Published : 24 Jun 2025, 11:54 AM
সুইস ব্যাংকে গত বছর বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থ নিয়ে দেশে চলছে তুমুল আলোচনা। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু—গণ-অভ্যুত্থানে বিগত সরকারের পতনের পরও এত বিপুল অর্থ কীভাবে সেখানে জমা হলো?
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি হিসাবে জমা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৯ কোটি সুইস ফ্র্যাঁ। এক সুইস ফ্র্যাঁর মূল্য ১৫০ টাকা ধরে হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা।
২০২৩ সালে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ কোটি ফ্র্যাঁর কাছাকাছি। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৩ গুণ নয়, ৩৩ গুণ বৃদ্ধি! এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি নিজেই বিভ্রান্ত। বুঝলাম, শুধু আমি নই—বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও একই প্রশ্নে উদ্বিগ্ন।এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি জমা অর্থ ৩৩ গুণ বেড়ে যাওয়ার খবরে ‘হতাশা’ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমি জানি না, এটা কখন হয়েছে। তবে এটা ভয়াবহ ও অস্বাভাবিক।”
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে মির্জা ফখরুল আরও বলেন, “সুইস ব্যাংকে কীভাবে এত টাকা গেল? আমি জানি না এই টাকাগুলো কার, কখন, কীভাবে জমা হয়েছে। তবে ২০২৪ সালেই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এটা হয়েছে ফ্যাসিস্ট আমলে, একদলীয় শাসনের সময়।”
সমস্যাটা হলো—সুইস ব্যাংকে কারা কত অর্থ রেখেছে, সে তথ্য সরকারের কাছে নেই। ২২ জুন বাজেট পাশের পর এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এত বিশাল পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে অবাক হয়েছেন। তিনি বললেন, বিষয়টির খোঁজ নেওয়া হবে।
এই ‘যদি’ ও ‘খোঁজ নেওয়া’ শব্দগুলোই আমাদের অনেককে ভাবিয়ে তুলছে। বিষয়টা বুঝবার জন্য দেশের দুই খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা বললাম। প্রথমজন বললেন, “যে অর্থ সুইস ব্যাংকে জমা হয়েছে, তা সবটাই ব্যক্তিগত তা বলা যাবে না। আবার সব অর্থ বাংলাদেশ থেকেই গেছে, সেটারও প্রমাণ নেই। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিরও সেখানে অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে, যারা বৈধভাবে ব্যবসা করে সেই অর্থ জমা রাখেন।”
তবে একটি বিষয়ের দিকে তিনি গুরুত্ব দেন—সুইস ব্যাংক সাধারণত জমা টাকার বিপরীতে খুব কম সুদ দেয়। অর্থাৎ, যারা অর্থ জমা রাখে, তারা মূলত নিরাপত্তার জন্যই এই ব্যাংক বেছে নেয়।
এই যুক্তিগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সরকার নিজেই স্বীকার করেছে—কে বা কারা এই বিপুল অর্থ জমা রেখেছে, সে সম্পর্কে তাদের কাছে নির্দিষ্ট তথ্য নেই।
তবে, ২০২৪ সালেই যে প্রথম এত বিপুল অর্থ সুইস ব্যাংকে জমা হয়েছে—বিষয়টি তেমন নয়। বরং ২০২৩ সালের আগেও আরও বেশি অর্থ জমা হওয়ার নজির রয়েছে।
কৌতূহলবশত আমি সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের ওয়েবসাইট ঘেঁটে যা জানতে পারলাম, তা আরও বিস্ময়কর। দেখা গেল, সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা হয়েছিল ২০২১ সালে—প্রায় ৮৭ কোটি সুইস ফ্র্যাঁ। ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত (২০২৩ বাদে) গড়ে প্রতি বছর জমার পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ফ্র্যাঁর আশপাশে।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশের তথ্য পাওয়া যায়। সেখানকার হিসাব অনুযায়ী, ওই বছর সুইস ব্যাংকে জমা ছিল প্রায় ৪ কোটি ফ্র্যাঁ। এরপর ধারাবাহিকভাবে সব সরকারের আমলেই কম-বেশি অর্থ জমা হয়েছে। বিশেষ করে ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই জমার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল—২০০৬ সালের তুলনায় বেড়ে হয়েছিল ২৪ কোটি ফ্র্যাঁরও বেশি।
তাহলে ২০২৪ সালে আবার হঠাৎ এমন লাফিয়ে বাড়ার কারণ কী?
