবুও বাঙালি-অধ্যুষিত বাংলাদেশেও রবীন্দ্রনাথ আরও একবার সংকটাপন্ন হয়েছেন, শুধু তিনি সংখ্যাগুরুর সধর্মীয় নন বলে।
ফরহাদ মজহার অনেক পরে, ২০০৮ সালে লিখেছিলেন তাঁর ‘রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ’ (নব্বই দশকের শুরুতে লেখা রবীন্দ্র-বিষয়ক প্রবন্ধসমূহের সংকলন) গ্রন্থটি, যেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মর্মোদ্ধার করে লিখেছেন: “তিনি একটি বিশেষ সম্প্রদায়ে নিজের অন্তর্ভুক্তিকে কখনোই অস্বীকার করেন নি। করেন নি বলেই মুসলমান লেখককেও তার সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করেছেন, বাংলা ভাষা ও গদ্যের বিকাশ সাধনে তাদের নিজস্ব অধিকারকে মেনে নিয়েছেন। নইলে মুসলমান লেখকদের মুসলমানি জীবনযাত্রার বর্ণনা করতে বলতেন না, নিজেই অন্য সম্প্রদায়ের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে মুসলমান জীবনযাত্রার বর্ণনায় লেগে যেতেন। নিজের সম্প্রদায়, ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে অস্বীকার কিম্বা বিসর্জন দেওয়াটাকে অসাম্প্রদায়িকতা বলে না, এই বুদ্ধিটুকু রবীন্দ্রনাথের ছিল।”
৭.
রবীন্দ্রনাথের অনেক কিছুই আছে। আবার অনেক কিছুই নেই। বিস্তারে না গিয়েই বলা যাবে, তার না থাকার পাল্লাই সম্ভবত বেশি ভারী হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি না-থাকা জুড়ে আছে তার ‘পলিটিক্যাল এজেন্সি’। স্পষ্ট করে বললে, রাজনৈতিক পার্টি। যেহেতু তার কোনো রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক উত্তরাধিকার নেই, মাঠের রাজনীতিতে তার প্রতি ধেয়ে আসা নিন্দাবলীর পাল্টা জবাব দেওয়ার মতো রাজনৈতিক শক্তিও তাই নেই। কিন্তু, যদি পলিটিক্যাল উত্তরাধিকার তার থাকত বা থাকেও, তাহলেও বা কীভাবে দেওয়া হবে এ জবাব?
সমালোচনাকারীর ঘরবাড়ি ভেঙে? প্রতিকৃতি মুছে? ছবিতে কালি মেরে? অসত্য তথ্য দিয়ে দঙ্গল তৈরি করে? মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি করে? গণহামলায় আহত-নিহত করে? পেশিশক্তি দেখিয়ে? সংখ্যার ভিত্তিতে বৃহত্তর শক্তির গরিমায়? তাই বই পুড়িয়ে? তার বই থাকার ‘অপরাধে’ লাইব্রেরি পুড়িয়ে? পাঠ্যপুস্তক থেকে নিষিদ্ধ করে? ইত্যাদি? ইত্যাদি?
না, এসবে রবীন্দ্রনাথের সায় নেই। এই ক্ষমতার চর্চা, আধিপত্যবাদী রাজনীতি, সাংখ্যিক বৃহদাকায়ের দাপট— এসব মাস্তানি থেকে অনেক দূরে পড়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের পলিটিক্যাল এজেন্সি। তাই তিনি মৃত্যুর মাত্র তিন মাস আগেও সেই ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধেই সতর্ক করে বলতে পারেন: “প্রবলপ্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারি প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে।”
রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং আধিপত্যবাদবিরোধী এবং আধিপত্যবিরোধী হওয়ার শিক্ষাই তিনি আমাদের দেন। তার বহু বক্তব্য সত্যদ্রষ্টার মতোই এত বছর পরেও প্রযোজ্য ও প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে। প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা টেকে না। ১৯৪৭, ১৯৭১, ১৯৯০ সাল এবং ২০২৪ সালে তা প্রমাণিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। রবীন্দ্রনাথের রাজনীতির এই হলো প্রকৃত সত্য এবং সে সত্য প্রমাণের জন্য বহু রাজনৈতিক উত্তরসূরি কোনো এজেন্সি ছাড়াই তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে যাবেন।