Published : 24 May 2021, 11:53 PM
নজরুল-সাহিত্যের শিল্পগুণ বিচার আমরা করেছি। করতেই হতো। ফলে, সাহিত্য-সমালোচনার এ অনিবার্য কাজটি করে হাত পাকিয়েছেন সাহিত্য-সমালোচক। কিন্তু, মহাকায় নজরুল তাতে ধরা পড়েননি।
নজরুলকে আমরা 'মিসরিড' করেছি এবং সম্ভবত, এতো প্রবলভাবে কাউকে আমরা আর 'মিসরিড' করিনি!
'মিসরিড' করার আপ্রাণ দক্ষতা দিয়ে নজরুলকে আমরা সাহিত্যের বৃত্তে আটকে ফেলেছি। সেই বৃত্তে আটকে ফেলে আমরা আমাদের ভণ্ডামিকেও প্রলম্বিত করার প্রয়াস চালিয়েছি। নজরুলকে এভাবে 'আদার' করে রাখা হয়েছে।
সাহিত্যের সন্তান নজরুল, শুধু কি সাহিত্যেরই সন্তান? এই যে তার নামের সঙ্গে সেঁটে গেছে, আমরা খুব ঘনভাবে সাঁটিয়ে দিয়েছি, 'বিদ্রোহী কবি' সত্তার পরিচয়টি, এর সঙ্গে গভীরভাবে সাঁটানো আছে নজরুলকে সামনে এগোতে না দেওয়ার মহাপ্রকল্পটি। আপনি যত ক্ষমতাবান হবেন, নজরুলকে আপনি তত দূরে ও পেছনে ঠেলে দিতে থাকবেন। এটা অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে করা হয়েছে।
নজরুলকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। কিন্তু, তাকে সংকুচিত করে ফেলা তো যায়! ফলে, 'চির বিদ্রোহী' নজরুলকে শুধু সাহিত্যের মধ্যে আটকে ফেলার চাতুরিটা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য? তাকে রাজনৈতিকভাবে ব্রাত্য করে দেওয়া।
নজরুলের রাজনৈতিক অবস্থান ও দর্শন তার সাহিত্যকে এতো তুমুলভাবে প্রভাবিত করেছে যে, সেটার প্রত্যক্ষ অবদানকে অস্বীকার করে কিংবা লুকিয়ে রেখে নজরুলকে ব্যাখ্যাই করা যায় না। যে রাজনৈতিকবোধের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ তার শ্রেণিবোধ। তার শ্রেণিবোধই তার সাহিত্যবোধের নির্যাস। স্বল্প সাহিত্যিক-জীবনে নজরুল কোনদিনও সে কক্ষপথ থেকে চ্যুত হননি। নজরুল তাই বাংলার একমাত্র অপাপবিদ্ধ জ্যোতিষ্ক।
নজরুলকে কীভাবে বুঝব?
এটা একটা জটিল প্রশ্ন। উত্তরও অনেক জটিল। নজরুলের অবস্থান তো পরিষ্কার। কিন্তু, নজরুলকে বুঝতে ও বোঝাতে গিয়ে, আমরা আমাদের নিজেদের অবস্থানকে যেভাবে ধুম্রজাল দিয়ে বেষ্টিত করেছি, সেটা নজরুলকে বোঝাপড়া করতে না চাওয়ার প্রক্রিয়াকেই বরং নির্দেশ করে। নজরুলকে আসলে আমরা 'আপন'ই ভাবতে পারিনি।
আপনি-আমি-আমরা যে শ্রেণিতে বিরাজ করে কর্পোরেটের নাগরিক দাস হয়েছি, নজরুলকে সে শ্রেণিবোধ দিয়ে বিচার তো দূরের কথা, আপনও ভাবা যায় না।
অতএব, নজরুল আমাদের আপন কেউ নন!
আজকে মৃত নজরুলকে ব্যবহার করে কর্পোরেট-ব্যবসা হচ্ছে বটে, সেটা লালন-রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও হচ্ছে, তাতে চেতনার চিত্রপট আঁকা নেই। আছে বেনিয়ার শঠতা। সে শঠতা নজরুলকে আপন ভাবে না। কদাপি না। কিন্তু, কর্পোরেট বেনিয়া আমাদের আপন হতে হতে শিঁদেল কেটে ঘরে ঢুকে গেছে। তাহলে, নজরুল আমাদের আপন থাকেন কী করে!