এই প্রশ্নে দ্বিতীয় আরেকজন অর্থনীতিবিদের কাছে গেলাম। তার বিশ্লেষণ থেকে যা বোঝা গেল, তা হলো—বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো বিদেশি লেনদেন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন দেশে নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট খুলে রাখে। অর্থাৎ, বিদেশি ব্যাংকে তারা নিজের নামে একটি অ্যাকাউন্ট রাখে, যার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করা হয়। এই হিসেবে, সুইজারল্যান্ডেও কিছু বাংলাদেশি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জমা করা অর্থের বিপরীতে এসব ব্যাংকের একাউন্টের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে, এমনটাই তার ধারণা। যদিও এসব একাউন্টে থাকা রপ্তানির টাকা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশে আনা বাধ্যতামূলক। জমা করা অর্থ সুইজারল্যান্ডের দিক থেকে দায়—অর্থাৎ আমাদের দিক থেকে এসব অর্থ সেখানে রাখা হয়েছে। কিভাবে রাখা হয়েছে, সেই আলোচনায় একটু পর আসব।
তিনি হুন্ডির কথাও উল্লেখ করলেন। তবে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করলে সেটি ব্যক্তিগত একাউন্টে জমা হয়। কিন্তু বর্তমানে সুইস ব্যাংকে জমা থাকা অর্থের বেশিরভাগই ব্যাংকের নামে, এমনটাই তার বিশ্লেষণ। সুইস ব্যাংকে জমা থাকা অর্থের আরেকটি উৎস হতে পারত বিনিয়োগের জন্য রাখা অর্থ। তবে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত কোনো বিনিয়োগের খবর শোনা যায়নি।
এমন প্রেক্ষাপটে ধারণা করা হচ্ছে, যেহেতু গেল বছর অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে বাণিজ্য বাড়েনি, তাই বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা হয়েছে, যা আগে হয়তো এত স্পষ্ট ছিল না। আমরা দেখেছি, বিগত সরকারের সময় যেসব ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, তাদের অনেকের মালিকই বড় বড় পাচারকারী। ৫ অগাস্টের পর এসব খবর প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। তাদের অনেকে কারাগারেও রয়েছেন।
অন্যদিকে, অনেকে মালিক না হয়েও ব্যাংকের ওপর প্রভাবশালী ছিলেন এবং হয়তো এখনও আছেন। গণ-অভ্যুত্থানের পর সরকার বদলালেও এসব ব্যাংকে অনেকেরই নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রয়েছে। কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকেই ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। হয়তো এই কারণেই ২০২৪ সালে সুইস ব্যাংকে হঠাৎ এমন উলম্ফন দেখা যাচ্ছে। কারণ দ্রুত অর্থ সরানোর জন্য ব্যাংকের চাইতে ভালো মাধ্যম কমই আছে।
আমরা জানি, গত বছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করেছিল। পাচারকারীরা এই সুযোগে তাদের কাজ চালিয়েছেন বলে ধারণা করা যায়। ওই সময় একটি বড় শিল্প গোষ্ঠীকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে অর্থ ছাড় দেওয়া হয়েছিল। তারা ওই টাকা সুইস ব্যাংকে তাদের মালিকানাধীন ব্যাংক ব্যবহার করে জমা করেনি—এর নিশ্চয়তা কোথায়? এমন প্রশ্ন তুলেছেন দ্বিতীয় অর্থনীতিবিদ।
প্রথম অর্থনীতিবিদ বললেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে সাধারণত টাকা পাচার বৃদ্ধি পায়। যেহেতু ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন দেশের ও বিদেশের অনেক অংশে গ্রহণযোগ্য ছিল না, তাই অনিশ্চয়তার মধ্যে পাচারকারীরা দ্রুত সম্পদ সরাতে শুরু করে। নির্বাচনের প্রাক্কালে সুইস ব্যাংকে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ বাড়া এই কারণেই সম্ভব। সুতরাং, ওই ব্যাংকে থাকা একটি বড় অংশ পাচারের টাকা বলে ধারণা করা যায়।
