Published : 24 May 2025, 08:53 PM
দেশের জনগণের জন্য সবচেয়ে উৎকণ্ঠার সময় গেল এই মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহটা। অন্তত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য সরকারের পটপরিবর্তনের পর এমন গুমোট পরিস্থিতি আর তৈরি হয়নি। চারিদিকে কেমন জানি অস্থিরতা, যেখানেই যাই– প্রশ্ন একটাই। কি হতে যাচ্ছে? কেন এই নীরবতা?
ঘটনার শুরু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারের যে প্রস্তাব তার সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধানের ভিন্নমতের মধ্য দিয়ে। তবে বুদবুদ শুরু হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার বিমসটেক সম্মেলনের পর। খলিলুর রহমানকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগের মধ্য দিয়ে। প্রথমে প্রশ্ন উঠে তাকে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার যথার্থতা নিয়ে। আসলে এই সরকারের যাবতীয় নিয়োগের মধ্যে কেমন যেন খাপছাড়া ভাব সরকারের প্রথম দিন থেকেই আমার নজর এড়ায়নি। সরকারের বিভিন্ন পদে যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তাদের নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক হতে দেখা যায়। নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গেই অনেককে পরিবর্তনও করা হয়। অনেক সময় নিয়োগের প্রচারপত্র প্রকাশের আগেই তা বাতিল করতে হয়েছে।
এই যে অস্থিরতা সরকারের মধ্যে দেখা গিয়েছিল সেখান থেকেই সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধান প্রয়োজনীয় সংকেত পেয়ে যান যে মুহম্মদ ইউনূসের সরকার কোন এক অদৃশ্য কারণে আস্থার সংকটে ভুগছে। তাই সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে যতটুকুই সম্ভব দূরত্ব রেখে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের রুটিন কাজ করে চলেছে।
শুনেছি দায়িত্ব গ্রহণের আগেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ প্রতিনিধি, নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কারণে কিভাবে রাখাইন জনগোষ্ঠির কাছে জরুরি খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় রসদ পাঠানো হবে তা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিয়েছিলেন কোন এক জেনারেলস মিটিংয়ে। আর যতটুকু জেনেছি ওই প্রেজেন্টেশনের দর্শক-শ্রোতা ছিলেন আমাদের সব জেনারেল। ওই মিটিং এ উচ্চাকাঙ্ক্ষী কোনো পরিকল্পনা দেওয়া হয়নি বরং ওই মিটিং ছিল শুধু রাখাইন রাজ্যের দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি নিয়ে।
এরপর প্রধান উপদেষ্টা যান চীন সফরে। হয় বিমসটেক মিটিং। এরপর সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের দেশত্যাগ, যাকে পলায়নও বলা হচ্ছে, পরপরই আওয়ামী লীগেকে নিষিদ্ধ করার আন্দোলন শুরু হয়। ধারনা করা হয় এ কারণেই সেনাপ্রধানের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ফাঁস হয়ে যায় সরকারের রাখাইনে জাতিসংঘ কর্তৃক জরুরি খাদ্য সামগ্রী প্রেরণে অনুরোধের বিষয়। নীতিগতভাবে জাতিসংঘের এই অনুরোধ রাখলে রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসনের সুযোগ তৈরি হবে। বিষয়টি প্রথম ভারতীয় মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায় যে সরকারের এই পরিকল্পনার সঙ্গে সেনাপ্রধান একমত নন, যার কারণে সরকারের সঙ্গে সেনাপ্রধানের সম্পর্কে দূরত্ব দৃশ্যমান হয়। আর এই দূরত্ব তৈরি হওয়ার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তাকে ঘিরে এবং চট্টগ্রাম বন্দরে একটি বিদেশি কোম্পানিকে অপারেটর হিসেবে নিয়োজিত করাকে কেন্দ্র করে। ফলে এই দূরত্ব এক লাফে এমন পর্যায়ে যায় যে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২১ মে অনুষ্ঠিত সেনাবাহিনীর দরবারে।
দুটি ইস্যু দুই ধরনের, কিন্তু চাইলে যে কেউ উভয় ইস্যুকেই নিরাপত্তার প্রিজম দিয়ে দেখতে পারেন। এ বিষয়ে আলোকপাত করার আগে একটি কথা না বললেই নয়, তা হল সেনাবাহিনী আর মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল পাশ্ববর্তী দেশের প্রায় সব মিডিয়া। শুধু তাই নয়, ওই মিডিয়াগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা সীমিত করার জন্য সেনাপ্রধানকে কি করতে হবে সেই সব নির্দেশনামূলক রচনাও প্রকাশ করতে থাকে। রাখাইনে মানবিক সাহায্যের জন্য জরুরি খাদ্য সরবরাহের অনুরোধ বিবেচনায় নিলে তা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথে হতে পারত প্রথমধাপ।