নজরুল জন্মেছিলেন আজ থেকে ১২২ বছর আগে। ভারতবর্ষে যখন জাতীয়তাবাদের বোধ আরও প্রোজ্জ্বল হচ্ছে। সে জাতীয়তাবাদের আধিপত্যবাদবিরোধী একটা সংগ্রাম ছিল। আবার, সে জাতীয়তাবাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজও বোনা ছিল। তার সময়ের চেয়ে বড় হয়ে ওঠা নজরুল আগেরটা বেছে নিয়েছিলেন।
এক্ষেত্রে, ক্লাস স্ট্রাগলটা তাকে সাহায্য করেছে বটে। তবে, ওসব করতে দমও তো লাগে। নজরুলের সে দমটা ছিল আকাশসম। নিজের যাপিতজীবনের শিক্ষা তো তার ছিলই। যেভাবে বড় হয়েছেন, যে লড়াইটা জীবনের সঙ্গে করেছেন, সেটা আমরা শুধু কল্পনাই করতে পারি। আপন করতে পারি না।
এ বাবদও নজরুল আমাদের আপন কেউ নন!
নজরুলকে নিজেদের সাম্প্রদায়িক প্রয়োজনে আমরা হরহামেশা ব্যবহার করেছি। তাকে গালি দিয়েছি, অপমান করেছি, ঘৃণা করেছি। কিন্তু, সম্প্রদায়গত বা ধর্মগত জাতীয়তাবাদের যখনই প্রভাব তৈরি করার প্রয়োজন হয়েছে, তখন তাকে কেউ আমরা মুসলিম-চেতনার কবি বানিয়েছি, কেউ শ্যামাসঙ্গীতের মহান গীতিকার বানিয়েছি। কিন্তু, আমরা তাকে ছুঁয়ে দেখতে চাইনি, তিনি কোন সারল্য ও সুকুমার মন নিয়ে গজল লিখেছেন, শ্যামাসঙ্গীত গেয়েছেন। তাকে আমরা এন্তার সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে ব্যবহার করতে চেয়েছি। কখনও বিপক্ষেও দাঁড় করিয়েছি সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োজনে। রবীন্দ্রনাথকে ছোট করার প্রয়োজনে।
এ নজরুল কোনদিনও আমাদের আপন ছিলেন না!
নজরুলের রাজনৈতিক চেতনার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থান। সেই অবস্থান থেকেই তিনি বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়েছিলেন ১৯১৭ সালে। বয়স তখন কম ছিল, মাত্র ১৮, এটা ঠিক। কিন্তু, সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তারুণ্যে ওই দ্রোহের আগুনটা না জ্বললে বুকে, তিনি যোগ দিতেন না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্য দলের অংশ হয়েছিলেন, ফ্যাসিবাদী অক্ষশক্তির বিপক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন, এটা তার ঐ ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনারই অংশ।
আধুনিক রাষ্ট্র ও সরকারগুলো যেভাবে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠছে, সেই অবস্থান থেকে দেখলে নজরুলকে তাদের পছন্দ করার কথা না। একটি রাষ্ট্র একই সঙ্গে ফ্যাসিস্ট, আবার সেই রাষ্ট্রের 'জাতীয় কবি' কাজী নজরুল ইসলাম, এবং রাষ্ট্রের দ্বারা তিনি রীতিমতো পূজিত, এটা রীতিমতো আশ্চর্যজনক এক সম্পর্ক!