ব্যাংকটির তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে বাংলাদেশের অর্থ জমার পরিমাণ প্রায় দেড়গুণ বেড়েছিল—ওই বছরও নির্বাচনি বছর ছিল। একইভাবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়ও ২০১৭ সালের তুলনায় দেড়গুণ বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, নির্বাচনের সময় সম্পদ পাচারকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
শুধু খোঁজ নেওয়াই নয়, বর্তমান সরকারের সামনে সুযোগ রয়েছে সুইস ব্যাংক থেকে একাউন্টধারীদের তথ্য সংগ্রহের। ভারতসহ বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশ ইতোমধ্যেই সুইস ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছে এই তথ্য পেতে। সাধারণ তথ্য পেতে বাংলাদেশের চুক্তি করতে হবে না। কারণ, অর্থপাচার প্রতিরোধে কাজ করা বিশ্বের ১৭৭টি দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের জোট এগমন্ড গ্রুপের সদস্য বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড।
সেহেতু সরকার চাইলেই একাউন্টধারীদের বিষয়ে তথ্য আনতে পারে। তবে সন্দেহজনক লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্য চাইতে হবে। তাবৎ তথ্য চেয়ে বসলে পাওয়া সম্ভব নয়। আগের সরকারেই যেহেতু পাচারকারীরা ছিল, তারা ওই Z_¨ PvB‡Zv bv| বর্তমান সরকারের লক্ষ্য ও ইচ্ছা থাকলে GUv m¤¢e| একবার এই তথ্য চাওয়া শুরু করলে পরবর্তী সরকার গুলো এর ধারবাহিকতা ধরে রাখবে আশা করা যায়। ফলে ভবিষ্যতের পাচারকারীরাও সতর্ক হয়ে যাবে। তাছাড়া বর্তমান সরকারের তো দুই উপদেষ্টা, তাদের ব্যক্তিগত সহকারী এবং নবগঠিত রাজনৈতিক দলটির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এসব নেতারা নানা সময়ে প্রশাসনের কেন্দ্র সচিবালয়ে ঘোরাঘুরি করতেন। তারাও যে আগের মতোই সম্পদ সরিয়ে ফেলার সুযোগটি অস্থিতিশীলতার সময়ে করেননি সেটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
পাচার করা অর্থের তথ্য কিভাবে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক দুই শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে। তারা বললেন, সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে তথ্য পাওয়া সম্ভব। এছাড়া আছে জাতিসংঘের মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিটেন্ট (এমএলএ), যে আইনটিতে ২০১২ সালে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ।
এরপরও যদি তথ্য না পাওয়া যায় তাহলে জাতিসংঘের বিভিন্ন কনভেশনের সহায়তা নেওয়া যায়। যেমন, অর্থপচার প্রতিরোধ টাস্কফোর্স-এফএটিএফ, দুর্নীতি বিরোধী কনভেনশন-আনকক, আন্তঃমহাদেশীয় অপরাধ দমন কনভেনশন-পালারমো। এর বাইরে কমনওয়েলথ দেশগুলোর মধ্যে যে সাধারণ চুক্তি আছে সেটা ব্যবহার করেও অর্থপাচর সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া সম্ভব।
শুধু প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও লেগে থাকার মানসিকতা। এসব চুক্তি বা কনভেনশনের অধীনে দুই দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য আদান প্রদান করে। তবে শর্ত হচ্ছে তা গোপন রাখতে হবে। এমনকি অনুমোদন ছাড়া আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকেও সেই তথ্য দেওয়া যায় না।