রোহিঙ্গা ইস্যুটির ব্যাপ্তি অনেক দিক ছড়িয়ে থাকায় শুধু বাংলাদেশের পক্ষে একা এর সফল সমাধান বের করা সম্ভব নয়। এখানে বাহ্যিকভাবে বিধিবদ্ধ তিনটি পক্ষ জড়িত; মিয়ানমারের জান্তা, বাংলাদেশ এবং ইউএনএইচসিআর (ইউএন)। এর বাইরে যুদ্ধরত আরাকান আর্মি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি এবং রাখাইনের বর্তমান জনগোষ্ঠি। এর বাইরে ভারত, যাদেরকে রোহিঙ্গাদের পুঁজি করে তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিয়ানমার জান্তাকে এই সমস্যা তৈরির জন্য উস্কানিদাতা বলে মনে করা হয়। চীন এর ন্যাচারাল বেনিফিসিয়ারি। আরও এক অদৃশ্য স্টেকহোল্ডার যুক্তরাষ্ট্র, ভূ-রাজনৈতিক কারণে চীনকে মুষ্ঠিবদ্ধ করা যাদের উদ্দেশ্য।
এর পরের ইস্যুটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালনা নিয়ে একটি বিদেশি কোম্পানিকে অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে।
ইস্যু যাই হোক না কেন বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার শুধুমাত্র সরকারের। সরকারই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র কর্তৃপক্ষ। রাখাইন রাজ্যে খাদ্যসামগ্রী প্রেরণের মূল উদ্যোক্তা জাতিসংঘ, কিন্তু জাতিসংঘের এই অনুরোধ বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব যৌক্তিকভাবে সরকারের। রাখাইনে রসদ পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড ব্যবহার হবে, যা ভবিষ্যতে যে কোনো কারণে দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে আর সে কারণেই সেনাবাহিনী ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীর সম্পৃক্ততা এসে যায়।
সরকার যা সিদ্ধান্ত নেয় তা কখনোই রাজনৈতিক ভাবধারার বাইরে নয়। নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার যে দেশের মানুষের জন্য কত কল্যাণকর তা আমরা বিগত ১৫ বছর হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। রাজনৈতিক দলের শাসন যে সবসময় গণতান্ত্রিক নয় এবং দেশের স্বার্থের জন্য মঙ্গল আনে না তা মোটামুটি এদেশের সব মানুষেরই জানা হয়ে গিয়ে শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের ছায়াতলে। তবু রাজনৈতিক সরকারকেই সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। ওই রাজনৈতিক সরকার সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত হয়ে আসার পর। এখন রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণ দিয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর এবং দেশের জন্য যা ভালো তাই তিনি করবেন এখনও এই আশা দেশের অধিকাংশ মানুষের– অন্তত আমার এটাই মনে হয়।
মনে রাখতে হবে সশস্ত্র বাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তাবাহিনীও সরকারের অধীনে নিয়ন্ত্রিত সরকারের পেশাদার সংস্থা। তাদের স্ট্যাটাস ইন্ডিপেন্ডেন্ট নয়। তাদের সাংগঠনিক প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ নিজ নিজ বাহিনীর কিন্তু তাদের শক্তি কোথায় কখন ব্যবহৃত হবে তার সিদ্ধান্ত সরকারের। এক্ষেত্রে বাহিনীর প্রধানরা সরকারকে সফল হওয়ার পরামর্শ দেবেন– এইটাই গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রচলিত প্রথা। তবে সেই মতামত গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার এখতিয়ার সরকারের। সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু থেকে আদেশ পাওয়া অবধি পুরোটাই এক অভ্যন্তরীণ অনুশীলন। কোনো দেশেই তাদের সরকার রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাহিনী প্রধানদের মতামত গ্রহণ করা না হলে তা বিশ্ববাসীকে জানান দেন না।
যদি সরকার সেনাপ্রধানকে জাতিসংঘের মানবিক সাহায্য প্রদানের জন্য রাখাইন করিডোর নিয়ে একটি বা একের অধিক পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দিত এবং তা কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সেই রূপরেখা প্রধান উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করতে বলত তাহলে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। আর এর ফলে সশস্ত্রবাহিনী ও সরকার যে এই দায়িত্বে একই পক্ষভুক্ত আছে তা-ও প্রমাণিত হতো। এখানে সশস্ত্রবাহিনী এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কি ধরণের ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আছে এবং তা উতরানোর উপায় উদ্ভাবন করা যেত। তাতে কেউ কোন অজুহাতে এই পরিকল্পনাকে শুধু সশস্ত্রবাহিনীর বা শুধু সরকারের এক তরফা উদ্যোগ বলে এড়াবার সুযোগ পেত না। ফলে দেশবাসীকেও আজকের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না।