নজরুলকে এ বিড়ম্বনার দিকে ঢেলে দেওয়ার অর্থ হলো, নজরুল যে কোনদিনও আমাদের আপন ছিলেন না, সেটা বুঝিয়ে দেওয়া।
অন্যদিকে, যে ব্রিটিশের পক্ষে নজরুল বিশ্বযুদ্ধে গিয়েছিলেন, সেই ব্রিটিশের বিপক্ষেই তিনি লিখেছিলেন 'রাজবন্দির জবানবন্দি' কিংবা 'আনন্দময়ীর আগমনে'। ফলাফল, গ্রেফতার। তিনি বিপ্লবের নেশায় এতোটাই উদ্বুদ্ধ ছিলেন যে, ব্রিটিশ আধিপত্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পিছুপা হননি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির স্বপ্ন ছিল তার মনন ও মগজে। এই যে অবস্থানটা, অত্যাচারিত হচ্ছেন কিন্তু আপস করছেন না, এটা অনিন্দ্যসুন্দর। আজকে রাষ্ট্রের যে চরিত্র দাঁড়িয়েছে, যে চরিত্র লালন করেও রাষ্ট্র নজরুলকে ধারণ করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে, আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে অমন প্রতাবশালী নজরুল বারবার কারাগারে অন্তরীণ হতেন।
তো, কী দাঁড়াল, এ নজরুল আমাদের আপন ছিল?
নজরুলের সাম্যবাদী চেতনা নিয়ে এতো যে কথা, সে কথাগুলো আজ দেখে তো মনে হয় শুধুই আলাপ করার জন্যই। নজরুলকে ব্যবহার করা যায় প্রবলভাবে, কিন্তু, নজরুলের সাম্যবাদী চেতনার পতাকা ধরার দূরতম আকাঙ্ক্ষাও আমরা বহন করি না। যদি নাই করি, তাহলে নজরুল-বন্দনার লোক দেখানো ভণিতা কেন? নজরুল আমাদের আপন নন বলে?
নজরুল এক অর্থে ছিলেন 'ভাষাধিরাজ'। বাংলা-উর্দু-সংস্কৃত-আরবি-পারসি মিশেলে নজরুলের ভাষার যে গতি, সে গতি দামামা বাজিয়েছে তার দ্রোহের তালে তাল মিলিয়েই। এতোটা অকপটে তিনি ভাষার সমন্বয় সাধন করে ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখতেন যে বিস্ময়ে বিমূঢ় হতে হয়। আজকে চেতনার নামে ভাষা নিয়ে যে রাজনীতি এ বাংলাদেশে হচ্ছে, নজরুলের ভাষার গতি ও প্রকৃতির দিকে তাকালে মনেই হবে না, আমরা নজরুলকে কখনও আপন করে নিতে পেরেছি।
নজরুল আবার অবিশ্বাসী মানুষদের কাছেও খটমটে ও একটু দূরে রেখে দেওয়ার বিষয়। কেননা, মসজিদের পাশে তিনি তার কবর চেয়েছেন। তা যে ব্যক্তি মসজিদের পাশে নিজের কবর চান, তিনি কী করে শ্যামাসঙ্গীত লিখেন? লিখেন কারণ, নজরুলের দ্রোহভাষার যে ছান্দসিক গতি, আর শ্যামার দ্রোহের যে গতি, তা সমানুপাতিক। ওখানে তারা মিলতে পারেন। ঠিক তেমনই, অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে নজরুল যে কত বড় সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারেন, সেটা আমরা বোধও করতে পারিনি হয়তো। বাইনারি না করেও বলা যায়, নজরুল এখানে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও এগিয়ে।
শেষ কথা হলো এই যে, নজরুলকে আমরা আমাদের ভুলপাঠ বা মিসরিডের সবচেয়ে বড় শিকার বানিয়েছি। সেই শিকারকে আমরা প্রয়োজন মতো নানাভাবে নানা আঙ্গিকে বাজারে নিজেদের মতো বিক্রি করেছি, করছি। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও করেছি, রাজনীতির ক্ষেত্রেও করেছি। সংকটের কালেও করেছি, সমাধানের কালেও করেছি। কিন্তু, দিন শেষে, নজরুলকে আমরা আমাদের আপন করে নিতে পারিনি। আমরা বোধ করতে পারিনি, নজরুলের চেয়ে বড় কোন 'আর্টিস্ট কাম অ্যাকটিভিস্ট' জন্মাননি বাংলায়। জন্মাবেন, সেটা দূরতম কল্পনাতেও দেখা যাচ্ছে না। কেননা, নজরুলকে টপকানোর মতো স্ট্রাগল আমাদের মগজে-মজ্জায় আর অবশিষ্ট নেই!