যেমনটি বলছিলাম যে রাখাইন রাজ্যে খাদ্যসামগ্রী প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শক্তির এবং সংস্থার সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের পথ খোলার সুযোগ পেত। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের কাঁধে প্রবলভাবে চেপেছে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় আগে। এই দীর্ঘ সময় এই সমস্যার কোনো সমাধানের বাস্তব পন্থা কেউ বের করতে পারেনি।
মোটাদাগে এই ধরনের সমস্যার দুটি সমাধান হতে পারে, ১. সামরিক ও ২. কূটনৈতিক।
এখানে বলে রাখা ভালো কূটনৈতিক সমধানই আকাঙ্ক্ষিত, তবে তা অর্জনের জন্যও শক্তিশালী সামরিক যোগ্যতা থাকতে হবে। ভূ-রাজনীতির এ অংশকে ‘কোয়েরসিভ ডিপ্লোমেসি’ বলা হয়, যে কোনো দেশের সামরিক বাহিনী দেশের জন্য সেই সক্ষমতা অর্জন করে।
রোহিঙ্গা সমস্যার শুরু থেকেই তো রাজনৈতিক সরকার ছিল। তাহলে রোহিঙ্গারা যে দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি এই যুক্তিতে গত ১২ বছরে সশস্ত্রবাহিনী কেন সরকারের কাছে তাদের মতামত তুলে ধরে সমস্যার সমাধান চাইল না? কারণ শুধু সশস্ত্রবাহিনী নয় রাজনৈতিক সরকারও যে এই সমস্যার গভীরে প্রবেশ করেনি বা এর জন্য কোনো পরিকল্পনা করেনি এবং কূটনৈতিক চাপ বাড়ানোর জন্য নিজেদের শক্তিমত্তা বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা করেনি, বা যথেষ্ট কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেনি এখনকার সমন্বয়হীনতা তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। অধ্যাপক ইউনূসের সরকার হতে পারে অরাজনৈতিক কিন্তু তার কূটনৈতিক ধার এবং ভার দুটিই দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক সরকারের চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি। এই সক্ষমতা আমি চ্যলেঞ্জ করে বলতে পারি আর কেউ অর্জনও করতে পারবে না এবং অদূর ভবিষ্যতে দেখাতে পারবে, এমন আশা করাটাও দুরূহ। এবার যদি রোহিঙ্গাদের সফলভাবে ফেরত না পাঠানো যায় বাংলাদেশকে এই বোঝা চিরকাল বহন করতে হবে।
সশস্ত্রবাহিনী ভাল আন্দাজ করতে পারবে তারা নিজেদের শক্তিমত্তা দেখিয়ে মিয়ানমার জান্তা বা আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গাদের পুর্নবাসন মেনে নেওয়ার জন্য বাধ্য করতে পারবে কিনা? রোহিঙ্গাদের পুর্নবাসন এবারে মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের সক্ষমতাকে কাজে লাগানো সম্ভব না হলে এবং রোহিঙ্গারা এদেশের কাঁধে স্থায়ীভাবে জেঁকে বসবে। আমি নিশ্চিত এর জন্য কোনো এক সময় হয়তো এদেশের মানুষ এখন যারা বৈরিতা সৃষ্টি করছেন, তাদেরকে দায়ী করবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিও এর দায় এড়াতে পারবে না। ঠিক এই মুহূর্তে বিএনপিকে যদি বলা হয় আপনারা আগামীর সম্ভাব্য সরকার হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারকে রোহিঙ্গা সমস্যার একটা সমাধান প্রস্তাব করেন। আমি নিশ্চিত যে তারা এই সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব আগামী তিন মাসেও দিতে পারবে না। কারণ বিএনপি এমন একটি দল যারা কখনই ছায়া সরকারের কাঠামো গড়ে তোলেনি বা দেশের সমস্যা নিয়ে তাদের কোন গবেষণা দল নেই। বিএনপি যদি আমার এই চ্যালেঞ্জকে পরাজিত করে একটি বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে পারে তাহলে শুধু আমি নই, দেশবাসীসহ আমরা সবাই অত্যন্ত আনন্দিত হব। বাস্তবতা হলো এই মুহূর্তে তাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলমান তাতে আর যাই হোক রাজনৈতিক নেতারা এই সব জটিল বিষয়ে সময় দিতে নারাজ। কিন্তু সমালোচনা করার জন্য তারা বিনা বাক্যে তৈরি। এভাবে আর যাই হোক, রোহিঙ্গা সমস্যার মতো জটিল সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন থাকে যদি এই সমস্যার সমাধান মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের কাছে থাকে, তাহলে তা বাস্তবায়নে বাধা কোথায়?
এর পর আসা যাক বন্দরের পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানিকে দিলে আমাদের লাভ ক্ষতির বিষয়ে, সেই সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তাবিঘ্নিত হওয়ার ভীতি। এই আলোচনার আগে আমার প্রশ্ন পাঠকের কাছে মংলা বন্দর তো হাসিনা সরকার ভারতীয় কোম্পানির কাছে তুলে দিয়েছিল, কই তখন তো গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া জনসমক্ষে এসে কেউ প্রতিবাদ করেননি।
তাহলে কি ধরে নেব তখন দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে বলে কারোরই মনে হয়নি? নাকি ভিন্ন মত জানাবার সাহস কারোরই ছিল না। নাকি ভারত এ দেশের পরম বন্ধু তাই নিরাপত্তার জন্য কোনো কিছু ভাবতে হবে না, যতক্ষণ এদেশের বন্দর, রাডার সিস্টেম এবং ট্রানজিটের জন্য নদীপথ, রেলপথ ও স্থলপথ ভারতের কাছে বন্দোবস্ত দেওয়া থাকবে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের যাত্রা শুরু হলে আখেরে দেশ তো বটেই আগামীর সরকারেরই সুবিধা পেত। অন্তত আগামীর সরকারকে এই জটিল বিষয়ের ওপর শুধু শুধু সময় ব্যয় করা লাগত না। আর বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির সময় চুক্তির বিধিমালা এমনভাবে তৈরি করা উচিত যেন সেই চুক্তি আদানির সঙ্গে হাসিনা সরকারের মতো দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তিতে রূপান্তরিত না হয়। তাহলেই দেশের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে এবং বন্দরের সক্ষমতাও বাড়বে।
এই সরকারকে যখন ক্ষমতায় আনা হয়, তখন বলা হয়েছিল তারা সকল সেক্টরের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেবে। কিন্তু এখন কারোরই আর তর সইছে না। এই সময়ে এসে কেন এমন হলো। এখানে আমি সরকারকেও এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করি। যে কারণে আমি তাদের দায়ী করতে চাই তা হলো;
১. তারা ছাত্রদের ছাড়া অন্য সবাইকে নষ্ট রাজনীতির অংশ মনে করে তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছে শুরু থেকেই। অথচ সরকারটি হওয়া দরকার ছিল রাজনৈতিক নেতা ও টেকনোক্র্যাটদের সমন্বয়ে গঠিত, যেখানে বড় ছোট সব দলের নেতাদের একত্র করে সরকার চালানো সম্ভব ছিল।
২. সকল সংস্কার কমিটি সরকারের হিস্যার রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ নিয়ে তৈরি করা প্রয়োজন ছিল।
এভাবেই বিগত নয় মাসে দ্রুততম সময়ে সংস্কারের প্রাথমিক বা এর পরের ধাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জবাবদিহিতার শাসন নিশ্চিত করে নির্বাচন করা সম্ভব ছিল।
রোহিঙ্গা সমস্যার প্রথম থেকেই বাংলাদেশ ‘সামরিক সমাধানকে’ তাদের অভিধানের বাইরে রেখেছে। ফলে কূটনৈতিক সমাধান শুধুমাত্র এক চায়ের টেবিলের আলোচনায় আটকে থাকে। কূটনৈতিক সমাধানের সফলতার জন্য সামরিক প্রস্তুতি এবং প্রয়োজনে দুই একটা অভিযান পরিচালনা করে শক্তিমত্তা এলান করা আবশ্যক ছিল।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করে গেছে বিগত শেখ হাসিনা সরকার। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি যে দেশের নিরাপত্তার জন্য এক চরম হুমকি সেটাই তাদের হাইপোথেসিসের মধ্যে ছিল না। ঠিক একইভাবে সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যেও কোনো অভ্যন্তরীণ গবেষণা হয়নি বলে অনুমান করছি। সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে কোনো গবেষণা হয়ে থাকলে তা আমার জানা নেই, যেখানে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সামরিক উপায় বা কোনো বিকল্প সমাধান তৈরি করা আছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে যদি সামরিক অভিযানের সহায়তায় ফেরত পাঠাতে হয় তাহলে কোন কৌশলে তা করা যেতে পারে তা তৈরি করাও সশস্ত্রবাহিনীর পেশাদারিত্বের অংশ। যদি তা অবহেলিত হয়ে থাকে তাহলে এই অবহেলা অমার্জনীয়। এ ধরণের পেশাদারিত্বের অভাব এবং দীর্ঘ সময় ক্ষেপন করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান না করা আজ ভয়াবহ দুর্বলতায় পরিণত হয়েছে।
তাই মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার যখন এই সমস্যাকে চিহ্নিত করে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে, তখন দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বশীলদের বিরোধিতা প্রকাশ্যে আনার কারণ বোধগম্য নয়। যুক্তির খাতিরেও যদি ধরে নিই যে ড. ইউনূসের সরকারের ম্যান্ডেট নেই এই সমস্যা সমাধানের, তাহলে এই সরকার বিদায় নেওয়ার পর পরের সরকারও যদি একই ফর্মূলা প্রয়োগে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয় তখন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানরা কি করবেন?
এবারের বিরোধে মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো যে যারা ক্ষমতার আসন পেয়ে যান, তারা দেশের বাকি সকল গোষ্ঠী বা দলসমুহকে ক্ষমতাহীন মনে করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা ভুলে গেছেন যে রাজনৈতিক দলের কাছে তাদের কর্মী-সমর্থকদের এক বিরাট বহর আছে। সরকারের সুযোগ ছিল দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা পাওয়ার। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তারা সেই সুযোগ হারিয়ে ফেলেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোন বাছবিচার ছাড়াই রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী-সমর্থকরা তাদের দলের অবস্থান ও বিশ্বাস বিবেচনাকে প্রশ্ন না করেই দলের নির্দেশে দেশকে অচল করে দিতে পারে। আওয়ামী লীগবিহীন বাংলাদেশে বিএনপিকে ক্ষমতাহীন ভাবার এবং ছাত্রলীগবিহীন ছাত্রদের নতুন দলকে মহাক্ষমতাবান ভাবা নিছক বোকামি। সরকারের উপদেষ্টাদের বোঝা উচিত তাদের পেছনে কেউ নেই, যারা রাস্তায় নেমে তাদের কাজকর্মকে সমর্থন করবে দ্বিধাহীনভাবে।
এতদিন ধরে মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের সঙ্গে সশস্ত্রবাহিনীর সুসম্পর্ক যে অনাস্থায় নিপতিত হয়েছে এর জন্য দায়ী বহু পক্ষ। এতে সবচেয়ে ক্ষতি হল জনগণের। লাভ শুধুই জুলাই বিপ্লবের বিরোধীশক্তির– এর সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য ভারতীয় প্রিন্ট মিডিয়াতে বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সঙ্গে সরকারের মতভিন্নতায় সেনাপ্রধানকে গ্লোরিফাই করে ক্রমাগত বিশেষ কলাম লেখা এবং সেনাবাহিনীকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রেসক্রিপশন দেওয়া। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশের জন্য ভারতীয় পত্রিকাগুলো কতটা ‘মঙ্গল’ চায় তা যে কোনো মানুষের কাছে বোধগম্য হলেও সেনাবাহিনীর একাংশের কাছে হচ্ছে না।
দীর্ঘ দিন ধরে দেশের কাঁধে চেপে বসা রোহিঙ্গা সমস্যা এবং কিছু জরুরি পদক্ষেপ যা আমাদের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে মাথা উচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিতে পারত তা বাধাগ্রস্থ হওয়ায় প্রধান উপদেষ্টা হয়তো তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে আর অগ্রসর হবেন না। ফলে সরকার প্রধানের চীন সফরের সফলতা যে মুখ থুবড়ে পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এতে ভারত এক ঢিলে বহুপাখি শিকারে সফল হতে যাচ্ছে। আগামীর রাজনৈতিক সরকার এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কতটা সফল হবে তা অনুমান করা কারো পক্ষেই অসম্ভব নয়। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে তিস্তা প্রকল্প চীন কর্তৃক বাস্তবায়নে ভারত কতটা বিরোধিতা করেছে বিগত দেড় দশক ধরে এবং আজকের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণের যে ক্ষতি হলো তা রাজনৈতিক সরকারের দ্বারা পূরণ সম্ভব নয় তা আমি আগাম বলে রাখলাম। এই দূরত্ব নির্মাণে ভূমিকা রেখে আমাদের রাজনীতিবিদরা দেয়ালের ওপারের দৃশ্য কতটুকু দেখতে পান তা নিয়ে আবারও সন্দেহ তৈরি করে দিলেন।